বলতে গেলে মাত্র বিশটি বছরেই এই ব্রিটেনে বাঙালিরা এক অসামান্য সাফল্য নিয়ে এসেছে। এই সাফল্যের পেছনে আছে অনেক সংগ্রাম-ত্যাগ-তিতিক্ষা।
বাঙালি অধ্যূষিত বর্তমান "স্পিটাল্ডফিল্ড অ্যান্ড বাংলা টাউন" শব্দবন্ধটি টাওয়ার হ্যামলেটস বারার শুধুমাত্র স্পিটাল্ডফিল্ড ওয়ার্ড হিসেবেই পরিচিত ছিলো একসময়। কিন্তু বাঙালিদের অব্যাহত সফলতার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এই স্পিটাল্ডফিল্ডের সাথে যোগ হয় ‘বাংলা টাউন’ নামটি। অর্থাৎ শাব্দিকভাবেও বাংলা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় প্রথম ১৯৯৯ সনে এই ব্রিটেনে। এর আগে ১৯৮২ সালে একজন কাউন্সিলার নির্বাচিত হবার মধ্যি দিয়ে শুরু হয় যাত্রা এই এলাকায়। মূলধারার দলগুলোর অবজ্ঞাকে থোড়াই কেয়ার করে আজকের নিবন্ধের আলোচিত এলাকা বাংলা টাউনে বিদ্রোহ করেছিলেন নুরুল ইসলাম। স্বতন্ত্র হিসেবে কাউন্সিলার নির্বাচিতও হয়েছিলেন তিনি বাঙালিদের এলাকায়। এভাবেই শুরু হয়েছিলো। বাঙালিদের ঐক্য তখন ভিত তৈরি করে দেয় মূলধারার রাজনীতিতে। তারপর টেমস-এ পানি গড়িয়েছে অনেক। তিল তিল করে গড়ে ওঠা কমিউনিটির প্রতিনিধি আজ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। ইতিহাস সৃষ্টি হওয়া টাওয়ার হ্যামলেটস্ এ প্রথম নির্বাচিত মেয়র ঐ বারায়, তা-ও বাঙালি।
বাংলা টাউনকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের উত্থান ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়েছে। ম্যানচেস্টার-ওল্ডহ্যাম-রচডেল-বার্মিংহাম-হাইড-চেশায়ার-বার্নলি-ব্রাডফোর্ড প্রভৃতি শহরের স্থানীয় প্রশাসনের জনপ্রতিনিধি এখন বাঙালিরা।
বাংলা টাউনের প্রধান জায়গাটি ব্রিকলেনকে কেন্দ্র করেই যেন লাখো মানুষ জমায়েত হয় প্রতিবছর বৈশাখি মেলায়। ব্রিকলেন ইংরেজী সাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রেক্ষাপট। এসময়ের ব্রিটেনের সেরা দশটি উপন্যাসের একটি ‘ব্রিকলেন‘কে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে ছবি ‘ব্রিকলেন’। এই ব্রিকলেনেই বাংলা টাউন নাম নিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল তোরণ। বর্ণবাদীদের আক্রমণে নিহত আলতাব আলীর নামে হওয়া আলতাব আলী পার্কও ঐ বাংলা টাউন ঘিরেই। আবার ঐ পার্কেই তৈরি করা হয়েছে বাঙালিদের একুশের মিনার। সহজ কথায় বাংলা টাউন এখন আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে যাওয়া একটি নাম।
আজ টাওয়ার হ্যামলেটস্ এর বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব কোনো না কোনোভাবে কিছু অবাঙালীর কাছে বিস্ময়ের, ঈর্ষার। বাঙালিদের শিক্ষায়-প্রজ্ঞায় দুর্বলতার অজুহাত তুলে রাজনীতি কিংবা মূলধারায় প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে একসময়। কিন্ত সেদিন এখন আর নেই। রাজনীতিতে সংযুক্ত হয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেরিয়ে আসা চৌকস বাঙালি তরুণ-তরুণীরা। গত নির্বাচনে বেথনালগ্রিন-বো নির্বাচনী এলাকায় সব দল থেকেই প্রার্থী হিসেবে বাছাই করা হয়েছিলো চৌকস তরুণ-তরুণীদের। স্বাভাবিকভাবেই তাই অবাঙালিরা কিছুটা হলেও এই বারার নেতৃত্ব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে বাঙালির আবেগ এখানে একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘বাংলা টাউন’ নামটি বাঙালিদের নিজ সত্ত্বা আর সংস্কৃতির সাক্ষর বহন করে। তাইতো রাজনীতির অগ্রযাত্রায় এ আবেগকে পর্দার অন্তরালে নিয়ে যেতে শুরু হয়েছে যেন এক ভিন্ন ষড়যন্ত্র। ইতিহাসের পাতা থেকে ‘বাংলা টাউন’ নামটি মুছে ফেলার এ এক পদক্ষেপ। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রস্তাব অনুযায়ী বিটেনের "লোকাল গভর্নমেন্ট বাউন্ডারি কমিশন ফর ইংল্যান্ড" এই নামটি কর্তনের পক্ষে সায় দিয়েছে ইতিমধ্যে।
ইংল্যান্ডের নির্বাচনী এলাকাগুলো রিভিউ করার দায়িত্বপ্ত এই কমিশন বিভিন্নভাবে স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব পেয়েছে। লেবার দলীয় কাউন্সিলার এবং নির্বাচিত মেয়র ও তার সমর্থিত কাউন্সিলারগণের মাঝে দূরত্ব থাকলেও এই ইস্যুতে কাউন্সিলারগণ (মেয়র সমর্থিত স্বতন্ত্র ও লেবার দলের) পূর্বের নামকরণের পক্ষে প্রস্তাব দেয় অথচ কনজারভেটিভ পার্টি ‘বাংলা টাউন’ নামটি না রাখার প্রস্তাব দেয়। কমিশন এ নামটি অর্থাৎ শুধুমাত্র স্পিটাল্ডফিল্ড রাখার পক্ষেই প্রাথমিক সায় দিয়েছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিটি ফুঁসে উঠেছে। মেয়র, মেয়র সমর্থিত কাউন্সিলার,লেবার দলীয় কাউন্সিলার স্ব স্ব অবস্থান থেকে জনসংযোগ প্রতিবাদ করছেন। এমনকি মেয়র শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে মামলা পর্যন্ত করার কথা বলেছেন। ৫২ জন কাউন্সিলারের ২৭ জনই বাঙালি। মেয়র-ডেপুটি মেয়রও বাঙালি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এরা ব্রিটেনের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য’র পাশাপাশি বাঙালিত্ব কিংবা নিজস্ব হ্যারিটেজকে ভুলে যেতে পারেন না। কারণ বাঙালিদের ঐকতানকে ব্যবহার করেই আজ তারা এই আসনে আসীন। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের এটা ভুলে যাবার কথাও নয়। কিন্তু ভাবতে বিস্ময় লাগে, কমিউনিটি নিয়ে রাজনীতি করা কনজারভেটিভ পার্টি কেন বিরুদ্ধে চলে গেলো ? বলতেই হয়, আগামীর রাজনীতির দৌড়ে এই পার্টি টাওয়ার হ্যামলেট্স-এ আরও একধাপ পেছনে পড়ে গেলো। লেবার পার্টি কিংবা মেয়রের স্বতন্ত্র কাউন্সিলাররা কমিউনটিকে নিয়ে যেভাবে এগুচ্ছেন, তাতে করে বাংলা টাউন নামটি টাওয়ার হ্যামলেট্স এর ওয়ার্ডের নাম থেকে বিলীন করে দেয়া কঠিনই হবে।
অন্যদিকে একটা কথা এখানে বলাই যায়, যেহেতু বাউন্ডারি কমিশন ঐ বারায় ৫২টি কাউন্সিলারের পদ কমিয়ে ৪৫ জনে এবং ১৭ টি ওয়ার্ডের স্থলে ২০টি ওয়ার্ড করার প্রস্থাব করেছে, সেহেতু বাংলা টাউন নামটা মুছে ফেলার কোনো যুক্তিও মেলে না। বরং কমিশন নতুন একটি ওয়ার্ডের নাম শুধু বাংলা টাউন করে দিতে পারে। তাই বাংলা টাউন শুধু বাঁচানোই নয়, এমনকি একটা ওয়ার্ডকে শুধু বাংলা টাউন নামকরণ করার জন্যে চাপ প্রয়োগ করাও এখন অযৌক্তিক হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
ফারুক যোশীঃ যুক্তরাজ্য-অভিবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
বাংলাদেশ সময় ১৪০৮ ঘন্টা, নভেম্বর ২৪, ২০১২