স্নাতক ৩য় বর্ষে পড়ছি। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে।
স্বপ্ন দেখতে কোনো টাকা-খড়ি খরচ করতে হয় না; তাই শৈশব থেকে মিডিয়ায় কাজ করার স্বপ্ন দেখছি। এমন কাজ করার স্বপ্ন দেখছি যাতে আমার মা-বাবা গর্ব করতে পারেন- এ আমার সন্তান!
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। কতটা সংগ্রাম করে একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এতদূর এসেছি তা মধ্যবিত্ত সমাজের কোনো সন্তানই বুঝতে পারবেন। ২ ভাই ১ বোনের মধ্যে মেজো হলেও নিয়তির উপহারে এখন মা-বাবার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন আমাকে ঘিরেই।
শরীর-স্বাস্থ্য এমনিতেই ভালো না। সম্প্রতি চোখের পাতাগুলোও যেন বন্ধ হওয়া ভুলে গেছে।
এবারের রমজানের ঈদে বাড়ি থেকে আসার সময় আম্মু বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন; আর ক’বছর? (উনি পড়াশোনা শেষ হতে আর ক’বছর তাই জানতে চেয়েছেন- কারণ উনি বিশ্বাস করেন; পড়ালেখা শেষ হলে আমি পরিবারের হাল ধরবো যেটা এখন প্রায় ৫০ বছর বয়সী আমার জনকের কাঁধে)। আমি বললাম; এইতো আর ১ বছর! (আমি উনাদের আশা দিয়ে রেখেছি- অনার্স শেষ হলেই ন্যূনতম বেতনে হলেও একটা চাকরি পাব। ) পাশে থাকা বড় খালা বললেন; তোর এক বছর কবে শেষ হবে? সেই কবে থেকে শুনছি! আম্মু কোনো কথা বললেন না। আমিও খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থাকলাম। তারপর বিদায় নিয়ে চলে এলাম!
ঢাকায় আসার পর প্রতি রাতেই মাথায় শুধু চিন্তা- কী করেছি, কী করছি? আর কী করতে পারবো?
পাশের কিছু বন্ধু-বড়-ছোট ভাইয়ের দিকে চাইলে নিজেকে বড় বেশি অকর্মা মনে হয়। কেউ টিভি চ্যানেলে সংবাদ প্রতিবেদক, কেউ দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রিকায়, কেউবা অনুষ্ঠান প্রযোজক, নাটকের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছে? অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিতদের কাতারে চলে গেছেন।
আমি? মা-বাবাকে স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের এখনো শুধু রাস্তা খুঁজছি?
পরে আবার পাশে থাকা অন্য পক্ষের কথা চিন্তা করে নিজেকে একেবারে পৃথিবীর বোঝা মনে হয় না। কারণ; কোনো মামা-চাচা-বড় ভাইয়ের সহযোগিতা ছাড়াই আমি দু’দুটো সাহিত্যের লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছি। যা শুধু আমার ব্যাচের নয়; পুরো ডিপার্টমেন্টেই এখনো কেউ করতে পারেনি।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো চষে বেড়াচ্ছি, যা আমার অনেক বন্ধু-বড় ভাইকে হা করে দেখা লাগে।
যুগান্তরের ঘরে বাইরে পাতায় নিয়মিত প্রদায়ক হিসেবে কাজ করছি প্রায় দেড় বছর। অ্যাসাইনম্যান্ট দেরি করে দেয়া ছাড়া বিভাগীয় সম্পাদক অন্তত অন্য কোনো কারণে বকা দেননি। খুব ভালো না হলেও মোটামুটি মানে কিছু ফিচার লিখছি যা পড়ে আমার অনেক বন্ধুকে এখনো জিজ্ঞেস করতে হয়; এগুলো ক্যামনে লিখিস?
কিন্তু আবার যখন বাস্তবতা ভাবি; এভাবেতো আমার মা-বাবা কে দু’বেলা খাওয়াতে পারব না। তাঁদের চাঁদমুখো হাসি ধরে রাখতে তো স্থায়ী চাকরি দরকার। আর চাকরি বলতে তো মিডিয়া ছাড়া আমার জন্য কোনো ক্ষেত্র নেই, আর মিডিয়াই যে আমার স্বপ্ন!
কিন্তু মিডিয়ায় কাজ করতে হলেতো আগে-
* অভিজ্ঞতা দেখাতে হবে।
* মামা, চাচা, বড় ভাইয়ের `ভিআইপি` ফোন লাগবে।
বন্ধু-বড় ভাই- ছোট ভাই সবারই খোঁজ নিয়ে দেখেছি- ‘ইজম’ আর মামা-চাচা-বড় ভাই`র ‘ফোন’ তাদের চাকরি পাওয়া সহজ করে দিয়েছে। (সহজ না বলে ওই ফোনই চাকরি পাইয়ে দিয়েছে বললে বোধ হয় সঠিক হবে)।
পত্রিকায় কাজের অভিজ্ঞতা মোটামুটি থাকলেও মামা, চাচা, বড় ভাইতো নেই! তাহলে?
এ দিকে খুব কাছের এক বন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী কানে বাজে প্রতিনিয়ত; লিটলম্যাগ বা সাহিত্য চর্চা যারা করে তারা জীবনে কিছুই করতে পারে না! ওই কবিতা, গল্প, সাহিত্য নিয়েই পড়ে থাকতে হয়!
আরেকজন বন্ধু এই অকর্মার অক্ষমতাকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল; কয় বছর ধরে যুগান্তরে কাজ করছিস। এখনো একটা স্থায়ী কিছু করতে পারিসনি। কী পারবি তুই?
আসলেই তো কী পারবো আমি? না পারলে...?
ভবিষ্যতের দিনগুলোকে হৃদয়পটে ভাসানোর চেষ্টা করি। দেখি;
* আমার মা নিষ্কর্মা ছেলের কথা ভেবে-কেঁদে দু’চোখের পাড় কালো করে ফেলেছেন।
* আমার বাবাকে গ্রামের লোকেরা বলছেন; বিদেশ না পাডাইয়া ফাউ পড়ালেহা করাইছস। পোলাডার সময়ও নষ্ট করলি। নিজেও কষ্ট করতাছস। এসব শুনে আমার বাবা কাঁদছেন বোবা শিশুর মতো।
* চাকরির জন্য কোনো মিডিয়া হাউসে গিয়েছি। ‘কোথায় কাজ করেছিস? ধূর!’ কোনো ভিআইপি ফোন করেনি বলে এভাবেই ‘উদ্ভট ঝামেলা’কে তাড়িয়ে দেবেন কর্তা ব্যক্তিরা। নিজ থেকে কারও কাছে আবেদন করলে হয়তো ‘খালি নেই’ বলবেন। কারণ, ভিআইপি কেউ ফোন করেনি। আবার ভিআইপি কেউ ফোন করার কারণেই কোনো প্রাইভেট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষের ছেলেকে যথেষ্ট টাকা বেতনে চাকরি দিয়ে দেবেন সেই কর্তাব্যক্তি।
* এ দিকে আমি নিরন্তর ছুটছি- এ হাউজ থেকে ও হাউজ। পত্রিকা অফিস থেকে টিভি অফিস। অন্য দিকে মা-বাবা ছেলের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেঁদে চলেছেন।
* কোনো অফিসে ইন্টারভিউতে ডাকলেও নানা অজুহাত দিয়ে বিদায় করে দেবেন। আমি ভাবব ‘ভিআইপি’ ফোন না আসায় চাকরিটা হয়নি। তারপর শান্ত মাথাটা হঠাৎ অশান্ত হয়ে যাবে। কাগজ-পত্র নিয়ে এক দৌড়ে রাস্তায় নেমে আসব। ব্যস্ততার শহরে রাস্তা পেরোতে গিয়ে ভিআইপি গাড়িগুলো তাদের `ভিআইপি সময়`র অভাবে ব্রেক কষতে ভুলে যাবে! আর আমি…!
পরিচিত-জনরা বলবে; যাক! অকর্মাটা বিদায় নিল। আম্মু-আব্বু ভাববেন আমি কোনো কিছু করতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছি! আমাকে পেটে নেয়ার ‘অপরাধ’-এ আম্মু কাঁদবেন, হয়তো শান্ত নদী বইবে তাঁর স্বপ্নহারানো দু`টি চোখে। পাথরচাপা কষ্টে বাবার বুকও পাথর হয়ে যাবে, কাঁদবেন না তিনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে হয়তো মুখ আওড়াবেন!
কাঁচভাঙার মত তাঁদের স্বপ্ন ভাঙতে দেখে আমিও ওপার থেকে কাঁদতে থাকবো ঝড়ের রাতের নীড় ভাঙা পাখির মতো!
আবার ভাবি।
না, ধূর! কেন কাঁদবো আমি! কেন কাঁদাবো আমার বিশ্বকে, আমার মা-বাবাকে! কেন ভাঙবো আমার মা-বাবার স্বপ্নগুলো।
গাড়ির চাপা পড়ে আমি আত্মঘাতী হবো না!
কারণ; আমি আমার মা-বাবাকে ভালোবাসি! ভালোবাসি এ সুন্দর পৃথিবীকে!
হতাশার কী আছে? আমি এখন কিছু করতে না পারি। ক’দিন পর পারবো! ক’ সপ্তাহ পর পারবো, ক’মাস পর পারবো কিংবা ক’বছর পর! আমাকে যে পারতেই হবে!
আমি আমার জন্য নয়; আমার মা-বাবার স্বপ্ন গড়তে স্বপ্নপূরণকর্তার কাছে সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করেছি। উপরওয়ালা শুধু এজন্যই আমাকে সহযোগিতা করবেন! যদি তিনি সহযোগিতা না করেন তবে পরজন্মে আমিই তাঁকে জিজ্ঞেস করবো; ‘কেন গড়তে দাওনি আমার মা-বাবার স্বপ্ন?’
আমার মা-বাবা জীবিত থাকাবস্থায় আমি যদি তাঁদের মুখে নির্মল-উচ্ছল হাসি ফোটাতে না পারি তবে…!
সেই সিদ্ধান্ত… আপাতত থাক!
শিক্ষার্থী :
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
Email : [email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]