ঢাকা, রবিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ জুলাই ২০২৫, ০১ সফর ১৪৪৭

মুক্তমত

দেশবাসীর প্রত্যাশা, কথা রাখবেন ড. ইউনূস

অদিতি করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৪৭, জুলাই ২৬, ২০২৫
দেশবাসীর প্রত্যাশা, কথা রাখবেন ড. ইউনূস ড. ইউনূস

কথা দিয়ে কথা রাখা, বিশ্বাস এবং অঙ্গীকার পূরণ মানুষের মহামূল্যবান সম্পদ। আস্থা এবং বিশ্বাসের ওপর পৃথিবী চলে।

আস্থা এবং বিশ্বাস একজন মানুষকে বড় করে, মহীয়ান করে। পৃথিবীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যাঁরা জীবনে সফল হয়েছেন, যাঁরা জীবনে কর্মক্ষেত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁরা সবাই কথা রেখেছেন, অঙ্গীকার পূরণের ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়েছেন। কথা দিয়ে কথা রাখার মাধ্যমে চারপাশের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করেন। এ বিশ্বাস, আস্থা তাঁর কর্মপথ করে মসৃণ এবং তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায় সাফল্যের শিখরে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সে রকমই একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর সারা জীবন যা অঙ্গীকার করেছেন, তা পূরণ করেছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর যখন ক্ষুধা-দারিদ্র্যের জন্য নতুন করে সংগ্রাম করছে, দুর্ভিক্ষ এবং অভাব-অনটন মানুষকে চরম বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে গেছে, সে সময় ‘জোবরা গ্রামে’ একটি গবেষণার জন্য গিয়েছিলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক। কিন্তু অভাবী মানুষের বেদনা, ক্ষুধা, হতাশা দেখে তিনি আবেগতাড়িত হয়েছিলেন। হয়েছিলেন বিচলিত। তখনই তিনি শুরু করেছিলেন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। তিনি তখন সংকল্প করেছিলেন, এ ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের জীবন পাল্টে দেবেন। সেই কথা তিনি রেখেছেন। অবিচল থেকেছেন তাঁর নিজের অঙ্গীকারে এবং আস্তে আস্তে তিনি জোবরা গ্রাম থেকে দারিদ্র্যমোচনের সংগ্রাম বিস্তৃত করেছেন দেশজুড়ে। এসেছে নানা রকম প্রতিকূলতা, বাধাবিপত্তি। কিন্তু তিনি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। এ অঙ্গীকার পূরণই তাঁকে শক্তিশালী করেছে, মহিমান্বিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে করেছে সম্মানিত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর সব মহান ব্যক্তিত্বের মতোই একজন, যিনি মানুষকে যে কথা দিয়েছিলেন, সেই অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি দরিদ্র মানুষের জীবন পাল্টে দেবেন। তাদের মানবেতর জীবন থেকে টেনে তুলবেন। দরিদ্র মানুষের সন্তানরা যেন শিক্ষা লাভ করতে পারে, তারা যেন স্বাস্থ্যসুবিধা পায় সেজন্য তিনি বহুমাত্রিক উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। সেসব পরিকল্পনা তিনি একে একে বাস্তবায়ন করেন। যার ফলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন একটি ইমেজ তৈরি হয়েছে, সবাই জানে যে তিনি যখন একটি কথা দেন, তখন সে কথাটি পূরণ করার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। মেধা-মনন দিয়ে সেই অঙ্গীকার পূরণের চেষ্টা করেন। এটাই ড. ইউনূসকে মহিমান্বিত করেছে।

আমরা দেখি যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম যখন সারা দেশে বিস্তৃত হয়েছে, তখন তিনি শুধু বাংলাদেশের গি তে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বহির্বিশ্বেও দারিদ্র্যমোচনের জন্য কাজ শুরু করেন। তাঁর নিরলস পরিশ্রমের কারণে বিশ্বের দেশে দেশে এখন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম জনপ্রিয়। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামরত মানুষের কাছে আরেকটি অঙ্গীকার করেছিলেন। তা হলো প্রত্যেকেই যেন উদ্যোক্তা হয়ে ওঠে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য রূপান্তরের এক চ্যালেঞ্জিং মিশন গ্রহণ করেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ মিশনের নাম ‘সামাজিক ব্যবসা’। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মানুষের ভাগ্য বদলের নতুন সংগ্রাম শুরু করেন। সামাজিক ব্যবসা এখন বিশ্বে দেশে দেশে জনপ্রিয়। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বদলে যাচ্ছে মানুষের ভাগ্য। চাকরির আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষ এখন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, সংগ্রাম করছে। এ সংগ্রামের সাহস এবং অনুপ্রেরণার নাম ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অধ্যাপক কখনোই আগ্রহী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত হোক। এক সুন্দর সাম্যের বাংলাদেশে সব নাগরিক সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করুক। কিন্তু বাংলাদেশ যখন স্বৈরাচারের থাবায় ক্ষতবিক্ষত হলো, যখন এ দেশের মানুষের অধিকার হরণ করা হলো, যখন মানুষ তার ন্যূনতম সুযোগসুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল তখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর চুপ থাকতে পারেননি। তিনি অঙ্গীকার করেন বাংলাদেশকে একটি বাসযোগ্য স্থান হিসেবে গড়ে তুলবেন। সেই বাসযোগ্য স্থান হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। জুলাই বিপ্লবের পর শিক্ষার্থীরা যখন তাঁকে দেশের এ ক্রান্তিকালের কাণ্ডারি হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন, সেই অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, দেশকে একটি বৈষম্যমুক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করাবেন। বাংলাদেশের নবযাত্রার সূচনা করবেন। যার নাম ‘নতুন বাংলাদেশ’। সে লক্ষ্যেই প্রায় এক বছর ধরে কাজ করে চলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সরকারের নানা রকম সীমাবদ্ধতা, ত্রুটিবিচ্যুতির পরও সাধারণ মানুষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আস্থাশীল। তারা মনে করেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস মানুষের ভাগ্য বদলে দেবেন। এ দেশের মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন এবং একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বিনির্মাণের সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবেন। আর সে কারণেই দেশের মানুষের আস্থা, বিশ্বাস তাঁর ওপর এখনো অটুট আছে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক কার্যক্রম নিয়েই জনমনে অসন্তোষ, বিতর্ক রয়েছে। যেসব উপদেষ্টা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা এখনো কেন স্বপদে বহাল রয়েছেন তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন। সমাজ মাধ্যমে তাঁদের নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। এ সরকারের অনেক কার্যক্রম নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। সরকার কে চালাচ্ছে সে রকম কথাও বলছেন সুশীল সমাজের অনেক প্রতিনিধি। এ সরকারকে ‘শিশুতোষ সরকার’ হিসেবেও আখ্যায়িত করছেন কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী। কিন্তু এ সবকিছু ছাপিয়ে সাধারণ মানুষ এখনো একটি বিষয়ে একমত। তা হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসই এ মুহূর্তে যোগ্য নেতা। যিনি বাংলাদেশকে এ সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে কাঙ্ক্ষিত শান্তির বন্দরে নিয়ে যেতে পারেন। আর এ কারণেই সরকারের বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাস রয়েছে। এ আস্থা এবং বিশ্বাস থাকার প্রধান কারণ হলো তাঁর অতীত ইতিহাস। তিনি কখনোই ওয়াদার বরখেলাপ করেননি। যে অঙ্গীকার করেছেন তা পূরণ করেছেন সর্বোচ্চ মেধা-ত্যাগের বিনিময়ে।

বাংলাদেশ এখন এক মহাসংকটে। আর এ সংকট উত্তরণের প্রধান উপায় হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণের ক্ষমতা জনগণ ফিরে পাবে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলে দেশের মানুষের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে এবং বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে রূপরেখা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তৈরি করে দিয়েছেন, সে রূপরেখা অনুযায়ী দেশ এগিয়ে নেবে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে আমরা দেখছি টালমাটাল অবস্থা। নানা মত, নানা পথে নির্বাচনের যাত্রাপথ অনিশ্চিত। কোনো কোনো মহল দেশে নির্বাচন হোক তা চায় না। আর এ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণেই দেশের সংঘাত, সহিংসতা, মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে। এ অবস্থা উত্তরণের জন্য দেশকে নির্বাচনের পথে যেতেই হবে।

গত জুনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরে গিয়েছিলেন। সে সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে তারেক রহমান এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনা করেন। বাংলাদেশের সমস্যা উত্তরণের পথ নিয়ে তাঁরা কথা বলেন। এ সময় এ দুই জনপ্রিয় ব্যক্তি একমত হন যে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা উচিত। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে একটি স্বস্তির বাতাস বয়ে গিয়েছিল। মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল। মানুষ মনে করেছিল খুব দ্রুত একটি নির্বাচন হবে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ সহজ হবে। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ অঙ্গীকার বানচাল করার জন্য যেন একটি মহল তৎপর।

আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কথাই বলতে পারি। এ কমিশন একের পর এক বৈঠক করছে। অনেক সিদ্ধান্ত জোর করে রাজনৈতিক দলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে এটা অনুধাবন করতে কোনো সমস্যা হয় না যে এ কমিশন হয়তো দেশে নির্বাচন যেন না হয় সে চেষ্টা করছে। শুধু ঐকমত্য কমিশন নয়, কয়েকটি রাজনৈতিক দলও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। আর এ কারণে জনগণের মধ্যে হতাশা, উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, যাঁরা নির্বাচন পেছাতে চেয়েছেন তাঁরা সুস্পষ্টভাবে ড. ইউনূসের শুভাকাঙ্ক্ষী নন। ড. ইউনূসের যে ইমেজ, তাঁর সারা জীবনের যে অর্জন তা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় এ গোষ্ঠী। আর এ কারণেই দেশবাসী আশা করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব বিভ্রান্তির চোরাগলিতে আটকে পড়বেন না। বিভ্রান্তকারীদের কথায় তিনি তাঁর অঙ্গীকারের বরখেলাপ করবেন না। বরং তিনি সব সময় যেভাবে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, অসম্ভব সম্ভব করেছেন ঠিক তেমনিভাবেই সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করবেন। ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করবেন। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে নেতৃত্ব দিয়ে নিজেকে অমর করবেন।

বিশ্বের কোনো দেশেই সংকট উত্তরণের শর্টকাট পদ্ধতি নেই। চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার দিয়ে দেশ কোনো দিন সংকটমুক্ত হয় না। সংকটমুক্তির পথ একটাই। তা হলো জনগণের শক্তিতে বলীয়ান হওয়া। জনগণ যেন ঐক্যবদ্ধভাবে সংকট মোকাবিলায় কাজ করতে পারে, সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। আর সেটি করা সম্ভব কেবল একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিজ্ঞ মানুষ। তিনি সব জানেন, বোঝেন। এ সংকট উত্তরণের পথও তিনি জানেন। প্রধান উপদেষ্টা জানেন তিনি যদি শেষ পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে না দিতে পারেন, তাহলে তাঁর সারা জীবনের অর্জন বিসর্জন হবে। আর এ কারণেই সবাই আশা করে দেশবাসীর প্রত্যাশা তিনি পূরণ করবেন। ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করে জাতিকে অনিশ্চয়তার হাত থেকে মুক্ত করবেন। কারণ ড. মুহাম্মদ ইউনূস কথার বরখেলাপ করেন না। এ কারণেই তিনি আজকের এ উচ্চতায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।