(প্রথম পর্ব)
শুরুটা আমার বন্ধু, জাবির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক, স্বাধীন সেনের ফেইসবুকের স্ট্যাটাসটা দিয়ে করছি। গত ৪ঠা অক্টোবর ২০১২ তারিখে স্বাধীন সেন রামুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফেইসবুকে ইংরেজিতে একটা মন্তব্য পোস্ট করেছিলেন।
“ধর্ম-বিশ্বাসের সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোন সরাসরি সম্পর্ক নেই। একজন নাস্তিক যেমন সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারেন, একজন ধর্ম-বিশ্বাসী তেমনই অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারেন। যে মানুষ রবীন্দ্র সংগীতে মুগ্ধ হন, জীবনানন্দ পড়েন, কীর্তন বা মুর্শীদি গান শোনেন, সেই মানুষটিও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারেন। সাম্প্রদায়িকতা মানব চরিত্রের কোন সুনির্দিষ্ট আর ধ্রুব বৈশিষ্ট্য না। একই মানুষকে বিভিন্ন সময় বা পরিবেশ সাম্প্রদায়িক কিংবা অসাম্প্রদায়িক করে তুলতে পারে। সকালের অসাম্প্রদায়িক মানুষটিও বিকেলে হিংস্র সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারেন। যে সংখ্যাগুরু মানুষটি বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক, তিনিই ভারত বা আমেরিকা গিয়ে হয়ে উঠতে পারেন চরম সাম্প্রদায়িক। সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব পরিস্থিতিগত এবং প্রকাশের ধরণ হস্তগত ক্ষমতা বা ভীতির চর্চার সাথে সম্পর্কিত। এক কথায় সাম্প্রদায়িকতা আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
‘অসাম্প্রদায়িকতারও’ সীমারেখা আছে। অন্যদের নিয়ে আমাদের নিরীহ কৌতুক এবং আমাদের প্রাত্যহিক মুখের ভাষাও সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারে। যেমন আমরা হিন্দু বন্ধুদের `মালাউন` বা `খোঁচা`, মুসলমান বন্ধুদের `মোচা` বা `নেড়ে` এবং পাহাড়ী বন্ধুদের `বোঁচা` ডেকে সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটাতে পারি। মোটাদাগে এসব বিশেষণকে নির্দোষ এবং আক্রমণাত্মক মনে না হলেও এগুলোই সাম্প্রদায়িকতার পথকে সুগম ও সম্পর্কের বিভাজনকে দ্রুততর করার পাশাপাশি ব্যক্তি পরিচয়কে আলাদা এবং হেয় করে তোলে।
`কালো পিঁপড়া ও লাল পিঁপড়া` গল্পটা অনেকেরই জানা আছে। এই গল্পে হিন্দুরা নিজেদের কালো পিঁপড়ার মত অহিংস্র এবং মুসলমানদের লাল পিঁপড়ার মত হিংস্র বলে বর্ণনা করেন; মুসলমানরা আবার উল্টোটা বর্ণনা করেন। সাম্প্রদায়িকতা আমাদের দৈনন্দিন জীবন-যাপনে সতত বিরাজমান। সুযোগ-সুবিধা, লোভ, ভয়, রাজনীতি, ক্ষমতা পাওয়া না পাওয়া এমকি গনতান্ত্রিক নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেও এর প্রকাশ ঘটতে পারে। সুপ্ত বা প্রকাশিত রূপে আমরা সব সময়ই সাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করি এবং আধুনিক জাতি বা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এটা আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে। বলা যায়, আধুনিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা পরস্পরের সাথে হাতে হাত রেখে চলে।
................ অসাম্প্রদায়িকতা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। অসাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা সতর্ক অনুশীলন আর সাধনার বিষয়। প্রতিদিনের আত্মত্যাগ আর রীপুর সাথে যুদ্ধ করে অসাম্প্রদায়িকতা অর্জন করতে হয়। ”
মনের গহীনে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির একটা পরিবেশগত প্রভাব আছে। এটা মানুষের সামাজিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ। বিভিন্ন প্রতীকী গল্প বর্ণনা কিংবা নেহায়েত কৌতুক বা হাস্যরসের মাধ্যমে কখন যে মানসপটে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন হয়ে যায় সেটা বোঝা মুস্কিল। ঠিক তেমনিভাবে সাম্প্রদায়িকতার সংগে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক আছে। সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটনে যতো উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, এর পিছনের কারণগুলোকে শনাক্ত না করতে পারলে আপাত স্বস্তি পাওয়া গেলেও নিয়মিত বিরতিতে তা আবার ফিরে আসার আশংকা থেকেই যাবে।
ছোটবেলায় প্রত্যহ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে একটা শিশু যেমন তার লিংগীয় ধারণা পায়; ঠিক তেমনি সেই সাথে ভাল মন্দের ধারণাসহ সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া কেমন হবে, নানা পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, সে সম্পর্কেও শিশুকাল থেকে মানুষ সামাজিক শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ধীরে ধীরে এটাই তার আত্মপরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। নানা ভাষাভাষী এবং নানা সংস্কৃতির এই পৃথিবীতে তেমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো নিজের স্বকীয়তা কিংবা আত্মপরিচয় লাভের পাশাপাশি অন্যের সম্পর্কে সে কি ধারণাটা পাচ্ছে সেটা নিয়ে। এই শিখন প্রক্রিয়াটার প্রভাব সারাজীবন মানুষের ভিতরে কাজ করে এবং তার ব্যক্তিত্ত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে, যদি না পরবর্তী সময়ে তার চিন্তার জগতে বড় কোনো পরিবর্তন না আসে। (চলবে)
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১১২০ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]