আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের পোশাক-শিল্প শ্রমিকদের জ্বলে অঙ্গার হবার পর থেকে ছবিগুলো যেখানেই দেখেছি, সেখানেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। পাছে কোনো জ্বলন্ত অঙ্গারের ছবি দেখতে হয় এই ভয়ে।
খুব স্বাভাবিক যা তা হলো, নিহত শ্রমিক পরিবারগুলোর হাহাকার। লাশহীন মা-বাবা-স্বামী-স্ত্রী-ভাই-বোন সহ অসংখ্য স্বজন যেন এখনও প্রহর গুনছে। প্রতীক্ষা ফুরোয় না। জ্বলে অঙ্গার হওয়া মানুষগুলো আর আসবে না। তাদের হাত-পা‘র সঞ্চালনের মধ্যি দিয়ে আবার চলবে না গার্মেন্টস নামের মেশিনের চাকাগুলো। কিন্তু ঢাকার হাজার হাজার গার্মেন্টস বন্ধ হবে না। বন্ধ হতে পারেই না। কারণ অর্থনীতির ভাষায় দেশ সচল করে রাখার এক প্রধান মাধ্যম এই গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি। এই গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে লাখ-লাখ শ্রমিক কাজ করে। নিতান্তই বস্তিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে। এদের কোনো বাড়ি বা মাথা গোঁজার নেই। উদয়াস্ত পরিশ্রমে সে শ্রমিকের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় কোনো রকম যদিও কিন্তু তাদের হাড়ভাঙ্গা অমানবিক খাটুনিতে গার্মেন্টস মালিকরা ফুলেফেঁপে উঠছে ক্রমশ। একটা অস্বাভাবিক ধনিক গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে বিগত প্রায় দুতিন দশকে বাংলাদেশে এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোকে কেন্দ্র করে। আর সেজন্যেই তো কেউ কিছু বলতে পারে না। না সরকার, না বিরোধী দল।
তাজরীন ফ্যাশন জ্বলে যাবার পর আবারও বিস্তর লেখালেখি, টকশো। রাষ্ট্রের শোকগাথা। জাতীয় শোক দিবস। এসবই জাতি হিসেবে আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। তাজরীন ফ্যাশনে আগুন আর শ্রমিকের মৃত্যু যেন আবারও গার্মেন্টস ফ্যক্টরিগুলো নিয়ে অনেক পর্যালোচনার সুযোগ করে দিয়েছে। অনেক কিছুই উঠে আসছে এখন। এটা কি নিছক দুর্ঘটনা----এ ব্যাপারটা এখন আর কেউ যেন বলতে চাইছে না। এক মা বলেছেন তার সন্তান ফোন করে বলেছেন, তার কারখানায় আগুন লেগেছে বেরুনোর পথ রুদ্ধ। একটা লাল কাপড় তার শরীরে বেঁধে সে মরছে, লাশটা যেন শনাক্ত করে নেন তিনি। কিংবা ‘আমাকে বাঁচাতে না পারলে আমার বাম হাতে তাবিজ বাঁধা আছে। আর কোমরে বাঁধা আছে কালো গেঞ্জি, এর সঙ্গে বাবার দেওয়া বিশ টাকা পকেটেই আছে, খরচ করিনি। এখন আমি একটা বাথরুমে আছি, মারা গেলে এখান থেকে আমার লাশ বাড়িতে নিও। ’ রংপুরের পলাশের মা’র হাউমাউ কান্নার সাথে বর্ণনা করা এরকম আরও হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো একে একে আসছে, আসতেই থাকবে আরো কিছুদিন। বেঁচে আসা শ্রমিকদের কথায় বেরিয়ে এসেছে কিভাবে কিছু মধ্যম শ্রেণির ব্যবস্থাপক বাইর থেকে ফ্যাক্টরিতে তালা লাগিয়ে উচ্চৈ:স্বরে মিউজিক ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। শ্রমিকদের পুড়িয়ে দিতে যেন ইচ্ছাকৃত চলে যাওয়া তাদের।
প্রধানমন্ত্রী কিছু বাছ-বিছার না করে তাৎক্ষণিকভাবেই বলে বসলেন, ‘এটা ষড়যন্ত্র’। হয়ত ঈঙ্গিত আছে বিরোধী দলের প্রতি। আবার বিএনপি‘র ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সবকিছু জানার আগেই বলেছেন, ‘এটা সরকারই করেছে’। কি এক নির্মম খেলা রাজনীতির! নৃশংস মৃত্যু যেন এদের নাড়া দেয় না। ছাই হওয়া মানুষের মাঝে এরা পারস্পরিক রেষারেষি খোঁজেন। শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে কি প্রধানমন্ত্রী বলতে পারতেন না----এ শোক বইতে দিন সারা জাতিকে, তদন্তের ব্যাপরটাতো আছেই। বিরোধী দল কি আরও এক দুটো দিন অপেক্ষা করতে পারতো না? না, তারা অপেক্ষা করবে কেন! রাজনীতিতে সবারই তো লাশ প্রয়োজন। মড়ারতো কোনো জাত থাকে না। এই জাতহীন মড়াগুলো নিয়েই এরা রাজনীতির জাতে উঠতে চান । নির্বাচনের লাড্ডু যেন এরা খেতে চান এক একটা লাশ দিয়ে। জাতিকেও যেন বেআক্কেল ভেবে বিশ্বাসও করাতে চান তারা। প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর নিয়মকানুন নিয়ে নতুন করে করে ভাবতে হবে। সময়ে-অসময়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে দায়িত্ব নিয়ে অনেক কিছু করেন। অথচ এতবড় একটা দুর্ঘটনা, প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন নি কঠোর কিছু কথা। তিনি বলতে পারেন নি গার্মেন্টস মালিকরা যারা গার্মেন্টস এর কমপ্লায়েন্স (শ্রমিকের কাজের পরিবেশ উপযোগী বা যথাযথ মান নির্ধারক) মানছেন না, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বিরোধী দলও এ দাবিটুকু করতে পারে নি প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
ফ্যাক্টরীতে আগুন লাগলে, ফায়ার-অ্যালার্ম বাজলে শ্রমিক-কর্মচারি-অফিসার সবাই বেরিয়ে যাবে, ফায়ার এক্সিট দিয়ে বেরুবে এটাই-তো স্বাভাবিক নিয়ম। সেখানে কেন-ই বা ম্যানেজার সুপারভাইজার আটকে দেবে শ্রমিকদের? এবং তা শুধু তাজরীনে নয়, জানা যাচ্ছে, প্রতিটা গার্মেন্টেসেই এটা হয়ে থাকে। খাঁচায় মুরগি রাখার মতো বন্দী করে মানুষ রাখা হয়, জ্বলে ছাই হয় শ্রমিক আর মোটা বেতনের কর্মকর্তারা ছাই হওয়া মানুষগুলো দেখে আর রঙিন স্বপ্ন দেখে। গার্মেন্টস ফ্যক্টরিগুলো নিয়ে যে কমপ্লায়ান্সের ব্যাপারটা উঠে আসছে, সবাই বলছে বিদেশি ক্রেতারা যখন আসে তখন কমপ্লায়েন্স ঠিকই তারা দেখায়, ক্রেতারা সন্তুষ্টচিত্তে চলে যায়। কিন্তু কথা হলো এ কমপ্লায়ান্স মানা হয় না কেন। অর্থাৎ বিদেশি ক্রেতারা ঠিকই যেখানে শ্রমিকদের একজন মানুষ হিসেবে দেখে, সেখানে গার্মেন্টস ব্যবস্থাপনার সাথে সংযুক্তরা এই শ্রমিকদের শুধু মানুষরূপী প্রাণি হিসেবেই দেখতে ভালোবাসেন। সেজন্যেই তালা লাগিয়ে এরা মানুষকে পুড়িয়ে ছাই করে দেন। ছাই করে দেন শত শত কোটি টাকার সম্পদ।
মাত্র চার পাঁচদিনে মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত রিপোর্ট এসেছে। একটা ভালো দিক সরকারের। দ্রুত অন্তত একটা রিপোর্ট বেরিয়ে এলো। রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে অনেক কিছুই। ভবন নির্মাণ বিধিমালা, কমপ্লায়েন্স,ফ্যাক্টরির অবস্থানসহ অনেক প্রশ্ন উঠে এসেছে ফ্যক্টরিটিকে ঘিরে। সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি উঠে এসেছে, তা হলো নাশকতার ব্যাপারটাও উড়িয়ে দিচ্ছে না চার সদস্যের তদন্ত টিম।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ষড়যন্ত্রের কথা, বিরোধী দল বলেছে সরকারের দায়ের কথা, তদন্ত টিমও বলছে নাশকতার কথা। গার্মেন্টস তালা মেরে কারা শ্রমিকদের মুত্যুর মুখে ঠেলে দিলো--- এমনকি ফ্যক্টরির মালিক দেলোয়ার হোসেনও এ প্রশ্নটি তুলেছেন। সব মিলে ষড়যন্ত্র কিংবা নাশকতার ব্যাপারটিই উঠে আসছে । কিন্তু কেন হচ্ছে এসব। নিশ্চিন্তপুরের এই আগুনইতো প্রথম কোনো আগুন নয়, এ আগুন মাঝে মাঝেই জ্বলে ওঠে, বিএনপি জোট সরকারের আমলেও হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এরকম আগুন জ্বলছে। কিন্তু কেনইবা জ্বলে ওঠে এমন আগুন?
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাটের গুদামে একের পর এক আগুন দেয়ার সাথে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির আগুনের যেন সাদৃশ্য মেলে। এটা একটা অনুমান মাত্র। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির খেলায় ক্রীড়ণক হয়ে এ কাজটি কি কোনো শক্তির যোগসাজসে ঘটছে না, তা-ই বা আমরা উড়িয়ে দিই কিভাবে। বাংলাদেশে এর আগেও পাট কিংবা পাটশিল্প ধ্বংস হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে ক্রমেই বিদেশি ক্রেতারা ঝুঁকছে বাংলাদেশের দিকে। পোশাক তৈরির মানের দিকে নিশ্চয়ই এই শ্রমিকরা দক্ষ। তাই তো ব্রিটেন-ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় এসব পোশাকপণ্যের কাপড়গুলোর চাহিদা। সে হিসেবে আমাদের কোনো বিদেশি বেনিয়া অপশক্তি আমাদের দেশীয় দোসরদের যে ব্যবহার করতেই পারে, সে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ এরকম আগুন-খেলায় বার বার শ্রমিক নিহত হলে ফ্যক্টরিগুলো নির্ধারিত সময়ে অর্ডার বিদেশে পৌঁছাতে না পারলে ক্রেতার বাংলাদেশ থেকেও মুখ ফিরিয়েই নিতে পারে।
দেশীয় পোশাক শিল্প বাংলাদেশে একটা ধনিক শ্রেণি সৃষ্টি করলেও দিন দিন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার প্রতি নজর দিতেই হচ্ছে গার্মেন্টস মালিকদের। আন্দোলন-সংগ্রাম কিংবা ন্যূনতম মানবিক দায়বোধ মালিকদের তাড়িত করবেই। পুঁজির প্রসার ঘটাতে লভ্যাংশ বাড়াতে মালিকদের তা করতেই হবে বৈকি। ১১০ জন নিহত শ্রমিকের ৭০ টি পরিবারের দায় ভার নিয়েছেন ইতিমধ্যে পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা।
আমরা আশা করতেই পারি, মালিকরা শুধুই এক শোষক শ্রেণি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে না। কারণ একজন ব্যবসায়ী যে শ্রমিক দিয়ে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স তৈরি করেন, তা থেকে অন্তত কিছু অর্থ তাদের ন্যায্য পাওনা দিয়ে দিলে কি-ই এমন ক্ষতি হবে। গার্মেন্টস ফ্যক্টরিগুলো আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত। এই ভিতকে টিকিয়ে রাখে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। এই ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে হবে। নিশ্চিন্তপুরের কারখানগুলোতে আবারও স্পন্দন শুরু হয়েছে। এ স্পন্দন যেন আর না থামে।
নাশকতা-ষড়যন্ত্র যা কিছুই হোক, ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। ভাবতে হবে। এই শিল্পটি বাঁচাতে হবে এমনকি রাজনীতির প্রয়োজনে। লাখ লাখ শ্রমিকের বাঁচার প্রয়োজনে। আর সেজন্যেই শ্রমিকদের মানুষ ভাবতে হবে। আইন তৈরি করতে হবে শ্রমিকদের মানুষ ভাবার। আইনের প্রয়োগও থাকতে হবে। আর এতে সমর্থন থাকতে হবে গার্মেন্টস মালিকদের। চাই আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। মালিকদের মানবিক দায়বোধটা যেন জাগ্রত হয়। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির ট্র্যাজিক ইতিহাসের শত শত লাশ যেন তাদের এই দায়বোধটুকু জাগায়।
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]