ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ প্রতিবন্ধী প্রসঙ্গে

শাখাওয়াৎ নয়ন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১২
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ প্রতিবন্ধী প্রসঙ্গে

প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশে কমপক্ষে সত্তর লাখ থেকে এক কোটি চল্লিশ লাখ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ আছে। শারীরিক প্রতিবন্ধীসহ বাক, দৃষ্টি, শ্রবণ এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সারা পৃথিবীতেই আছে।

কিন্তু এই প্রতিবন্ধিত্বের হার এবং সংখ্যা ধনী দেশের তুলনায় গরিব দেশে অনেক বেশি। কুসংস্কার, পুষ্টিহীনতা, গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার দৈন্য, নানা রকম রোগ-ব্যাধি এবং সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আমাদের দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়। এরই মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতির ফলে এবং পুষ্টিহীনতা দূরীকরণ, গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং টিকাদান প্রকল্প সমূহের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে আশাব্যঞ্জক সফলতা দেখা গেছে। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবন্ধিতার হার এবং সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো গেলেও সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা রকম দুর্ঘটনা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা-কুসংস্কার থেকে এখনো রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না।

অজ্ঞতাবশত অথবা কুসংস্কারের কারণে বাংলাদেশে অনেক মানুষ প্রতিবন্ধিতাকে ব্যক্তির কিংবা তার পরিবারের প্রতি অভিশাপের ফল বলে মনে করে। প্রতিবন্ধীরা পরিবার এবং সমাজের কাছ থেকে নানা রকম অবহেলা, বঞ্চনা, বৈষম্য, নিপীড়নের শিকার হয়। যেমন, বিবাহ-শাদীতে পরিবারের প্রতিবন্ধী সদস্যদের নতুন অতিথিদের সামনে আসতে দেওয়া হয় না, কিংবা তাদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। পাছে বিয়ে ভেঙ্গে যায়। আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীরা মুলত: লালিত-পালিত হয় মা কিংবা বোনের কাছে। যাদের মা-বোন থাকে না তারা মানবেতরভাবেও বেশিদিন বেঁচে থাকার সুযোগ পায় না। মায়ের মতো সেই মমতাময়ী বড় বোনের বিয়ের সময় প্রতিবন্ধীদের রাখা হয় আড়ালে। তারপর একদিন বিয়ের পরে সেই বোন শ্বশুরবাড়ি চলে যায় আর প্রতিবন্ধী ছোট ভাই-বোন বন্ধ ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মমতাময়ী বোনটি শ্বশুরবাড়িতে যাবার আগে এক ফাঁকে এসে প্রতিবন্ধী ভাই-বোনটিকে জড়িয়ে ধরে। পরস্পর কাঁদে। সেই কান্না কেউ দেখে না।

আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সকল সুযোগ সুবিধার বাইরে রাখা হয়। প্রতিবন্ধীরা খুব একটা নিমন্ত্রিত হয় না, যখন পরিবারের সবার দাওয়াত থাকে তখনও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের নিয়ে যেতে চায় না, কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় না। যেহেতু তারা ঘরের বাইরে যাওয়ার তেমন সুযোগ পায় না সেহেতু তাদের কোনো বন্ধু কিংবা খেলার সাথী গড়ে ওঠে না। এক কথায় তাদের সব ধরনের সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। পরিবারের দুই একজন সদস্য ছাড়া তাদের দেখারও তেমন কেউ থাকে না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশীয় সমাজে পুরুষ প্রতিবন্ধীদের চেয়ে নারী প্রতিবন্ধীরা বেশি কষ্টে জীবনযাপন করে। প্রতিবন্ধীদের যেমন কোনো সামাজিক জীবন নেই তেমনি রাজনৈতিক জীবনও নেই। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছাড়া অন্য প্রতিবন্ধীরা ভোটার হলেও রাজনীতিতে তাদের কোনো গুরত্ব নেই। তাদের কাছে কেউ ভোট চায় না, তাদের সমস্যা নিয়েও কেউ ভাবে না। যেহেতু তারা সংখ্যায় কম তাই তাদের সমস্যা কখনও রাজনৈতিক ইস্যু হয় না। তাদের জীবনমানের উন্নয়নে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামরিক বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনই দেয় নি। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো নেই। ফলে যেসব প্রতিবন্ধী অন্য ছেলে মেয়েদের সাথে একই স্কুলে যায়, তারা সহপাঠীদের নানা রকম অসহযোগিতায়, যন্ত্রণায় এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত ভুমিকার অভাবে ও ক্ষেত্রবিশেষে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়ে স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সমাজ তাদের বোঝা মনে করে। রাষ্ট্র তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে না। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রতিবন্ধীরা কারো বোঝা নয়। কারণ উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা হয়ে ওঠে সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ। তাদের ভুমিকাও হয়ে উঠে জাতীয় অর্থনীতিতে, সমাজে উল্লেখযোগ্য।

আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য যে সব প্রকল্প এবং কর্মসূচি আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্য। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে অতি প্রয়োজনীয় সেই তথ্যও নেই। উদাহরণস্বরুপ যদি বলি, কেউ কি জানেন বাংলাদেশে কত জন বাকপ্রতিবন্ধী মানুষ আছে? কিংবা শ্রবণপ্রতিবন্ধী? অনেক চেষ্টা করেও জানা সহজ নয়। শুধু প্রতিবন্ধীদের মোট সংখ্যার একটা ১০ বছরের পুরাতন তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে দু`চার জন প্রতিবন্ধী নেই। দেশে এত আদমশুমারি, পশু-পাখি শুমারি হয় কিন্তু প্রতিবন্ধীদের হিসাব কেউ ঠিকমত রাখে না। বাক প্রতিবন্ধীদের  মধ্যে যারা কথাই বলতে পারে না তাদের আমাদের সমাজে বোবা বলে চিহ্নিত করা হয়। আর যাদের জিভে আড়ষ্ঠতা আছে কথা ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না, তাদের `তোতলা` বলে চিহ্নিত করা হয়। কেউ `থোতা` বলে গালিও দেয়। যার পায়ে সমস্যা তাকে `খোঁড়া`, ল্যাংড়া বা লুলা, যার চোখ নেই তাকে `কানা`, যার উচ্চতা কম তাকে `বাটু` বা ‘বাটকু’ বলা আমাদের সামাজিক অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এইসব শব্দের মাধ্যমে আমরা কি ভয়ংকর কষ্টই না দিচ্ছি তাদের, তাদের পরিবারের সদস্যদের। এই প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং মিডিয়া মোটেও সহানুভুতিশীল নয়। বরং কখনও কখনও চরম নির্দয়, নিষ্ঠুর এবং অমানবিক ভুমিকায়ও অবতীর্ণ।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিভিন্ন রকম নাটক প্রচারিত হচ্ছে। নাটকের বিষয়, নির্মাণ, পাত্র-পাত্রী নিয়ে কিছু নাইবা বললাম কিন্তু নাটকের নামে অসুস্থতা, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতার বিষয় নিয়ে কিছু না বললেই নয়। বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত বিভিন্ন ধারাবাহিক এবং একদিনের নাটকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী চরিত্র দেখানো হয়। প্রতিবন্ধী চরিত্রগুলোকে কৌতুকের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। মানুষ হাসানোর কি আর কোনো উপায় নেই? আমাদের সমাজে যেখানে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধীরা নানা রকম নিপীড়নের, অবহেলার শিকার হচ্ছে সেখানে টেলিভিশনে প্রচারিত এই সব নাটকের মাধ্যমে লাখ লাখ প্রতিবন্ধীসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের কষ্ট দেয়ার মানে কি? যেখানে মিডিয়াগুলো প্রতিবন্ধী-সহায়ক অনুষ্ঠান প্রচার করবে সেখানে তারা প্রতিবন্ধীদের সমাজে হাসির পাত্র বানাচ্ছে। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এই ধরনের নাটক প্রচার করার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। অভিনেতারা কেন ঐসব চরিত্রে অভিনয় করছেন? বিষয়টি আমাদের কাছে পীড়াদায়ক এবং বিস্ময়কর। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য রেডিও, টেলিভিশন ছাড়া চিত্ত বিনোদনের আর কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আমরা যদি দেশের লাখ লাখ প্রতিবন্ধীর আনন্দ বিনোদনের একমাত্র গণমাধ্যমকে তাদের জন্য দু:খ কষ্টের মাধ্যমে পরিণত করে ফেলি, তাহলে তারা কোথায় যাবে বলুন? সুতরাং প্রতিবন্ধী চরিত্র সৃষ্টি করে গণমাধ্যমে কৌতুকের নামে মানুষের মনে কষ্ট দেওয়ার অসুস্থ, হীন তামাশা বন্ধ করুন, প্লিজ। ভুলে যাবেন না, এক কোটি প্রতিবন্ধী কারো না কারোর  ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ে বা আত্মীয়-স্বজন। আপনারা কার সাথে এমন অসুস্থ রসিকতা করছেন?


লেখক: অস্ট্রেলিয়া-প্রবাসী

[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৯ ঘণ্টা, ১৬ অক্টোবর, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।