সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় আমরা দেখেছি দেশ ও মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা মানুষের জন্য বিভিন্ন আইন তৈরি ও সেবাখাতের মানোন্নয়নে আলোচনায় সরব সংসদ, যৌক্তিক ও অযৌক্তিক উভয় কারণে একপক্ষের বর্জন ইত্যাদি নানারকমের ভূমিকা।
এরকম নানান ভূমিকায় আমাদের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সংসদীয় রাজনীতির আচরণ প্রত্যক্ষ করার দুর্লভ সুযোগ জনগণ পেয়েছে।
এর মধ্যে শুধু সরকারি দলের ভূমিকাই আলোচনায় এসেছে, কিন্তু বিরোধী দলের অনুরূপ ‘ছায়া সরকার’ হিসেবে আইনি ভূমিকা রাখার রীতিনীতি থাকলেও বর্তমান সংসদে তেমন কিছু দেখার সুযোগ দেশবাসীর হয়নি। সেই প্রেক্ষিতেই আজকের লেখা।
এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণতন্ত্রের চর্চা ও সংসদীয় সরকার পদ্ধতির যাত্রা মূলত ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকেই শুরু হয়।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া তিন জোটের সর্বদলীয় এবং আন্দোলনের মূলশক্তি ছাত্র ও সংগঠনগুলোরও অন্যতম দাবি ছিল এই সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা।
অবশ্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ও সরকার গঠনকারী দল হিসেবে বিএনপি পিছু হটতে চাইলেও তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের অনমনীয় মনোভাবের কারণেই বিএনপি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়েছিল।
বেসরকারি বিল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের পক্ষে বিল উত্থাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন মতবিরোধ সত্ত্বেও বিএনপি দ্বাদশ সংশোধনী পার্লামেন্টে সরকারিভাবে উত্থাপন করলে সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়। সেই থেকে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলছে।
সংসদীয় সরকার পদ্ধতির দ্বাদশ বিলটি পাশ হয় ৫ম সংসদে। সে সংসদের কার্যবিবরণী থেকে দেখা যায় যে, ১৯৯১ সালে ৫ম জাতীয় সংসদে মোট ২৬৫ কার্যদিবসে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ১৩৫ দিন সংসদে উপস্থিত ছিল।
অবশ্য সে সংসদামলেই দেশে মাগুরা উপনির্বাচনে ভোট কারচুপির প্রতিবাদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধীদলগুলো প্রথমে সংসদে ও বাইরে যুগপৎ আন্দোলন করে। দেশে ভোট কারচুপির এক জঘন্য ও ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সরকার।
একপর্যায়ে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর বেফাঁস মন্তব্যের প্রতিবাদে বিরোধীদল সংসদ থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। এতকিছুর পরও এই সংসদেই বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে এপর্যন্ত সেরা ভূমিকা ও দক্ষতা দেখিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
তিনি সংসদে মোট ১৩৫ দিন উপস্থিত ছিলেন। পঞ্চম সংসদে সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ এই দুটি সংশোধনীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধীদল সমর্থন দেয়।
উল্লেখ্য, পঞ্চম সংসদের মেয়াদকালেই সারাদেশে ভোট ও ভাতের দাবিতে আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকারি দল বিএনপি এককভাবে নির্বাচন করে।
গণতন্ত্রের যুগে কালো অক্ষরে লেখা ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই ভোটারবিহীন কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে বিএনপি সংসদ বসিয়েছিল। কিন্তু টিকতে পারেনি, যার মেয়াদকাল ছিল মাত্র কয়েকদিন। বিএনপি ও তাদের মিত্র কয়েকটি দল ছাড়া আর কোন দলই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এই সংসদেই বাংলাদেশের স্থপতির আত্মস্বীকৃত খুনিদের সাংসদ হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে বিএনপি জাতিকে হতবাক করে দেয়।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর সংসদীয় গণতন্ত্রের জাকজমকপূর্ণ আসর বসে সে বছরেরই ১২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সপ্তম সংসদ।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সংসদের কার্যবিবরণী থেকে দেখা যায়, ঐ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার উপস্থিতি ৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পুরো পাঁচ বছরে ৩৮২ কার্যদিবসে খালেদা জিয়া সংসদে ছিলেন মাত্র ২৮ দিন এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ১৭৫ দিন সংসদে অনুপস্থিত ছিল। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩৮২ কার্যদিবসের ২৯৮ দিন সংসদে আসেন ও উপস্থিতির হার ৭৮ দশমিক ১ শতাংশ। সেবার সর্বোচ্চ উপস্থিতির তালিকায় তিনি ছিলেন সাত নম্বরে।
একই সংসদে সর্বনিম্ন উপস্থিতির বিচেনায় তৃতীয় ছিলেন খালেদা জিয়া। বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মাত্র ৩ দিন সংসদে এসে সদস্যপদ টিকিয়ে রেখেছিলেন।
২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। সংসদ নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত অষ্টম সংসদের মোট ৩৭৩ কার্যদিবসে ১৯৫ দিন খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন মাত্র ৪৫ দিন। এ সংসদে আওয়ামী লীগ ২২৩ দিন অনুপস্থিত ছিল। সংসদ নেতার উপস্থিতির হার ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশ।
অষ্টম সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্য পূরণে বিরোধী দল বাধা হওয়ায় জাতির জীবনে চাপিয়ে দেয়া হয় অমানিশার ১/১১। ফলে দেশ থেকে সংসদ দুই বছরের জন্য চলে যায় নির্বাসনে।
অবশেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয় বর্তমানে চলমান নবম সংসদ, যা গত ২৫ জানুয়ারি তিন বছর পূর্ণ করেছে।
বর্তমান সংসদের এখনো পর্যন্ত মোট ৩৩০ (অধিক হবে) কার্যদিবসের মধ্যে ২৭৩ দিনই অনুপস্থিত ছিলেন বিরোধী দলের সাংসদরা। এর মধ্যে সংসদের ‘ছায়া প্রধানমন্ত্রী’ খ্যাত বিরোধীদলীয় নেতার উপস্থিতি মাত্র ৮ কার্যদিবস যা অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার জোট শরিক জামায়াত, বিজেপি ও এলডিপির মিলিয়ে ৪০ জন সংসদ সদস্য রয়েছেন।
বর্তমানে তারা জোটগতভাবে সংসদ বর্জন করে চলেছেন। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সর্বশেষ ২০ মার্চ ১২তম অধিবেশনে সংসদে যোগ দেন এবং উপস্থিতির হার এখনো পর্যন্ত মাত্র ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ওই অধিবেশনের শেষের দিকে ১৮ মার্চ তারা সংসদে যোগ দিয়েছিল সদস্যপদ রক্ষার জন্য।
এরপরে আর সংসদে ফেরেননি তারা। গত ১৪ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া পঞ্চদশ অধিবেশনেও যোগ দেবেন না বলেই শোনা যাচ্ছে। আর এ অধিবেশনে যোগ না দিলে রেকর্ডের খাতায় নতুন সংখ্যা যোগ করবে চারদলীয় জোটের নেতৃত্বদানকারী এ দলটি।
বিভিন্ন ইস্যুতে সংসদ বর্জন করলেও অনুপস্থিতি ৯০ দিনের কাছাকাছি আসতেই সদস্যপদ রক্ষায় অধিবেশনে যোগ দেন। সে হিসেবে সদস্যপদ রক্ষার জন্য আগামী বছরের যে কোনো একটি অধিবেশনে যোগ দিলেই চলবে বিএনপিসহ শরিক দলগুলোর।
শুধু বিরোধীদলীয় নেতাই নন, সামগ্রিকভাবে বিরোধীদলীয় সদস্যদের সংসদকার্যে অংশ নেওয়ার হার হতাশাজনক। নবম সংসদের প্রথম দিন ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে ছিলেন খালেদা জিয়া। রাষ্ট্রপতির ভাষণের প্রতিবাদ জানিয়ে খালেদার নেতৃত্বে বিরোধী চারদলীয় জোট ওয়াকআউট করে সেদিনই। শেষ দিন যোগ দেওয়ার আগে খালেদা জিয়া পূর্বের ৬দিন উপস্থিতির মধ্যে চারদিনই তিনি মোট ৩ ঘণ্টা ২৫ মিনিট বক্তৃতা করেন। পক্ষান্তরে চলতি সংসদের ২৫৪ কার্যদিসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ১৮৯ দিন উপস্থিত ছিলেন এবং অনুপস্থিত ৬৫ দিন। উপস্থিতির হার ৭৪ শতাংশের বেশি। এক্ষেত্রে উপস্থিতির অনুপাত অনুযায়ী বিরোধীদলীয় নেতাই বেশি সময় পেয়েছেন সংসদে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো পঞ্চম থেকে পরের চার সংসদের (ষষ্ঠ সংসদ বাদে) প্রতিটিতেই বিরোধী দলের উপস্থিতি কমছে, বিপরীতে বাড়ছে সরকারি দলের অংশগ্রহণের হার এবং সরকারি সাংসদের সংখ্যাও। আর এক্ষেত্রে নেতৃত্বে রয়েছেন বিরোধী দলের নেতাই।
বর্তমান সংসদে এসে পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যদিও বিরোধী দলের অভিযোগ তাঁদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। তথাপি শেষবার যোগ দিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা ১ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বক্তব্য দিয়েছেন। এমনটা অতীতে কখনো হয়নি। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা সর্বসাকুল্যে মাত্র ৮ দিন উপস্থিত থেকে বক্তৃতা দিয়েছেন ৫ দিনে ৫ ঘণ্টা ১৮ মিনিট।
পক্ষান্তরে দেখা যাচ্ছে যে, বিরোধী দল সংসদে যোগ না দিলেও সংসদ সদস্য হিসেবে অন্য সকল কার্যক্রম তথা স্থায়ী কমিটির বৈঠক, দেশে-বিদেশে সেমিনার ও সফরসহ যাবতীয় আর্থিক সুবিধাও গ্রহণ করছেন।
শুল্কমুক্ত কোটায় যেখানে একবার গাড়ি ক্রয় করা যায় সেখানে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও জয়নুল আবদীন ফারুক সাহেবরা দু’বার গাড়ি এনেছেন।
একজন সাংসদ অনুপস্থিত থাকলেও প্রতিদিনের বরাদ্ধকৃত টাকা বরাদ্ধ পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে বিদেশ সফর, স্থায়ী কমিটির মিটিংসহ নানা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আরো অনেক আর্থিক সুযোগ পেয়ে থাকেন। এখনো পর্যন্ত বিরোধীদলের প্রতিজন সাংসদই সেসব সুবিধা গ্রহণ করছেন। কিন্তু শুধু সংসদেই যাচ্ছেন না। অথচ এই টাকা জনগণের টাকা।
সংসদ অধিবেশনে না গেলেও প্রধান বিরোধীদল বিএনপির প্রায় সব এমপিই শুল্কমুক্ত গাড়ি, সংসদীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ নানা কার্যক্রমে যোগ দিতে বিভিন্ন দেশ সফর ও বেতনভাতার সুবিধা ভোগ করছেন ঠিকই। এমনকি সংসদে অনুপস্থিত থাকলেও অধিবেশনে অংশ নিতে আসার জন্য বরাদ্দকৃত দৈনিক যাতায়াত ভাতাও নিয়মিত বুঝে নিচ্ছেন বর্জনরত সাংসদরা। সংসদ সদস্যের নামে বরাদ্দ সরকারি বাসভবন ও নিজস্ব কার্যালয় ব্যবহার করছেন।
এই সংসদেই দেখা গেছে, বেতন-ভাতা বাড়ানোর বিলের বিরোধিতা করে ওয়াকআউট করেও পরের মাস থেকে বর্ধিত বেতন-ভাতাও গ্রহণ করেছেন। শুধু হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরের জন্য যে টাকা বরাদ্দ সেটুকু ছাড়া বাকি সবই গ্রহণ করছেন বিরোধীদলীয় প্রত্যেক সদস্যরা।
এমনকি প্রশ্নও জমা দিয়ে রাখছেন, সম্ভবত যোগ দেওয়ার সম্ভাবনার জায়গা থেকে। এভাবেই উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি আর দেনা-পাওনার হিসাব নিয়েই গত ২৫ জানুয়ারি ৩ বছর পূরণ করছে নবম জাতীয় সংসদ। তাহলে প্রশ্ন জাগে এই বর্জন কিসের উদ্দেশ্য?
সংসদে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বশেষ তাদের দাবি এসে ঠেকেছে ‘সংসদ নেতা যদি কমিটমেন্ট করেন যে তার দল সংসদে উগ্র আচরণ করবে না তবেই আমরা সংসদে যাব’। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, বর্তমান সংসদে বিরোধী দল কোন যৌক্তিক দাবিতে অনড় থেকে সংসদ বর্জন করেননি। এমনকি রাজপথেও তাঁদের আন্দোলন দেশ ও মানুষের কোন স্বার্থে পরিচালিত হয়নি। কেবল বিএনপির নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় দলটি তাঁদের জোটবদ্ধদের নিয়ে আন্দোলন করেছে।
অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদই সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে বিরোধী দলের সংসদের বাইরে থাকার অনিয়মটিই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সরকারের পক্ষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল না আনলে বিএনপি সংসদে যোগ দেবে না, এমন গোস্বার কথাও শোনা যায়।
কিন্তু তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই পঞ্চম সংসদের কথা। একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর বিল বিরোধী দলই বেসরকারিভাবে এনেছিল। সেই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে তাঁরাও সংসদে যোগ দিয়ে বেসরকারি বিল উত্থাপন করতে পারে। সেখানেই আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা হবে এমন আশাবাদের কথা ইতোপূর্বে আমরা সরকারের পক্ষ থেকেও শুনেছি।
বাংলাদেশে বিরোধী দলের বহুল ব্যবহৃত একটি কথা হলো, সংসদে আমাদের কথা বলতে দেয়া হয় না। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যে, সরকারি দলের সদস্য সংখ্যা বেশি, দুনিয়ার প্রতিটি সংসদেই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, কলম, ফাইল ও চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে।
১৯৫৮ সালে এই ভূখণ্ডেও এমনি এক পরিস্থিতিতে আহত হয়ে স্পিকারকে (শাহেদ আলী) মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। কাজেই এসব কথা বলে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি এতই কথা বলার ইচ্ছে থাকে, তাহলে সংসদ চলাকালীন সংসদের বাইরে একটি ছায়া সংসদ বসিয়েও তারা প্রতিবাদ করতে পারে। সম্ভবত ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরে তাদের এতটা সময় কোথায়?
এ অবস্থায় বিরোধী দলের সংখ্যা যত নগন্যই হোক তাঁদের অব্যাহত বয়কটের ফলে জাতীয় সংসদ প্রাণহীন হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। সরকারি দল ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত সংসদ দেখতে এদেশের মানুষ সবসময়েই প্রত্যাশা করে।
বিরোধী দল সংসদে সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেবে এবং নিজেদের পরামর্শ তুলে ধরেবে, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বিরোধী দল দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকায় তারা সেখানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
সরকার একচেটিয়াভাবে সংসদ চালাতে বাধ্য হচ্ছে এবং কোনো বিরোধিতা ছাড়াই বিভিন্ন বিল পাস করতে হচ্ছে। সংসদীয় বিতর্কের ক্ষেত্রে অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আগ্রহী দর্শককে বিশ্ববিদ্যালয়/কলেজ/স্কুলের বারোয়ারি বিতর্ক অনুষ্ঠান দেখেই সংসদের বিতর্কের স্বাদ নিতে হবে।
বিরোধী দলের এভাবে সংসদ বর্জন অন্যায় হলেও সেটি নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়। কেননা তারা ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু সাংসদ হিসেবে যে তাঁদেরও কিছু ক্ষমতা রয়েছে, অনেক দায়িত্ব রয়েছে সেগুলো নিয়ে সকল মহলে আলোচনা না হলে শুধু সরকারকে সবকিছুর জন্য দায়ী করে সংসদীয় গণতন্ত্রের কোনো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
যে দলই হোক না কেন, সংসদ বর্জন বন্ধ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য প্রয়োজন। সংসদকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হলে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতা দু’জনকেই উদ্যোগী হতে হবে। তাদেরই সংসদে উপস্থিতির বিষেয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করার দাবি অনেকদিন থেকেই সচেতন মহলে আলোচিত।
সংসদ সদস্যের পদবি নিয়ে কোনো ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন করবেন না এটা মেনে নেয়া যায় না। জনগণ তাঁদের পক্ষে একজনকে নিয়োগ করে সংসদে পাঠায়। জনগণের এই আমানতের প্রতিদান দেওয়া প্রত্যেক সাংসদের অবশ্য কর্তব্য।
এটা সহজেই বলা যায়, সংসদ কার্যকর করতে সরকার ও বিরোধী দল উভয় সদস্যদের আন্তরিক হতে হবে। তবে অতীতে বতর্মান স্পিকারের মতো এত উদার স্পিকার আমরা কখনও পাইনি, তিনি কয়েকদিন আগেও খালেদা জিয়াকে সংসদে আসার অনুরোধ করেছেন।
আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সরকার ও বিরোধী দল সকলেই একসঙ্গে মিডিয়ায় টকশোতে যাচ্ছেন। কিন্তু সংসদে যেতেই শুধু বিরোধী দলের অনীহা। এটা থেকেই বোঝা যায় সংসদ বর্জন মূলত লোক দেখানো যে, আমরা জনগণে স্বার্থেই বর্জন করেছি। কিন্তু সত্য ঘটনা আমরা এমন বাস্তবতা খুঁজে পাইনা।
সংসদের আজকের এই অবস্থা সৃষ্টির কারণ খুঁজতে গিয়ে পাঠকদের জন্য অতীতের কিছু ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরছি। ৫ম (৯১-৯৬) সংসদে দেশে নজিরবিহীনভাবে সরকার ও বিরোধী দল দুটি বিল পাশ করিয়েছে। সেই সংসদে খালেদা জিয়া সংসদ নেতা ও শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা। ভোট কারচুপি ও একজন মন্ত্রীর অশালীন কটূক্তির প্রতিবাদে বিরোধী দল সংসদ বর্জন শুরু করে। সেটাও একেবারে শেষ দিকে। ৭ম (৯৬-০১) সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বিরোধীদলীয় নেতা সরকারি দলের সাংসদদের ‘চুপ বেয়াদপ’ বলে আঙ্গুল তুলে গালি দেওয়ায় প্রথম উত্তপ্ত বিতর্কের সুচনা হয়।
৫ম ও ৭ম সংসদকে বিবেচনায় নিলাম এজন্য যে, এই দুটিতেই দুটি দল পরস্পর সরকারি ও বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে দেখা যাচ্ছে প্রথমে সংসদ নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার দায়িত্বহীনতার সুস্পষ্ট কারণে বিরোধী দলকে সংসদ বর্জনের দিকে যেতে হয়েছে। পক্ষান্তরে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও নেতা শেখ হাসিনা ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে দুটি বিলে সম্মতি দেন। এরপরের সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে খালেদা জিয়াই প্রথম অশালীন ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে সংসদকে নিরুৎসাহিত করতে ভুমিকা রাখেন।
কাজেই এসব ইতিহাসের দায় কারো ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংসদীয় রাজনীতি এদেশের মানুষ এখনো পুরোপুরি না বুঝলেও অন্তত এটা বোঝে যে, কে কোন উদ্দেশ্য কী করে। ফলে জনগণকে বোকা মনে করা ঠিক হবে না। দায় তাঁদের নিতেই হবে। ৪র্থ সংসদের প্রথম বাজেট অধিবেশনে যে মওদুদ আহমদ সংসদ নেতা হিসেবে ৭০ কার্যদিবস পরিচালনায় তার বিরল কৃতিত্ব দাবি করেন, সেই মওদুদ সাহেবও এখন ভোল পাল্টে বিএনপি নেতা। সংসদের আসন বিন্যাস নিয়ে উনাদের যে খামখেয়ালি আচরণ জাতি প্রত্যক্ষ করেছে সেসবের বিরল কৃতিত্বও এই মওদুদ গংদেরকেই বহন করতে হবে চলমান সভ্যতার ইতিহাসে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সকল কিছুর জন্য উভয় পক্ষই দায়ী থাকে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থানে ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই এর সত্যতা পাওয়া যায়।
লেখকঃ নুরুল আলম পাঠান মিলন, ছাত্রলীগের সাবেক সংগঠক, ইমেইলঃ [email protected]
আশরাফ সিদ্দিকী বিটু, পরিচালক, সিআরআই, ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১২
সম্পাদনা: সোহেলুর রহমান, নিউজরুম এডিটর/আরআর,[email protected]