ঢাকা, সোমবার, ২৯ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার

দুর্নীতি ও বৈষম্য দূর করতে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন জরুরি

সারোয়ার তুষার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
দুর্নীতি ও বৈষম্য দূর করতে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন জরুরি সারোয়ার তুষার

‘গণতন্ত্র নয়, উন্নয়ন’—এই নীতিতে বাংলাদেশে গত ১৫ বছর সরকার পরিচালিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ক্ষমতা ধরে রাখতে শেখ হাসিনার এই নীতির মূলমন্ত্র ছিল মেগাপ্রজেক্ট।

আর মেগাপ্রজেক্ট মানেই মেগাদুর্নীতি। অধ্যাপক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সম্প্রতি প্রকাশিত শ্বেতপত্রে জানা গেল, গত ১৫ বছরে প্রতিবছর দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।

মোট ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এতে পরিষ্কার যে ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই শেখ হাসিনা এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ জনগণের সম্পদ লুটের উদ্দেশ্যে দেশ শাসন করেছে। শেখ হাসিনার মতো দেশীয় লুটেরা শাসকরা এই দেশকে নিজেদের ভবিষ্যৎ মনে করেন না বিধায় তাঁদের লুট করা টাকার গন্তব্য হয়েছে কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ। শেখ হাসিনা নিজে স্বীকারও করেছেন, তাঁর ড্রাইভার ৪০০ কোটি টাকার মালিক।

জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীরা যে দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল, সেটি ছিল লুটেরা মাফিয়া সিন্ডিকেটের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কোটা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে সরকারি চাকরিতে আওয়ামী লীগের দল ভারী করার আয়োজন করা হয়েছিল। কারণ লাগামহীন লুটপাটের জন্য শেখ হাসিনা সর্বত্র নিজের আস্থাভাজন লোক রাখতে চেয়েছেন, লুটেরা সিন্ডিকেটকে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর করতে চেয়েছেন। এর সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গুম-খুন এবং রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে।

এই লুটেরা মাফিয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ছাত্ররা সংগ্রাম শুরু করলে জনগণ তাদের সঙ্গে শামিল হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফরম গঠিত হওয়ার পর আপামর জনগণ এর সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে। ফলে আন্দোলনটি আর কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি; ফ্যাসিবাদবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এই পটভূমি থেকে আমাদের আগামীর বাংলাদেশের চলার পথ নির্ধারণ করতে হবে। এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেখানে লুটপাট ও দুর্নীতি থাকবে না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রকল্পের জন্য নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, নাগরিকদের জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষা-চিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি খাত তথা প্রাইভেট সেক্টরকে রাষ্ট্রীয় হয়রানিমুক্ত করতে হবে। এই খাতকে প্রতিযোগিতাবান্ধব জায়গায় নিয়ে আসতে পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে ব্যবসায়ীরা সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা করবেন। করের নীতি পরিবর্তন করতে হবে। সরকারি প্রকল্পগুলোতে অপচয় ও পাচারের মহামারি রোধে পরিকল্পনা জরুরি। এসব সংস্কার দুর্নীতি ও বৈষম্য রোধে সহায়ক হবে। এসব সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সুস্থ ধারায় ফেরানো সম্ভব হবে।

গত ১৫ বছরে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। দেশের টাকা বিদেশে পাচার রোধে কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করলে দেশের অর্থনীতি আরো প্রসারিত হবে। শেখ হাসিনার আমলে ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা জীর্ণশীর্ণ। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ব্যাংক-বীমা খাতে কঠোর নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বিদ্যমান ব্যাংক কম্পানি আইন, স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ আইন এবং মানি লন্ডারিং আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার। সংস্কার সম্পন্ন হলে এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামোগুলোতে সরকারের অন্যায্য হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ ও পাচার রোধেও কতগুলো আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার। অর্থনৈতিক আইন ও বিধি-বিধান সংস্কার করলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।

অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে বিপুল জনগোষ্ঠী যুক্ত। রাস্তার হকার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী থেকে এই খাতের বিপুলসংখ্যক পেশা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রাষ্ট্র ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তারা নিজেরাই নিজেদের অর্থনৈতিক সংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতির সুযোগে এই খাতে রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের চাঁদাবাজি চলছে। অথচ এই খাত নিয়ে সরকারের কোনো নীতি ও পরিকল্পনা নেই। এদের স্বীকৃতি ও প্রণোদনা দেওয়া দরকার। এই শ্রেণির ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে অর্থনীতির একচেটিয়াতন্ত্র অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

তথ্য-প্রযুক্তি ও জনশক্তি রপ্তানি খাতে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য যুবসমাজকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিলে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে  এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে।

বেসরকারি খাতেও বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ করছে। অথচ এখানে চাকরির নিরাপত্তা নেই, অন্য খাতের বিবেচনায় আয়ব্যবস্থায় সাম্য নেই। সরকারের উচিত এই খাতের জন্য বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যেন জনগণ সরকারি চাকরিকেই একমাত্র অবলম্বন মনে না করে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্বভাবতই শোষণ ও বৈষম্য নিহিত থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বদল না করেও আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে বৈষম্যের অবসান সম্ভব। নীতি ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে জনগণের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের মাধ্যমে বৈষম্য কমিয়ে আনা সম্ভব। রাজনৈতিক ক্ষমতার বিশেষ চরিত্রের জন্য আমাদের দেশে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যদি রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস বদলাতে পারি তাহলে বৈষম্যের অবসান সম্ভব। রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাস পরিবর্তন করলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা যাবে।

সারোয়ার তুষার, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি

বাংলাদেশ সময়: ১০০৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।