ঢাকা, শনিবার, ২৭ পৌষ ১৪৩১, ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

ক্ষমতার ভারসাম্য জরুরি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৫
ক্ষমতার ভারসাম্য জরুরি

জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে বাংলাদেশের দীর্ঘ সময়ের স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের। ৩৬ দিনব্যাপী আন্দোলন, সংঘর্ষ ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের উৎখাত ঘটলেও নয়া রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশে ক্ষমতার শূন্যতা ও নানা রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।

দলীয়করণের ফলে অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশের প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গনেও।

ফলে এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ছাত্রসমাজ ঠিক কতটুকু শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে তা-ই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এখানে বলে রাখা ভালো, কয়েক যুগ ধরে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে মূলত পরিবারতন্ত্রের চর্চা হয়ে আসছে। এই অভিযোগ মূলধারার বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের ওপরই। পরিবারতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়ার পেছনে তৃণমূল নেতাকর্মীরা যেমন দোষী, তার সঙ্গে গণমানুষের মনস্তত্ত্বেও পরিবারতন্ত্রের ওপর দৃশ্যমান নির্ভরশীলতা রয়েছে। অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা ও ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকায় এই পরিবারগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠেছে দানব।

এভাবেই তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে পরিবারতন্ত্রের দাপটে রাজনৈতিক ক্ষমতা কয়েকটি পরিবারের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে, যারা মূলত বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। প্রধান রাজনৈতিক পরিবার হিসেবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপিপন্থি ছাড়াও বিগত ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনামলে উদ্ভব হয়েছে বেশ কিছু ক্ষমতাধর পরিবারের। দেশের ব্যাংকিং, পোশাক ও ঔষধশিল্পেও এ রকম কিছু পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য গত ১৫ বছরে লক্ষ করা গেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তরুণ জনশক্তিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে।

তৃণমূল রাজনীতিতে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারের লড়াই, সংঘর্ষ নতুন কিছু না। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।

রাজনীতির এমনই টালমাটাল সময়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আমরা কেমন দেখতে চাই আগামী দিনের রাজনীতি?

প্রথমত, জাতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আমাদের বিচার বিভাগ, আইনসভা ও প্রশাসনের মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, কোনোভাবেই যেন কোনো একটি অংশ অতিরিক্ত ক্ষমতাধর হয়ে না ওঠে।

এখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও অন্যতম বড় ইস্যু।

অন্যদিকে বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকেই তারুণ্যের জোয়ার চলছে। এই তরুণ জনশক্তিকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগানোসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। একজন ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে ডাকসু, জাকসুর মতো ছাত্রসংসদ চালু করতে হবে। এতে তরুণদের মধ্য থেকে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর বেফাঁস মন্তব্য করে দেশে আরো বিভক্তির সৃষ্টি করা উচিত হবে না। এরই মধ্যে দেশ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত নাজুক সময় পার করছে। অন্তত নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ছাত্র, সমন্বয়ক ও রাজনীতিবিদদের সমন্বয় করে চলা প্রয়োজন। অন্যদিকে নির্বাচনে ছাত্র সমর্থিত বিকল্প রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করলে তা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

এ ছাড়া আগামী দিনের রাজনীতিতে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা চালু করতে হবে, দলের ভেতর ক্ষমতার পূর্ণ ভারসাম্য না থাকলে মানব থেকে আবারও দানব হয়ে ওঠার আশঙ্কা থেকেই যায়।

তৃতীয়ত, দেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে দল-মত-নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রে, দলীয় স্বার্থ রক্ষার আগে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জোর দিতে হবে। আগামীতে ক্ষমতায় যে-ই আসুক না কেন, যেকোনো ধরনের বৈদেশিক চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা ও জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। কোনো ধরনের অসম, দেশবিরোধী ও গোপন চুক্তি করা যাবে না।

রাজনীতিতে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেন আগামীতে কোনো ব্যাংক লুটেরা, খুনি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে না পারে।

একই সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল পর পর দুইবারের বেশি যেন ক্ষমতায় থাকতে না পারে তা সাংবিধানিক আইনের ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে।

সব শেষে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যমান সমস্যা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংকট দূরীকরণে প্রতিটি গোষ্ঠী থেকে মূলধারার রাজনৈতিক প্রতিনিধি তৈরি করতে হবে। এই রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা যেন পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিটি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন তা তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: মুহাম্মদ ইরফান সাদিক, চতুর্থ বর্ষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।