এক. যে কোনো মূল্যায়নেই জুলাই গণ অভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসের অন্যতম সাড়াজাগানো ঘটনা। এই অভ্যুত্থানে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমেছিল কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটাতে।
সন্দেহ নেই, মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি বহু ক্ষেত্রেই এক পথে হাঁটে না। বাংলাদেশের ইতিহাস আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। পদ্মা মেঘনা যমুনাপাড়ের এই জাতি বারবার আশায় বুক বেঁধেছে। কিন্তু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক ঘোচানো কখনোই সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে। কিন্তু গণতন্ত্র এ দেশে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত একটি বিমূর্ত বিষয়। কাজির গরু খাতায় থাকলেও যেমন গোয়ালে থাকে না, গণতন্ত্রের অবস্থাও তেমনি। এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানের সেনাপতিশাসকদের অস্বীকৃতির কারণে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও গণতন্ত্র বিমূর্ত বিষয় থেকে যায়। ’৯০-এর গণ অভ্যুত্থান আমাদের গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন উবে যেতে সময় লাগেনি। মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও আমরা সে জয়কে ধরে রাখতে পারিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সুফল গিলে খেয়েছে অসৎ মানুষরা। আমজনতা শুধু বঞ্চিত হয়েছে। ’২৪-এর গণ অভ্যুত্থান জাতির সামনে যে স্বপ্নকল্প সৃষ্টি করেছিল, এক বছরের ব্যবধানে তা ‘সকলি গরল ভেল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে দেশের সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমেছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে রেহাই পেতে। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রতিদিনই কমছে। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম। ব্যবসায়ীদের অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার বদলে কমছে। মনে পড়ছে একটি গানের কথা। ‘জিনিসের দাম বেড়েছে মানুষের দাম কমেছে হায়রে কপাল করব কি?’ এটি কিশোর কুমারের একটি অতি বিখ্যাত গানের কলি।
৫ দশক আগে যে গান সাড়া জাগিয়েছিল ওপার বাংলায়। বাংলাদেশেও মানুষের মনে দাগ কাটে গানটি। গত দুই বছর দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের আয় হ্রাস পেয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নামার ঝুঁকিতে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জনতার ঢল নেমেছিল যেসব কারণে তার অন্যতম হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। জীবন-জীবিকার সংগ্রামে বিপর্যস্ত মানুষ মনে করেছিল লুটেরা স্বৈরাচারের পতন হলে চাল, ডাল, তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম কমবে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা যে মহাসংকটে পড়েছে, তা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যে কোনো সাফল্য আসেনি তা অস্বীকারের উপায় নেই। মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ নেই। খাদ্যের দাম চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। আমাদের দেশে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এক অশনিসংকেত। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। গত এক বছরে লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে। বন্ধ হয়েছে গার্মেন্টসহ অনেক কলকারখানা। আইনশৃঙ্খলার অবনতি পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলছে। ব্যবসায়ীরা রয়েছে মহাবিপদে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি দূরের কথা, সংকটের মুখে রয়েছে দেশের প্রায় সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। পৌনে ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনে জনমনে যে আশা জেগে উঠেছিল তা হতাশায় পরিণত হচ্ছে। অনেকেই বলছেন আগেই ভালো ছিলাম।
সন্দেহ নেই বর্তমান সরকার দায়িত্ব হাতে নিয়েছে এক দুঃসময়ে। বৈশ্বিক মন্দা গ্রাস করছে জগৎবাসীর শান্তি। ইউক্রেন ও গাজায় রাশিয়া ও ইসরায়েলের আগ্রাসন বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা ডেকে এনেছে, তা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না অনেক অগ্রসর দেশ। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায় তাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এ কঠিন সময় মোকাবিলায় সরকারকে সুবুদ্ধি ও সুবিবেচনার পথে হাঁটতে হবে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানোকে নিতে হবে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। দেশের উৎপাদন খাতকে সচল করতে ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলার রাশ টেনে ধরতে হবে শক্তভাবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সরকার যে পুরোপুরি ব্যর্থ, তা এক বাস্তবতা।
দুই. ২৪-এর গণ অভ্যুত্থান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের সময়ের সবচেয়ে তোলপাড় করা ঘটনা। ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান কিংবা ’৯০-এর গণ অভ্যুত্থান যারা দেখেছেন, তারা স্বীকার করবেন এত মানুষ কোনো দিন রাজপথে নামেনি। গণ অভ্যুত্থানের পর দেশবাসীর সমর্থন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু সে আশা হতাশায় পরিণত হতে সময় লাগেনি।
ইতোমধ্যে এ সরকার দেশের সবচেয়ে ব্যর্থ সরকারের তকমা কিনেছে। ছাত্ররা আন্দোলন করে সচিবালয়ে ঢুকতেই তারা পেয়ে গেল অটো পাস। বলা হলো কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা সরকারের কাজ নয়। কিন্তু যমুনার সামনে কিছু লোক জড়ো হতেই পাল্টে গেল সিদ্ধান্ত। গত এক বছরে বিচারক পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে মবের ভয়ে। মব জাস্টিস নামের অসভ্য এবং বর্বর শব্দ আমাদের দেশ ও সমাজের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষ এ অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। এজন্য চায় নির্বাচন। আমি জানি না নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র আসবে কি না। তবে জানি, নির্বাচন হলে দেশে রাজনৈতিক সরকার আসবে। তাদের কাছে মানুষের জীবন-জীবিকা ও প্রত্যাশা মূল্য পাবে। নির্বাচনের পর গঠিত সরকার সদিচ্ছা নিয়ে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে সেটি হবে সোনায় সোহাগা।
সরকার ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু নানা অজুহাতে এ ব্যাপারে অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে।
রাষ্ট্র সংস্কারের বেশ কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার যে কসরত চলছে তা ব্যর্থ হতে চলেছে। রাষ্ট্র সংস্কার হতে হবে রাষ্ট্রের মালিক-মোক্তার দেশবাসীর ইচ্ছা অনুসারে। সোজা কথায় এ বিষয়টি নির্বাচিত সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। তার বদলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা নিঃসন্দেহে ‘মন্দের ভালো’। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণকারী বিএনপি-জামায়াতসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে হলেও এটির গঠনপ্রক্রিয়া ও কার্যক্রম কী হবে, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের মতো আর্থিক দুরবস্থায় থাকা একটি দেশে আরেকটি ব্যয়বহুল নিম্নকক্ষের ‘রেপ্লিকা সংসদ’ তৈরি করা কতটা দরকার, তা-ও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ ও সংরক্ষিত নারী আসন-সব ক্ষেত্রেই পিআর পদ্ধতি চালুর পক্ষে দাবি তুলেছে কিছুু দল। বিএনপিসহ কিছু দল সাফ সাফ বলে দিয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে তাদের সায় থাকলেও আনুপাতিক হারের নির্বাচন মানা হবে না। পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি গঠন নিয়েও কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে এখন পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আনুপাতিক হারের নির্বাচন এশিয়া মহাদেশে প্রথম চালু হয় মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে জেঁকে বসা ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলে। দক্ষিণ এশিয়ার নেপালে এ পদ্ধতি চালু রয়েছে রাজতন্ত্র পতনের পর। এ পদ্ধতি হিমালয়কন্যা নেপালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই শুধু নিশ্চিত করেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের নামে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ১৮ কোটি মানুষের এ জাতি মেনে নেবে না।
পাদটীকা : মির্জা আবু তালিব বেগ বা শায়েস্তা খান ছিলেন বাংলার সুবেদার। সুবেদার শব্দটির বাংলা প্রদেশ বা রাজ্যপাল। বাংলা শব্দের চেয়ে ইংরেজি প্রতিশব্দ গভর্নর বরং আমাদের মতো বয়স্কদের কাছে বেশি সহজবোধ্য। কারণ ইংরেজ শাসনামলে এ দেশ ব্রিটিশ রাজার গভর্নর দ্বারা শাসিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলেও গভর্নর ছিলেন পাকিস্তানি প্রভুদের প্রতিনিধি। আইউব খানের আমলে তাঁর গভর্নর মোনায়েম খান মোসাহেবির জন্যে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। বলছিলাম শায়েস্তা খানের কথা। তিনি ছিলেন দিল্লির মোগল সম্রাট শাহজাহানের শ্যালক। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা। শায়েস্তা খান দুই মেয়াদে সুবেবাংলা বা বাংলা প্রদেশের সুবেদার ছিলেন। প্রথমবার ১৬৬৪ থেকে ১৬৭৮ এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ১৬৮০ থেকে ১৬৮৮ সাল। শায়েস্তা খান ছিলেন মোগল বাহিনীর অন্যতম দক্ষ সেনাপতি। বাংলাদেশের সুবেদার হিসেবে তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হলো চট্টগ্রাম বিজয়। আমাদের প্রধান বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শায়েস্তা খানের আগে ছিল আরাকান রাজার শাসনাধীন। যত ভালো সেনাপতিই হোন, বাংলাদেশের সুবেদার হিসেবে আসার আগে শায়েস্তা খান এমন এক ট্র্যাজেডির সম্মুখীন হন, যা তাঁকে সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ১৬৬০ সালে বিদ্রোহী মারাঠা রাজা ছত্রপতি শিবাজীকে দমনে সম্রাট আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে দায়িত্ব দেন। মারাঠাবীরের কূটকৌশলে শায়েস্তা খান হেরে যান। তাঁর এক প্রিয় পুত্রের প্রাণ যায় সেই যুদ্ধে। ছত্রপতি শিবাজীর যোগ্যতাকে খাটো করে দেখার খেসারত দিতে হয় মোগল সেনাপতিকে। বলা হয়ে থাকে, শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। এখন প্রতি কেজি চালের দাম প্রায় ১০০ টাকা। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেই আমলেও মানুষ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারাত। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধের চেয়েও মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যবসাবাণিজ্যে যে অচলাবস্থা চলছে তা রোধে সাহসী ভূমিকা নিতে হবে। মানুষের যদি আয় না থাকে তবে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া গেলেও তা কারও পেটে ভাত জোগাবে না।
লেখক : সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন