শাসন বদলায়, ব্যবস্থাপত্র বদলায় না। দুই যুগেরও বেশি সময়ের পেশাদার সাংবাদিকতার নির্যাস এটুকু।
দিন যায় কথা থাকে-এর মতো আমার সাংবাদিকতার চর্চাও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
‘আমিত্ব’ থেকে মুক্তির সুযোগ খেলাধুলা বিনোদনের অংশ। এর দিগন্তজুড়ে আনন্দ আর উৎসব। প্রিয় দলের হারের বেদনাও অবশ্য আছে।
তবে সেই বেদনাকে বিষণ্নতা গ্রাস করে না। এই যেমন ১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনালে মারাকানায় উরুগুয়ের কাছে অভাবিত হারের পর মনে হয়েছিল, ব্রাজিলে ফুটবলের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সেই ব্রাজিল এরপর পাঁচটা বিশ্বকাপ জিতেছে। এটাই খেলার আনন্দ।
আজ তুমি জিতেছ, ভালো কথা। তবে মনে রেখো, কাল তুমি হারতেও পারো। তাই সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকো—স্পোর্টসম্যানশিপের আপ্তবাক্য এটা।
এই খেলোয়াড়ি মনোভাবটাই আমাদের তৈরি হয়নি। ম্যাচ জিতে উঠে আসা খেলোয়াড়কে সীমাহীন তেজোদ্দীপ্ত দেখায়।
সংবাদমাধ্যম সমান তালে আবেগের স্রোত তৈরি করে। দর্শককুল সেই খরস্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। জয়ের পর কেউ মনেই রাখে না যে হার অবধারিত তোলা আছে ভবিষ্যতের কোনো একটি দিনের জন্য। সেদিন আবার সমান শক্তির উল্টো স্রোত। হারের পর মোটামুটি টেনেহিঁচড়ে ড্রেসিংরুম থেকে কাউকে উপস্থিত করা হয় মিডিয়ার সামনে। প্রশ্নবাণে জর্জরিত তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিগৃহীত হন নির্মমভাবে। সাফল্য-ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়ায় ওলটপালট সব দেশেই হয়ে থাকে। তবে ব্রাজিল থেকে নিউজিল্যান্ড, ভারত ঘুরে পাকিস্তান দেখেছি—সবার তুলনায় আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণহীন। এতে সমস্যা হয় কি, দেশের খেলাধুলার মান সঠিকভাবে অনুধাবনের শক্তি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এক সিরিজে পাকিস্তানকে ধবলধোলাই করা মানেই ভারতের বিপক্ষে জয়ের নিশ্চয়তা নয়। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট ও ওয়ানডেতে হারের পর টি-টোয়েন্টি সিরিজ কিন্তু জিতেছে বাংলাদেশ। এখন কোনটাকে মানদণ্ড হিসেবে ধরবেন আপনি? রাওয়ালপিন্ডিতে ‘ক্যুদেতা’র ‘আমিত্ব’ থেকে মুক্তির সুযোগ পর পাকিস্তানকে কি বাংলাদেশ বলেকয়ে হারাবে? নাকি ভারত অজেয়? কোনোটিই চূড়ান্ত নয়, ভারতের বিপক্ষেও জিতেছে বাংলাদেশ। ভারত কেন, নির্দিষ্ট দিনে যেকোনো দলকেই হারাতে পারে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
এটা বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বেলায়ও প্রযোজ্য। ট্রফি জেতা দল পরের ম্যাচেই হারতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কিংবা ওপরের সারির দলের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য আছে। চ্যাম্পিয়নরা বেশির ভাগ সময় হাসিমুখে মাঠ ছাড়ে। আর বাংলাদেশের বেলায় অপেক্ষায় থাকতে হয় সেই বিশেষ দিনটির জন্য। মোদ্দাকথা, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখনো শীর্ষ সারির দল হয়ে উঠতে পারেনি। এই না পারার পেছনে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের স্টেকহোল্ডারদের কমবেশি দায় আছে।
ক্রিকেটকেই উদাহরণ ধরছি। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ২০১৯ সালের আসর পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বর্ণসময় বলা যায়। যদিও ওই চার বছরে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ আর কিছু দ্বিপক্ষীয় সিরিজ ছাড়া কিছু জেতেনি বাংলাদেশ। তবে একটা বিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, বুঝি উন্নতির সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ। আদতে সে রকম কিছু ঘটেনি কারণ, মিরপুরের প্রতিটি জয়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস করেছে সবাই। কেউ এটা ভাবেনি যে এমন উইকেট বিশ্বের আর কোথাও মিলবে না। শীর্ষে পৌঁছতে হলে বিশ্বের সব প্রান্তে খেলার প্রস্তুতি নিতে হয়। সেসব হয়নি। বরং মিরপুরের সহায়ক উইকেটে পাওয়া জয়ে উটপাখির মতো মুখ গুঁজে ছিল সবাই। ফল যা হওয়ার তা-ই, অনভ্যস্ত কন্ডিশনে হঠাৎ বৃষ্টিতে চড়া মেকআপে মাখামাখি অবস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেটের! এমন পরিস্থিতিতেও তৎকালীন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান কোষাগারে হাজার কোটি টাকা আমানত থাকা নিয়ে যে বাগাড়ম্বর করতেন, তা সহ্য করা কঠিন ছিল।
ক্রিকেটের কথা বেশি বলছি কারণ, দেশের এই একটি ফেডারেশনেই খেলার মানোন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থকড়ি ছিল এবং আছে। দ্বিতীয় ধনী ফেডারেশন ফুটবল। তবে ক্রিকেটের সঙ্গে ব্যবধান বিস্তর। ফিফা, এএফসি কিংবা বিভিন্ন টুর্নামেন্ট থেকে পৃষ্ঠপোষকতা বাবদ যে অর্থাগম ঘটে, তা দিয়ে সাফ অঞ্চলের সীমানা ডিঙানো স্রেফ অসম্ভব। বাকি ফেডারেশনগুলোর অর্থব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা না করাই তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সম্মানজনক!
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, নিদারুণ অর্থকষ্টে ভোগা সেইসব ফেডারেশনের চেয়ারে বসতে আগ্রহীর সংখ্যা কখনো কমেনি। অসীম আগ্রহ সত্ত্বেও ফেডারেশনে অর্থাগম ঘটাতে পারেননি তাঁরা। তবে ফেডারেশনের পদ ব্যবহার করে রাজনীতি কিংবা ব্যবসার মাঠে জয়ী হয়েছেন। মাঝখান থেকে হারিয়ে গেছেন সত্যিকারের সংগঠকরা, যাঁরা স্রেফ ভালোবাসার সুতায় বাঁধা পড়েছিলেন খেলার মাঠে। তাঁরা হারিয়ে গেছেন, সঙ্গে নিয়ে গেছেন খেলার মাঠের নিখাদ আনন্দ। হারজিত ঘিরে তাই উগ্রতার ব্যারোমিটার ঊর্ধ্বমুখী।
এই সমস্যার সমাধান কী? চট করে উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে এটুকু বুঝি, ক্রীড়াঙ্গনে মানসিকতার সংস্কার অতি জরুরি।
এই সংস্কারের শুরুটা হতে হবে শীর্ষ থেকে। জুলাই-আগস্ট উত্তাল আন্দোলনের আগে ‘আমিত্ব’ গ্রাস করেছিল পুরো দেশকে। ক্রীড়াঙ্গন থেকে এই আমিত্বকে প্রথমে বিসর্জন দিতে হবে। বাংলাদেশ জিতলেই প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে বিশেষ কারোর আত্মতুষ্টির হাসি দেখানো বন্ধ করতে হবে। আপনার এই হাসির চেয়ে পূর্ব গ্যালারির রোদে পোড়া দর্শকের উচ্ছ্বাস অনেক বেশি অর্থবহ। আপনার কোষাগারে কোটি টাকা লুটোপুটি খায় রোদে পুড়ে খেলা দেখা দর্শকের কল্যাণেই। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নবনির্বাচিত সভাপতি তাবিথ আউয়াল এখন পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর অদ্যাবধি তীব্র প্রচারমুখী মনে হয়নি তাঁকে। সযতনে তিনি এড়িয়ে চলেন সংবাদমাধ্যমকে। একজন মুখপাত্রকে দায়িত্ব দিয়েছেন, যিনি নিয়ম করে বাফুফের হাল-হকিকত জানান মিডিয়াকে। অবশ্য বাংলাদেশের জল-হাওয়ায় এই ধারা তিনি কত দিন ধরে রাখতে পারেন, সেটি সময়ই বলবে।
পরিবর্তন এসেছে ক্রিকেট বোর্ডেও। এই প্রথমবার জাতীয় দলের সাবেক কোনো অধিনায়ক বিসিবির শীর্ষাসনে বসেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) বিধি-নিষেধের কারণে পূর্বতন বোর্ড ভেঙে দিতে পারেননি ফারুক আহমেদ। তবে পরিচালনা পর্ষদের সভায় টানা অনুপস্থিত থাকায় গঠনতন্ত্র মেনে অনেককে বাদ দিয়েছেন তিনি। আগের বোর্ডের যাঁরা এখনো আছেন, তাঁরা খুব স্বস্তিতে নেই বলেই খবর। মোটামুটি ‘ওয়ান ম্যান শো’ ফারুক আহমেদের বর্তমান বোর্ড। সেই একমেবাদ্বিতীয়ম স্বয়ং বোর্ড সভাপতি। একা হাতে একের পর এক পৃষ্ঠপোষক এনেছেন ফারুক, যা প্রশংসনীয়। তবে চলমান বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে নেবে বলে মনে হচ্ছে।
বিপিএলের ‘গা গরম’ করা থেকেই সেই পরীক্ষা শুরু ফারুকের। জমকালো আসরের প্রতিশ্রুতি দিতে যে কনসার্টের আয়োজন করেছেন, তা নিয়ে গম্ভীর আলোচনা হচ্ছে। এক ঢাকার আয়োজনের পেছনেই খরচ হয়েছে ছয় কোটি টাকারও বেশি। আমজনতা এরই মধ্যে অঙ্ক করে বলছে, যে টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন দলের অর্থ পুরস্কার দুই কোটি, সেই টুর্নামেন্টের পদধ্বনি শোনাতে এত ব্যয় কেন?
অবশ্য এবারের বিপিএল আদৌ লাভজনক হয় কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এবারের ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি, এমনকি পুরনো বকেয়া টুর্নামেন্ট শুরুর আগেও বুঝে পায়নি বিসিবি। বরং দুশ্চিন্তা আছে ভবিষ্যতে সেই বকেয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া নিয়ে। কারণ বেশ কটি ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেয় না। নিয়মানুযায়ী সেটি বুঝিয়ে দিতে হয় বিসিবিকে। এবারের বিপিএল পূর্বাভাস বলছে, খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক পরিশোধ নিশ্চিত করতে স্থায়ী আমানতের অংশবিশেষ ভাঙাতে হবে বিসিবিকে।
এই ব্যাপারগুলো আমিত্বের পথে প্রারম্ভিক যাত্রা। দীর্ঘ পেশাগত জীবনে ধুঁকে ধুঁকে এখন অন্তত এটুকু ‘অ্যান্টিসিপেট’ করতে শিখেছি। এসবের পরিবর্তন না হলে সংস্কারের যাবতীয় চেষ্টা বৃথা যাবে।
এখন প্রশ্ন একটাই—রক্ত দিয়ে পাওয়া সংস্কারের এই সুযোগ কি আমরা হেলায় হারাব?
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
এসএএইচ