ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ফরমালিন আর কেমিক্যালমুক্ত সমাজ চাই

আদনান সৈয়দ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১২
ফরমালিন আর কেমিক্যালমুক্ত সমাজ চাই

ঢাকা: আমি থাকি নিউইয়র্কে। ভাবলাম এবার লম্বা ছুটিতে বাংলাদেশে গিয়ে কিছু তাজা মাছ মাংস, ফলমূল -শাকসবজি খাওয়া যাবে।

কিন্তু বিধিবাম! গত মাস দুয়েক যাবৎ ঢাকার আনাচে কানাচে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে একটা ভালো পেঁপেঁ কেনার সৌভাগ্যও আমার হয়নি।

কি অদ্ভূত ব্যাপার!  দেখতে শুনতে বাইরে থেকে এই পেঁপে নামের বস্তুটা এত সুন্দর দেখায় অথচ ভেতরটা একেবারেই অন্যরকম। বোঝাই যাচ্ছে যে অপরিপক্ক থাকা অবস্থাতেই এই ফলটাকে গায়ের জোরে পাকানো হয়েছে। জানি, আপনারা অনেকেই বলবেন ” এ আবার নতুন কি ! এই দেশে একটা ফল কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হবে আর আমরা  তা চোখ বুঁজে নিশ্চিন্ত মনে খাবো এটাইতো স্বাভাবিক!”

সেদিন টিভিতে একটি অনুষ্ঠান দেখে রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। ছয় মাসের আনারস কিভাবে তিন মাসে পাকানো যায় প্রতিবেদনটি ছিল এ নিয়ে। এক আনারসচাষী খুব শান্ত গলায় অনেকটা গর্বের সঙ্গেই আনারসের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে এর জন্য কি ধরনের রাসায়নিক বস্তু তাতে তিনি মেশাচ্ছেন তার এক প্রাঞ্জল বর্ণনা দিলেন। সেই একই টিভি অনুষ্ঠানে আরেকটি ভয়াবহ রকম তথ্যও শুনতে পেলাম। পৃথিবীর সব দেশেই কোলন ক্যান্সার সাধারণত পঞ্চাশ উর্ধ্ব মানুষের হয়ে থাকে কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন এই কেমিক্যালযুক্ত খাবারের কারণে এখন ত্রিশ বছর বয়সেই বাংলাদেশের মানুষ কোলন ক্যান্সারের শিকার হচ্ছেন। কি ভয়াবহ রকম তথ্য! কিন্তু না, আশেপাশের সব কিছু দেখে শুনে মনে হয় এই সব কেমিক্যাল টেমিকেল আর ফরমালিন শব্দগুলো যেন আমাদের একেবারেই গা-সওয়া হয়ে গেছে।

একটি মাছে ফরমালিন থাকবে আর বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত ফলমূল অথবা শাক-সবজি আমরা নির্দ্বিধায় পাকস্থলিতে হজম করব---এটা এখন যেন এক মামুলি ব্যাপার। আমরা প্রতিদিন সকাল বেলা মনের আনন্দেই বাজারে যাচ্ছি আর বাজার থেকে ব্যাগভর্তি বিষাক্ত মাছ, তরিতরকারি, ফলমূল কাঁধে নিয়ে ঘরে ফিরছি।

আমেরিকায় দেখেছি সেখানকার মানুষজন কি ধরনের খাবার খাচ্ছেন সে নিয়ে দেশটির সরকার খুব বেশি রকমই সজাগ। শরীরের জন্য অনিষ্টকর কোনো খাবার যেন একজন মানুষও খেতে না পারে সেজন্য স্থানীয় প্রশাসন খুবই সজাগ।

কোনো মুদির দোকানে অথবা রেস্তোরাঁয় যদি পুরনো বা বাসি হয়ে যাওয়া খাবারের খোঁজ পাওয়া যায় তাহলে সেই দোকান বা রেস্তোরাঁ মালিকের কপালে যে দুর্ভোগ আছে  তা চোখ বুঁজেই বলে দেওয়া যায়। মেয়াদ পেরোনো কোনো খাবার বিক্রি করা বা পরিবেশনা করা আমেরিকার ”খাদ্য ও পানীয় প্রশাসন” বিভাগের আওতায় একটি ”ফেডারেল ক্রাইম” হিসেবে বিবেচিত। সেক্ষেত্রে ভেজাল খাবার পরিবেশনকারি দোকানিদের জেল-জরিমানা থেকে শুরু করে ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল, সেইসব ব্যবসায়ী যাতে আর অন্য কোন ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে না পারে, অথবা কালো তালিকা করে এসব অসাধু ব্যবসায়ীর নাম জনগণের সামনে স্থানীয় গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করাসহ বিভিন্নরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও ভেজাল খাবার পরিবেশনকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ভেজালবিরোধী অভিযানের কথাও কানে আসে। ভেজালকারীদের মোটা অংকের টাকা  জরিমানাও করা হচ্ছে। কিন্তু এর ফল কতটুকু হচ্ছে সেটাই হল ভাববার বিষয়। ”

মাছে ফরমালিন আছে কিনা তা যাচাই করার জন্য আমরা প্রায় সময়ই বিভিন্নরকম ছোটবড় শপিং সেন্টারে বিনা নোটিসে অভিযান চালাই। আমাদের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট থাকেন, আইনের লোকজনরাও থাকেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের তখনই বিচারের আওতায় আনা হয়।

কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের মাছ খুব শিগগিরই ফরমালিনমুক্ত হয়ে যাবে। মানুষের নৈতিক চরিত্র না বদলালে এর থেকে পরিত্রাণের কোনোই উপায় আমাদের হাতে নেই। ” কথাগুলো বললেন ঢাকা জেলার মৎস বিভাগের পরিচালক ড. সৈয়দ আলি আজহার।

ফরমালিন মিশিয়ে মাছকে তাজা রাখা, পেট্রল দিয়ে চানাচুর ভাজা, মিষ্টি বানানোর দুধের কিমার সঙ্গে টিস্যু পেপার মেশানো এখন যেন একেবারেই দুধভাত। আপেল, কমলা, কলা, আম, পেঁপে, আনারসসহ প্রায় সব ফলই এখন বিষাক্ত কেমিক্যালের সৌজন্যে পাকানো হচ্ছে। সেদিন এক বন্ধু বললেন, তিনি নাকি এখন আর কোনো রকম ফল ফলারির কাছেও যান না।

‘‘যদি চোখের সামনে গাব অথবা আমড়া পাই তখন সেটা খাই। ” তার বিশ্বাস এই সস্তা ফলগুলো হয়তো আর যাই হোক কেমিক্যালমুক্ত থাকবে। এই কিছুদিন আগেও বিষযুক্ত লিচু খেয়ে তেরটি শিশুর প্রাণ চলে গেল। এই সব বিষ মেশানো খাবারের পাশ্ব প্রতিক্রিয়ায় এরই মধ্যে মানুষজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালমুখি হচ্ছেন। গোটা বিশ্বে যখন পরিবেশ সচেতনতার প্রভাবে মানুষের গড় আয়ু দিন দিন বাড়ছে সেখানে বাংলাদেশের মানুষ এই  ভেজাল খাদ্যের রাসায়নিক বিক্রিয়ার কুফল হিশেবে বয়স ত্রিশ ছুঁতে না ছুঁতেই কোলন ক্যান্সারের মত জীবননাশক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই নাজুক পরিস্থিতি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ প্রয়োজন।

দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি এবং আইন প্রয়োগের পাশাপাশি এই ফরমালিন এবং বিষাক্ত রাসায়নিক বস্তুগুলোর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। একটি ফরমালিনযুক্ত মাছকে কিভাবে ফরমালিন মুক্ত করা যেতে পারে অথবা মাছটিতে ফরমালিন আছে কি না এর যাচাই-বাছাই পদ্ধতিটি একজন নাগরিক এর হাতের মুঠোয় থাকা খুব জরুরি।

যে কোনো ফল-ফলারি বা শাক-সবজি থেকে কিভাবে বিষাক্ত কেমিক্যাল দূর করা যায় সে বিষয়ে একজন নাগরিকের সাধারণ জ্ঞান থাকা খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশে এই মুহুর্তে প্রয়োজন ফরমালিন আর খাবারে বিষাক্ত কেমিক্যালমুক্ত এক সমাজ গড়ার মহান বিপ্লব।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে একটি সুস্থ জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন সুস্থ মানুষ।

আদনান সৈয়দ; লেখক, অ্যাকটিভিস্ট  [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।