প্রায় ৩২ বছর আগে কাজাখস্তানের শহর আলমাআতায় স্লোগান উঠেছিল, ‘২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য’। বাংলাদেশও এই স্লোগানে গলা মিলিয়েছিল।
ধনী-দরিদ্র ও গ্রাম-শহরের মধ্যে স্বাস্থ্য সূচকের আকাশ পাতাল ব্যবধান ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের তুলনায় চিকিৎসা-ব্যয় অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নে জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী একযোগে কাজ করার জন্য আহবান জানাচ্ছে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোও নতুন করে রোগ-বালাই নিরাময় ও প্রতিরোধে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। স্বাস্থ্যখাতে পুনরায় এই আগ্রহের কারণ প্রধানত: তিনটি। প্রথমত: ধনী-গরীব নির্বিশেষে স্বাস্থ্যই মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাই তারা একদিকে উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে, অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলোতে আর্থ-সামাজিক এবং স্বাস্থ্যখাতে ক্রমবর্ধমান অসমতা হ্রাস করতে নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
দ্বিতীয়ত: গত পাঁচ দশকে পুর্ব এশিয়া এবং পুর্ব ইউরোপে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, স্বাস্থ্যই আর্থসামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। গড় আয়ু বাড়লে জিডিপি, জিএনপি বাড়ে। এটা কোনো অনুমান নয়, গবেষনালব্ধ সত্য। তৃতীয়ত: স্বাস্থ্য সমস্যা রাষ্ট্র পরিচালনায় বহুমুখী সমস্যার জন্ম দেয়। সুতরাং এ বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। নব্য উদারতাবাদী অর্থ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যখাত সোনার ডিমপাড়া হাঁস । হাঁসের পেট কেটে দ্রুতই সব ডিম বের করে নেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালগুলো পুঁজিপতিদের টাকা বানানোর কারখানায় পরিণত হয়েছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা, কাটাকাটি, জন্ম-মৃত্যুর এক অমানবিক মুনাফালোভী নিষ্ঠুর ব্যবসার দ্বার উন্মোচন করেছে। বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত বেশিরভাগ দেশেই স্বাস্থ্যসেবাকে পণ্যে পরিণত করেছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য হ্রাস করা গেলে স্বাস্থ্যসেবা আশানুরূপ ভাবে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। বরং দিনে দিনে তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সরল সমীকরণের কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যায়নি। মুক্তবাজার অর্থনীতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে পারেনি অথবা সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে এই ব্যবস্থা সক্ষম নয়। সাম্প্রতিক কালের উৎকৃষ্ট উদাহরণ অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকার সিনেটে স্বাস্থ্যসেবা বিল নিয়ে বিতর্ক। ধনী বিশ্বেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে এত হৈচৈ কিন্তু বাংলাদেশসহ দরিদ্র দেশগুলোর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
একদিকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নতুন নতুন রোগবালাই আবির্ভূত, অন্যদিকে পুরাতন জ্বরাব্যাধি তো আছেই। গত বিশ বছরে পৃথিবীতে এইচআইভি/এইডস্, ইবোলা, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ইত্যাদি প্রায় ৩০টি নতুন রোগের আর্বিভাব হয়েছে। এছাড়াও আরো কত অজানা রোগ ব্যাধি অপেক্ষা করছে সেগুলো সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ মহলেরও ধারণা নেই।
এইসব যাবতীয় নতুন পুরাতন রোগ-ব্যাধিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠী। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকা পৃথিবীর সর্বাধিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঠিকানা। যদিও রোগ-ব্যাধি হওয়ার কারণ ধনী দরিদ্রের পরিপ্রেক্ষিত নয়। কিন্তু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কারণে জীবনমান, পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ, বাসস্থান এবং চিকিৎসাসুবিধা প্রাপ্তিতে ভিন্নতা প্রকট। যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি সংক্রমণে ও বিস্তারে ভুমিকা রাখে। ঘনবসতি, অস্বাস্থ্যসম্মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশ, শোচনীয় পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণেও দরিদ্ররা অনেক রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
দরিদ্ররা যেমন স্বাস্থ্য সুবিধা পায় না, তেমনি স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্যাদিও পায় না। ফলে একদিকে তারা রোগের প্রতিষেধক নিতে পারে না, অন্যদিকে রোগ প্রতিরোধও করতে পারে না। তাই দরিদ্রদের গড় আয়ু কম এবং মৃত্যুর হার বেশি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকা অঞ্চলে শিশুমৃত্যু হার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। এ-অঞ্চলে সম্মিলিত মৃত্যুসংখ্যার প্রতি তিন জনের দুই জনই মারা যায় এইচআইভি/এইডস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, হাম, নিউমোনিয়া এবং ডায়ারিয়া-- শুধু এই ছয়টি রোগে। এসব রোগ প্রতিবছর কেড়ে নিচ্ছে এক কোটি চল্লিশ লক্ষ শিশুর জীবন। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এই রোগগুলোকে ‘দারিদ্র্যের রোগ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
কারণ এই সব রোগ-ব্যাধি দরিদ্রদের আক্রমণ করে বেশী। আবার দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও দীর্ঘায়িত করতে সরাসরি ভুমিকা রাখে। পৃথিবীর ৯৫ ভাগ এইড্স, ৯৮ ভাগ যক্ষ্মা, ৯০ ভাগ ম্যালেরিয়া রোগীই তৃতীয় বিশ্বে। একইভাবে শিশু ও প্রসূতি মাতার মৃত্যুসংখ্যার ৯৮ ভাগই ঘটে অনুন্নত এবং স্বল্পোন্নত দেশে।
এইসব অনুন্নত এবং স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। এসব দেশগুলোতে দারিদ্র্যের কারণে স্বাস্থ্যমান নিচে নেমে যাচ্ছে। দারিদ্র্যের এই রোগগুলো মানুষকে আরো গভীরভাবে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ করছে। ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুধুমাত্র এই ঘাতক রোগগুলোর কারণে সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোর জিডিপি কমেছে শতকরা ১.৩ ভাগ। এ অঞ্চলে এইডস্ একক রোগ হিসাবে সবচেয়ে বেশি এবং দ্রুত প্রভাব ফেলছে। ধ্বস নামাচ্ছে অর্থনীতিতে, সমাজ কাঠামোয় এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায়। ইউএনডিপির মতে, এইডসের কারণে শ্রমবাজারে মানসম্মত শ্রমিক এবং সরবরাহ দুটোই কমছে।
যা অদক্ষ, অনভিজ্ঞ এবং অপেক্ষাকৃত কম বয়সী শ্রমিকের যোগান বাড়াচ্ছে। আফ্রিকায় এইডস্ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য বেড়েছে। নারীরা নানা রকম অমানবিক, অসামাজিক কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। শিশুশ্রম বেড়েছে।
ছেলেমেয়েদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আফ্রিকায় অনেক স্কুল ছাত্র-শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। দারিদ্র্যের কারণে স্থানান্তর বাড়ছে। পুরো সাব-সাহারা অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা এখন মারাত্মক হুমকির মুখে।
জাতিসংঘের মতে, পৃথিবীতে প্রায় চার কোটি মানুষ এইডসে আক্রান্ত, প্রতিদিন প্রায় ৭হাজার ৪‘শ মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। মোট আক্রান্তের ৬০ ভাগই নারী এবং ৯৬ ভাগ গরীব দেশের। বছরে প্রায় ২০/২৫ লাখ মানুষ এই রোগে মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশ, চীন, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান এবং ভারতে এইডস দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। পুর্ব এশিয়াসহ ভারত এবং বাংলাদেশে এইডস আক্রান্তদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই নারী। যৌনকর্মী। এদের মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হচ্ছে। আরো ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শতকরা ৬০/৬৫ ভাগ মানুষেরই এইডস বিষয়ে কোনো সচেতনতা নেই। বাংলাদেশ, পাপুয়া নিউগিনি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নেপালে দেখা গেছে, স্বল্প শিক্ষিত যৌনকর্মী এবং তাদের খদ্দেররা অতিমাত্রায় এইচআইভি ঝুঁকিপ্রবণ। কিন্তু বাংলাদেশসহ অধিকাংশ স্বল্পোন্নত দেশেরই এইডস মহামারী মোকাবেলার তেমন কোনো সামর্থ্য নেই। বিশ্বব্যাপী বয়স্ক জনসংখ্যার পরিমাণ, ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্রমবর্ধমান হারে ঔষধের কার্যকারিতা হ্রাস এবং নতুন নতুন রোগের আর্বিভাব হচ্ছে। এইসব সমস্যাগুলো মোকাবেলায় সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া দরকার। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ না বাড়িয়ে এই সব সমস্যা মোকাবেলা করা যাবে না। এই দুটো খাত সরাসরি জাতীয় উন্নয়নের বুনিয়াদ গঠন করে। বাংলাদেশে জিডিপির মাত্র ১.৫% স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা হয়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করে ১৬%। বিশেষজ্ঞদের মতে, জিডিপির কমপক্ষে ১৫% স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা উচিৎ।
পৃথিবীর অনেক দেশেই এইডস প্রতিরোধ এবং দারিদ্র্র্য বিমোচন এখন সমার্থক। তাই জাতিসংঘ ‘সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষমাত্রায়’ দারিদ্র্য বিমোচন এবং এইডস প্রতিরোধে জোর দিয়েছে। নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে বিগত দশকগুলোতে বিভিন্ন দেশে দারিদ্র্য দুরীকরণকে সামগ্রিক পরিকল্পনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেও সুফল পায়নি।
স্বাস্থ্যখাতে সক্ষমতা নির্ভর করে (ক) স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানসমুহের কার্যক্রমের উপর। (খ) নতুন প্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, অধিকতর বিনিয়োগ এবং শ্রমের যোগানের উপর। কারণ স্বাস্থ্যের উন্নতি অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলে। তাই প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং লক্ষ্যাভিমুখী রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই স্বাস্থ্যব্যয় সাধারণের সক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, প্রশিক্ষণ, এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতের সমস্যা অনেক। এসবের মধ্যে (১) জনসংখ্যা বৃদ্ধি (২) দারিদ্র্য (৩) রোগ-বালাই প্রবণ অঞ্চল (৪) অপর্যাপ্ত বাজেট (৫) দুর্বল পেশাগত নৈতিকতাবোধ (৬) স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব ইত্যাদি। তবে এগুলো পরস্পর সম্পর্কিত।
বাংলাদেশে বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্য সমস্যা, দারিদ্র্য এবং এইডস সবই বর্তমান। দারিদ্র্যের ছয়টি রোগও বিরাজমান। আছে ভণ্ডপীর, ভেজাল ঔষধের কারখানা, কারবারি। আছে দুর্নীতি, অবহেলা, উদাসীনতা। সব কিছুর পরেও আমাদের বাঁচতে হবে, মানুষকে বাঁচাতে হবে। শিক্ষা কারিক্যুলামে এইডস এবং অন্যান্য কালান্তক ব্যাধি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া যেতে পারে। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের মতো এইডস নিয়ন্ত্রণেও ধর্মীয় উপাসনালয়কে কাজে লাগানো যেতে পারে।
স্বাস্থ্যসেবা বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে নয়ম বরং সরকারের হাতে রেখেই জনগণের চাহিদা মেটানো দরকার। এটা কোনো সহজ কাজ নয়। বর্তমান বিশ্বে সব দেশের জন্যই এটি একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। অংশগ্রহণমুলক স্বাস্থ্য নীতিমালা প্রণয়নে সরকারি বেসরকারি সংস্থাসমুহ, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় করতে হবে। মুনাফালোভীরা সব দেশেই আছে। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। পুঁজিবাদীদের পকেটে রেখে দেশ চালাতে পারলেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব। পুঁজিবাদীদের পকেটে থেকে কখনই সম্ভব নয়।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১২
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর, জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]