ব্যবধানটা ৩৪ বছরের। অনেকেরই মনে থাকার কথা।
রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনই হোক বা কোটা বিরোধী আন্দোলনই হোক, দুটোরই মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে আনা। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
তবে '৯০ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে অতি দ্রুত সময় অর্থাৎ তিন মাসের মধ্যে এটা করা সম্ভব হয়েছিল। তখন সবই হয়েছিল তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী। ওই সময় আন্দোলনরত ৭ দল, ৮ দল ও বাম রাজনৈতিক ধারার ৫ দল নিয়েই তিন জোটের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছিল। তিন জোটের রূপরেখা সামনে দিক নির্দেশনা দিয়েছিল বলেই সব কাজ সহজ হয়েছিল। কিন্তু ২৪- এর আন্দোলনের আগে তেমন কোনো রূপরেখা সামনে ছিল না। পতিত সরকারের অত্যাচার নির্যাতন, জুলুম, হত্যা, গুম, মামলা, হামলা ইত্যাদি কারণে মানুষ ছিল দিশেহারা। রাজনৈতিক দলগুলোতে ছিল এক ধরনের নীরব অস্থিরতা। ফলে দীর্ঘ দেড় দশকে আন্দোলন যেমন ছিল বিচ্ছিন্ন ও খাপছাড়া। অপরদিকে, পতিত সরকার সুকৌশলে কিছু সুবিধাভোগী বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের তুঙ্গে ওঠা আন্দোলন স্তিমিত করার দায়িত্ব দেওয়া হতো। তারা সেসব দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতেন। ফলস্বরূপ ফ্যাসিস্ট শাসন দীর্ঘায়িত হয়েছিল- এমন কথা আগেও বলা হতো, এখনো বলা হয়। এমন সব কারণেই রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম যেমন বার বার খাবি খেয়েছে, মাঝে মাঝে ভোকাট্টা হয়েছে। তাই হয়তো ৯০ সালের মতো কোনো রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনে চলাকালে বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি বেশ কয়েকবার তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দলটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে। এর মাঝে ২৭ দফা ও ৩১ দফা অন্যতম। কিন্তু এসব প্রস্তাবনায় সরকার পতন হলে বা চলে গেলে কি আঙ্গিকে দেশ পরিচালিত হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। তা না থাকারই কথা। দলটি অত্যাচার নির্যাতন, গুম-খুনের যন্ত্রণায় ছটফট করছিল শেষ দিন পর্যন্ত।
আর কয়েকদিন পর অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নয় মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে। অথচ যে একটি গণতান্ত্রিক সরকার চাওয়া ছিল তা এখনো পূর্ণ হয়নি দেশবাসীর। কবে নির্বাচিত সরকারের কাছে শাসনভার যাবে তা এখনো কেউ জানে না।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ ছিল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ন্যূনতম সংস্কার-পরবর্তী সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। সে আয়োজনের পথে তারা প্রকৃতপক্ষে অগ্রসর হচ্ছেন কি না কিংবা কতটুকু আগ্রহী তা সামনের দিনে বোঝা যাবে। অন্তর্বর্তী সরকার এমনভাবে এগোবে যাতে জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে না হয়। অনিশ্চয়তা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের আগামী দিনের কর্মসূচি ও কার্যাবলির ওপর দেশের ভাগ্য নির্ভর করছে।
এখন নির্বাচনের মাঠে প্রবেশ করছে টাকাওয়ালা, দুর্বৃত্ত, দখলবাজ, মাফিয়া, হোন্ডা নিয়ে মহড়া দেওয়া প্রভাবশালী মহল, যারা নির্বাচনকে একটি ব্যবসায়িক বিনিয়োগ হিসেবে দেখে। কিন্তু দেশের মানুষ এখন এসবের বাইরে গিয়ে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিকে দেখতে চায়—যে তাদের অধিকার, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনের প্রতিনিধিত্ব করবে। এ ধরনের একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটা প্রস্তুত তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর সংশয়। ভুলে গেলে চলবে না, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের যথাক্রমে রাতের ভোট ও ডামি ভোটের দায়িত্ব পালন করা প্রশাসনের চিহ্নিত মাস্টার মাইন্ড কর্মকর্তারা এখনো সরকারেই আছে। আছে ফ্যাসিস্টের হাতিয়ার হয়ে হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের গুম-খুন, মামলা-হামলার নাটের গুরু নিরাপত্তা বাহিনী চিহ্নিত সদস্যরা, আওয়ামী শাসনের দীর্ঘ সময়ে ও জুলাই আগস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে যে সব অস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল সেগুলো এখনো তাদের হাতেই রয়েছে। এদের জায়গামতো রেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য করতে পারবে- তা হয়তো অনেকেই ভেবে দেখেননি। জুলাই-আগস্টে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু না করে নির্বাচন অনুষ্ঠান কতটা সমীচীন সেদিকেই ভাবতে হবে। এর রক্ত, এত জীবনদান শুধুই কি নির্বাচনে সমাধান? এ প্রশ্নও জোরালো হচ্ছে।
এদিকে, নিন্দুকেরা নানা কথা বলছে, ধর্মীয় রাজনীতির অন্যতম দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এখনো দলীয় নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পায়নি। পাশাপাশি কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এনসিপি রাজনৈতিক দল হিসেবে এখনো জনমনে স্থান করে নিতে পারেনি। এ দু'টো দলকে বাইরে রেখে সরকার নির্বাচনী রোড ম্যাপ ঘোষণা করবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
নিবন্ধনের শুরুতে দুটো বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা ছিল। একটি হলো ৯০- এর আন্দোলন ও দ্বিতীয়টি তিন জোটের রূপরেখা। নব্বইয়ের আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী তৎকালীন ছাত্র নেতৃবৃন্দ এরশাদ বিদায়ের পর জাতীয় রাজনীতিতে অতটা সক্রিয় হননি। ২/৩ জন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। মূলত তারা ভ্যানগার্ডের ভূমিকা পালন করার চেষ্টায় রত ছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে পারেননি। তবে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও মূল রাজনৈতিক শক্তিসমূহ অনেক কাজের বাধা ছিলেন সেই অগ্নিঝরা দিনের সোনালী ফসল ছাত্র নেতৃবৃন্দ। যদিও সময়ের ব্যবধানে সে সময়ের প্রথম সারির ছাত্র নেতারা পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দেখান। কিন্তু ৩৪ বছর পর এসে ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনে বিজয়ের পর ছাত্র বা শিক্ষার্থীরা ক্ষমতার ভাগীদার হয়ে গেলেন। রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। নানা অপকর্মের মাধ্যমে বিতর্কে জাড়িয়ে গেলেন। রাজনৈতিক দলগুলেকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলা শুরু করলেন। ফলে সমালোচনায় জর্জরিত হচ্ছেন বাক্যবাণে। গত বছর জুলাই-আগস্টে যারা ছিলেন জাতীয় বীর বছর না ঘুরতেই তারাই অনেকে হয়ে গেলেন সমালোচনার পাত্র। এমনকি জুলাই-আগস্টে যে ঐক্যের মাধ্যমে এই তরুণ তুর্কীরা জগদ্দল পাথরের ন্যায় ক্ষমতা দখলদার হাসিনা গংদের দেশ ছাড়া করেছেন, তারাই এখন অনৈক্যের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছেন। যা কাম্য ছিল না। তবে অনেককেই বলতে শোনা যায়, পরিকল্পিতভাবেই আগস্ট বিপ্লবের শিক্ষার্থী নেতৃবৃন্দকে জাতির সামনে বিতর্কিত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয় আরো গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে সরকার গঠন, শপথ, উপদেষ্টা পরিষদ নিয়োগ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে আগে থেকে কোনো হোম ওয়ার্ক ছিল না। ফলে তড়িঘড়ি বা চাপ প্রয়োগ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে কিছু ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা জেনে নেওয়া হয়নি পূর্বাহ্নে। অথবা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তা তৎক্ষণাৎ দিতে পারেনি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। সরকার সংস্কারের কথা বলছে জোরেশোরে। তা শেষ করে নির্বাচনের পথে পা বাড়াবে তারা। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পথরাস্তা জানতে চাচ্ছে।
এত বড় বিজয়ের পর ক্ষুদ্র কিছু কারণে সরকার, রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিগুলোর মাঝে যে কোনো অনৈক্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে সহায়তা করবে। সকলকেই মনে রাখতে হবে, এমন ঘোলা জলেই মাছ শিকারের চেষ্টা করবে পতিত ফ্যাসিস্ট ও তার দোসররা, যা কারো জন্যই স্বস্তিদায়ক হবে না।