ঢাকা, শনিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

জুলাই বিপ্লবের ভবিষ্যৎ কি আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে

সাবাহ কানেতা তারিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৫
জুলাই বিপ্লবের ভবিষ্যৎ কি আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বলি বা ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান বলি, এখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বোচ্চ। নিম্ন মাধ্যমিক থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার্থী—সবাই এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে তারা অদম্য সাহসের পরিচয় দিয়েছে, তা কি পূরণ হওয়ার পথে যাচ্ছে?

যে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এতগুলো জীবন বিসর্জন দেওয়া হলো, সেই ফ্যাসিবাদ থেকে কি আমরা আসলে রেহাই পেয়েছি? নাকি আমরা আবারও সনাতন রাজনীতির বেড়াজালে ধরা পড়তে চলেছি?

এমন অনেক প্রশ্ন বর্তমানে আমার মতো শিক্ষার্থীদের মনে জাগছে। ১৫ জুলাই রাতে যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এসেছিল,  যখন জীবন হাতে নিয়ে মাঠে ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমে আমরা যুদ্ধ করছিলাম, তখন আসলে আমরা কেমন বাংলাদেশের আশা করেছিলাম?

এখানে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে—একদিকে এক শ্রেণির মানুষ, যারা বিভিন্ন ধরনের রাজনীতিতে যুক্ত এবং অন্য পক্ষে নিতান্তই সাধারণ মানুষ, যারা রাজনীতি নিয়ে তেমন আগ্রহী নয়।

যারা রাজনীতিতে যুক্ত, তারা মূলত দীর্ঘ রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তির একটা পথ খুঁজছিল। মুক্তির পর বর্তমানে তারা নিজ নিজ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে নিজেদের অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টায় রত। তাদের মধ্যে সবাই যে জুলাই বিপ্লবের আদর্শ ধরে রেখেছে, তা নয়; তবে অনেকেই জুলাই বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করার আশ্বাস দিচ্ছে।

অন্য পক্ষে সাধারণ মানুষের কাছে এই আন্দোলন ছিল নিতান্তই চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।

কিন্তু ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর থেকেই তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে, একেবারেই নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রেরণা নিয়ে তারা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের সেই চেতনা, সেই একতা, সেই বিশুদ্ধ বিপ্লবী মনমানসিকতা আজ কোন পথে এগোচ্ছে?
এটা কেউ যতই অস্বীকার করার চেষ্টা করুক না কেন, জুলাইয়ের আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা কিন্তু সব ধরনের রাজনৈতিক, ধর্মীয়, আদর্শগত বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরেও যে অভিভাবকরা তাদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তাঁরাও বিশেষ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন না। বরং নিতান্তই শিক্ষার্থী নিগ্রহের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ হিসেবে বিবেকের তাগিদে তাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

কিন্তু পরে আমরা দেখেছি, এই আন্দোলনকে একটি সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত আন্দোলন হিসেবে দাবি করা হয়েছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, শহরে-গ্রামে যাঁরা সমন্বয় করছিলেন, তাঁদের সবার না হলেও, অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে এসেছে। তখন কখনো কখনো মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমরা কি শুধুই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি আন্দোলনের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছি? আমাদের সেই চেতনার স্থান ভবিষ্যতের বাংলাদেশে কতটুকু সংরক্ষিত হবে?

আন্দোলনের সময় আমরা সবাইকে একাকার হয়ে যেতে দেখেছি। নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী, বোরকা ও টি-শার্ট পরা ছাত্রী—সবাই একসঙ্গে ছিল। পরস্পরের ওপর অসাধারণ একটা বিশ্বাস ছিল! বারবার স্কুলের মেয়েরা বলেছে, আমরা ভয় পাই না। তারা অত্যন্ত নিষ্পাপ, ন্যায্য ও সত্যিকারের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে দাঁড়িয়েছিল রাস্তায়।

যেভাবে সেদিন সবাই একে অপরের বিপদের সাথি ছিল, আজ কি দেশবাসী তেমন আছে? ৫ আগস্টের পরও ‘দেশকে চালাতে হবে’—এই প্রেরণা নিয়ে ক্ষুধার্ত, ঘর্মাক্ত ছেলে-মেয়েদের রাস্তায় রাস্তায় কখনো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে, কখনো পরিচ্ছন্নতা অভিযানে, কখনো গ্রাফিতি অঙ্কনে দেখা গেছে; সেই নিষ্পাপ শুদ্ধতাকে আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পারছি? বা ভবিষ্যৎ সরকার কতটুকু ধরে রাখতে পারবে? 

অন্যায়ের বিরুদ্ধে এত বড় লড়াইয়ের পর আজকে আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অন্যায়ের শিকার হচ্ছি। যে অন্যায়টি সবচেয়ে বেশি মাথাচাড়া দিয়েছে তা হলো মব জাস্টিস।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ভয়াবহ হারে বেড়েছে গণপিটুনির ঘটনা, যা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নৈতিকতার অবনতির ইঙ্গিত দেয়। মাঠে প্রশাসন সক্রিয় না থাকায় জায়গায় জায়গায় উগ্র মানসিকতার জনগণ আইন তাদের নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। বেশির ভাগ মানুষ বিভিন্ন ঘটনায় ফ্যাক্ট চেক না করেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় এবং গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটায়।  

গত কয়েক সপ্তাহে প্রায় দুই ডজন মানুষ গণপিটুনিতে মারা গেছে বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষার পাদপীঠে ছাত্রদের দ্বারা এমন ঘটনা ঘটেছে, যা জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সন্দেহভাজন অপরাধী বা চোর বলে গণ্য করে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে, সেখানে ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগই পায়নি।

বর্তমান অস্থায়ী সরকারের ওপরও জবাবদিহির দায় অনেক বড়। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কারো কারো অতীত প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁদের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিচয় সাধারণ মানুষকে নতুনভাবে ভাবাচ্ছে। অনেকেরই ভাবনা, এই পুরো আন্দোলনের অর্জন এখন ভিন্ন খাতে পরিচালিত হয়ে যাচ্ছে কি না।

এর ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অন্তর্বর্তী ও ভবিষ‌্যৎ সরকার ন‌্যায়বিচারকে কতটা প্রতিষ্ঠা ও ধারণ করতে পারে। বর্তমানে ঘটে যাওয়া এবং জুলাই বিপ্লবের সময় বিভিন্ন পক্ষের দ্বারা সংঘটিত অন্যায়ের বিচার কেমন করা হচ্ছে।

আমরা কিন্তু অপরাধীদের নির্বিচার মুক্তির জন্য আন্দোলন করিনি, জায়গায় জায়গায় মব জাস্টিসের নামে যাকে-তাকে আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করিনি!

আবার স্বাধীনতার মুক্তচর্চার মাধ্যমে অন্যান্য রাজনৈতিক দল সাধারণ মানুষের ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে, তার ওপরও অনেকাংশে নির্ভর করে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসছে এবং তাদের রাজনীতি চর্চায় জুলাই বিপ্লবের প্রভাবের ওপর আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।

আমরা সুন্দর-সুখী-সমৃদ্ধ এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম, যেখানে সবার নিজ স্থান অটুট ও নিরাপদ থাকবে। সবার মত প্রকাশের এবং ন্যায্য বিচার চাওয়ার অধিকার থাকবে। কাউকে তার রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা অন্য কোনো মতাদর্শের কারণে নিগৃহীত হতে হবে না।

আজ যদি রাজনীতির কেবল ওপিঠ সামনে আসে, তাহলে আমাদের প্রয়াস, আমাদের বলিদান ব্যর্থ সাব্যস্ত হবে।

লেখক: দ্বিতীয় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।