কতোটা বৃদ্ধ কিংবা স্বার্থপর হলে তোর মতো একজন আদি ও অকৃত্রিম বন্ধুর জন্মদিন ভুলে যেতে বসি! জানি, তোর নশ্বর দেহ আর আমাদের মাঝে নেই, নেই সেই দিলখোলা হাসি, তবুওতো আমাদের সবার অন্তরে তোর থাকবার কথা। তবে কী আর বিশুদ্ধ নেই আমাদের আত্মা? পারিপার্শ্বিক পংকিলতা এতোটাই খেয়ে দেয়ে নষ্ট করে দিয়েছে আমাদের সবাইকে! দুনিয়ার সবার কাছে তুই মৃত হলেও আমাদের কাছেতো তুই জ্বলজ্যান্ত বর্তমান, তোকে ছাড়া কী আমাদের কোনো অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ হয়?
কামাল চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ ও আলী রীয়াজের সঙ্গে তোর সখ্য ও বন্ধুত্ব দেখে ঢাকা শহরে নবাগত আমি ঈর্ষাকাতরতায় ভুগতাম।
রুদ্র, অ-কবি সুলভ নামের প্রতি তীব্র এক প্রত্যাখান ছিলো তোর। কবিতার আঙ্গিনায় পা রাখা সবার নামের একটা কাব্যিক ‘আকিকা’ দেবার সহজাত প্রবণতায় আমার অতি দীর্ঘ নামটিরও যথারীতি একদিন আকিকা হয় তোর নেক জবানিতে। তুই-ই প্রথম রায় দিয়েছিলি, কবিতা আমাকে দিয়ে হবে না। কী নির্ভুল ছিলো সেই রায়! আমার গদ্যচর্চার চেষ্টা করা উচিত। সেই রায়ের বিস্তারিত বিবরণে আমাকে প্রায় এক বছরকাল অবিরাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কাটাতে হয়েছিলো। তোর আর রীয়াজের মিলিত মাস্টারিতে একসময় গদ্যে হাতেখড়ি ঘটে।
তবে আমাদের নৈকট্যটা নিবিড় বন্ধুত্বে রূপ নেয় `৭৯ সালে। তখন আমরা তোর আহ্বানে গড়ে তুলি ‘রাখাল’। কী অদ্ভুত তাই না? কবি মাত্রইতো রাখাল। আমাদের পথ চলায় পাশে এসে দাঁড়ায় সাহসী কবি মোহন রায়হান, সব সমস্যার সমাধানের মাস্টার সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন জ্যোতি আর নেপথ্য থেকে সব কাজ সামলানো নকীব ফিরোজ। আমাদের কল্পনাতীত আন্তরিকতা বিস্তৃত হয় ‘রাখাল’ থেকে গ্রন্হ প্রকাশে। এর আগে অবশ্য জীবনের প্রথম গদ্য ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রকাশিত হয় সামরিক শাসনবিরোধী সংকলন ‘স্বরূপ অন্বেষা’য়। সম্পাদকমণ্ডলীর উজ্জ্বলতম নামটি ছিলো তোর। ‘রাখাল’ থেকে সেরা চার লেখকের, মানে তোর, কামাল, রীয়াজ আর মোহনের গ্রন্হ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কী অজানা কারণে কামাল চৌধুরীর পাণ্ডুলিপি তৈরিতে জটিলতা দেখা দেয়। অন্য সবাইকে বাদ দিয়ে তুই আমাকেই বেছে নিলি। অফসেটে তখন চারটি রঙিন প্রচ্ছদ হলে ব্যয়সাশ্রয়ী হতো। তুই শর্ত দিলি, সব বইয়ের প্রুফ দেখবার জন্যে আমাকে পুরান ঢাকার মডার্ন প্রেসে সার্বক্ষণিক থাকতে হবে। তখন, আমি যে কোনো শর্তে রাজি। আমার যে বই বেরুচ্ছে! খ্যাতি তখন স্বপ্নের নাগালে!
আমাদের ক্ষুধার্ত দুপুরগুলোর একটা গতি করলেন প্রায়-প্রতিবেশী কবি রবীন্দ্র গোপের বিনয়ী সহধর্মিনী মাধবী গোপ। তোর প্রথম কাব্যগ্রন্হ ’উপদ্রুত উপকুল’র প্রথম ফর্মার প্রিন্ট অর্ডারের জন্যে তোর সামনে ফর্মাটা হাজির করলে, তুই নিমিষেই যেন কোথায় হারিয়ে গেলি। উদাস চোখে চেয়ে থাকলি দূর কোন অজানার দিকে। রীয়াজ আর মোহনের তাগিদে তোর ঘোর ভাঙলো, তুই ফাইনাল প্রুফের ওপর লিখলি, ‘মিনি, আমার বুকটা এতো দুরুদুরু করে কেনো, ছাপা হোক’। দীর্ঘদিন সেই কপিটা আগলে রেখেছিলাম। ভাড়া বাসা বদল আর দেশ বিদেশ করতে করতে নিজের গ্রন্হটির কপির সাথে সেটাও খুইয়ে বসেছি।
রুদ্র, আমাদের স্মৃতিগুলো লিখলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ শেষ হয়ে যাবে। ভেতরে চেপে রাখা শোক আর কষ্টের উদগীরণ ঠেকানো বেশ কঠিন হচ্ছে। তোকে নিয়ে লেখার মতো যোগ্য আমি নই। তোর স্মৃতি নিয়ে প্রকৃত অর্থে লিখতে পারে কবি কামাল চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ, আলী রীয়াজ, মোহন রায়হান ও বদরুল হুদা সেলিম। আরো পারে কবি রেজা সেলিম ও তুষার দাশ।
আমি কেবল তোর অন্ধ অনুকরণ করে বলতে পারি, `রুদ্র, বুকটা এমন দুরুদুরু করে কেনো?’ যেখানেই থাকিস নিশ্চয় শব্দ-শ্রমিকের মর্যাদায় কাব্যপ্রেমেই মজে আছিস। তুই ভালো আছিস জেনেই, ‘আকাশের ঠিকানায় চিঠি’ দিলাম।
ই-মেলঃ [email protected]
এমএমকে; সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]