প্রতিদিন সকালে জাতীয় দৈনিকগুলো দেখে মন ভরে যায়। অনেক দৈনিকেরই প্রথম পৃষ্ঠা, শেষ পৃষ্ঠা জুড়ে অনেক খবর পাওয়া যায় যেগুলোর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ প্রকাশিত খবরের সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে।
বাংলানিউজের নিজেরই একটি বিশাল পাঠক শ্রেণী রয়েছে। তারা যে খবর আজ পড়ছেন তা পরের দিনের জন্য তাদের কাছে বাসি। বাংলানিউজ আজ যে ছবি প্রকাশ করেছে তাও পাঠকরা পরের দিন সংবাদপত্রে হয়তো দেখতে চাইবেন না। এটা বলবো না সংবাদপত্র প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু সংবাদপত্রকে তাদের খবর প্রকাশে কৌশলী হওয়ার সময় এসেছে। আর সেটা মাথায় রেখেই সংবাদপত্রগুলোর উচিত সংবাদ পরিবেশনার ঢং পাল্টে ফেলা। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটছে তা হচ্ছে সংবাদপত্রগুলো প্রায়শঃই বাংলানিউজের খবর স্রেফ কাট-পেস্ট করছে। ছবি বসিয়ে দিচ্ছে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হচ্ছে বাংলানিউজকে ক্রেডিট না দিয়ে।
কিছু সংবাদপত্র বাংলানিউজকে ক্রেডিট দিয়ে খবর ও ছবি প্রকাশ করছে, এবং এগুলোর মধ্যে গুটি কয়েক সংবাদমাধ্যম বাংলানিউজকে কিছু অর্থও দেয়। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এই সংবাদপত্রগুলো বাংলানিউজের খবর ও ছবি ব্যবহারের এখতিয়ার রাখে।
নাম উল্লেখ না করেই বলছি, দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সংবাদপত্রগুলো আজকাল বাংলানিউজের খবর ও ছবি আকছার চুরি করছে। কাট অ্যান্ড পেস্টের কল্যাণে তারা অতি সহজেই পেয়ে যাচ্ছে তৈরি করা খবর। তার জন্য তাদের রিপোর্টার নিয়োগ করতে হচ্ছে না। এডিটরের কাজ নেই। কোনো ঘটনায় সেরা ফ্রেমের সেরা ছবিটিও হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে। স্রেফ সেভ ইমেজ অ্যাজ-এ গিয়ে নিজের কম্পিউটারে সেভ করার কষ্টটুকু করতে হয়। আর ইউনিকোডে লেখা খবর কপি করে তা বাংলায় পছন্দের বা প্রয়োজনের ফন্টে রুপান্তরের জন্য অনলাইনেই পাওয়া যায় ফ্রি সফটওয়্যার। একটি খবর সংগ্রহ ও তা লেখা এবং এডিট করার কষ্টটুকু যখন না করে পারা যাচ্ছে তখন এই সামান্য কষ্টটুকু করতে নিশ্চয়ই রাজি থাকছেন সংবাদপত্রগুলোর রিপোর্টার, সাব এডিটররা।
সর্বসম্প্রতি আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন ও তার পরবর্তী ঘটনাপূঞ্জের ওপর বাংলানিউজের লেখা ও ছবি কিছু সংবাদপত্র নিলর্জ্জের মতো নিজেদের নামে প্রকাশ করেছে।
এখানে দুটি ছবির কথা বলছি যা রাজধানীর কারওয়ানবাজার থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রের ২৭ নভেম্বরের সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তাদের নিজেদের ফটোসাংবাদিকের নামে। অথচ দুটি ছবিই ওই সংবাদপত্রটি পাঠকের হাতে পৌঁছার অন্তত ১৫ ঘণ্টা আগে বাংলানিউজে প্রকাশিত হয়। যা তুলতে বাংলানিউজের ফটো সাংবাদিককে ঘটনাস্থলে টানা ২০ ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে। একটি ভালো ছবির জন্য ফটোসাংবাদিক এ কষ্ট স্বীকার করবেনই। কিন্তু ওই দৈনিকটি স্রেফ সেভ ইমেজ অ্যাজের সুবিধা নিয়ে বাংলানিউজের ছবি নিজেদের নামে প্রকাশ করে দিয়েছে। তাদের ফটো সাংবাদিককে কোনোই কষ্ট করেত হয়নি। বিষয়টি লজ্জার।
ওই ঘটনার পর একটি আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থার ঢাকা ব্যুরো অফিসও বাংলানিউজের ছবি কোনো অনুমতি ছাড়া তাদের সাইটে রিলিজ করে। যা ওয়াশিংটনপোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিশ্বের আরও কিছু নামকরা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। পরে বিষয়টি নজরে আনলে ওই আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাটি নিজেদের আর্কাইভ থেকে ও দুয়েকটি সংবাদপত্রের আর্কাইভ থেকে ছবিগুলো তুলে ফেলতে বাধ্য হয়।
কিন্তু দেশের মিডিয়াগুলোর ক্ষেত্রে এমনটা কখনোই হচ্ছে না। কোনো কোনো দিন এমনও হয়েছে বাংলানিউজের একটি ছবি তিনটি বা চারটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই বলেছে ছবিটি তাদের নিজের। এখানে বাংলানিউজ যদি নিশ্চুপও থাকে কিংবা ছবিটি বাংলানিউজের যদি নাও হয় তাহলে তিনটি পত্রিকার যে কোনো দুটি অবশ্যই অন্যের ছবি চুরি করেছে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয়নি কারণ সংবাদপত্রগুলোর চেয়ে কেউ ভালো জানে না যে ওই ছবিটি তাদের নয়। আর সত্য হচ্ছে ওই ছবিটি বাংলানিউজের ফটো সাংবাদিকের তোলা।
এসব যে নতুন হচ্ছে তা নয়। বাংলানিউজকে ছবি বা খবর নিয়ে এমন ঘটনা ঘটছে শুরু থেকেই। ২০১১ সালের ১১ জুলাইয়ে মিরসরাই ট্রাজেডিতে ৪৫ স্কুল শিক্ষার্থীর প্রাণহানির পর উদ্ধার তৎপরতার একটি ছবির উদাহরণ তুলে ধরা যাক। ওই দিন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বাংলানিউজের অনলাইনে প্রকাশ করা হয়, ‘বিজয়ের হরিষ নিমিষে বিষাদ’ শিরোনামে একটি লেখা। মিরসরাই প্রতিনিধি রিগান উদ্দিনের লেখায় ছবিটি ব্যবহার করা হয় চট্টগ্রাম ব্যুরো অফিসের সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধরের। উদ্ধারকারী নৌবাহিনীর তিন ডুবুরি চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধার তৎপরতা। লাশের পাশাপাশি তারা পানিতে ভেসে থাকা কতগুলো জুতো তুলে রাখেন খাদের পাশে। সেই জুতোগুলো ও তিন ডুবুরির ছবি ক্যামেরাবন্দি করেন উজ্জ্বল ধর। ‘একটি ছবি হাজার শব্দের কথা বলে’ তার আরও একটি প্রমাণ এই ছবি।
সংবাদকর্মী মাত্রই এ ছবিতে আকৃষ্ট হবেন সেটাই স্বাভাবিক। ঘটনার পরের দিন দৈনিকগুলোর অন্তত চারটিতে ওই ছবিটি প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর মধ্যে তিনটি সংবাদপত্রই ছবিটি নিজেদের দাবি করে প্রকাশ করে। একটি মাত্র পত্রিকা তাতে বাংলানিউজের ক্রেডিট দেয়। ওই পত্রিকাটি বাংলানিউজের নাম ব্যবহার করায় বাকিদের লজ্জায় না হোক ধন্ধে পড়ে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।
আর খবর বা ফিচার কোনো ধরনের ক্রেডিট ছাড়া সরাসরি প্রকাশ করা এখন নৈমিত্যিক বিষয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ দিনে আট/দশটি খবর কপি করে হুবহু তুলে দিচ্ছেন নিজেদের পত্রিকায়। একটিরও ক্রেডিট দিতে চান না। কেউ আবার দুটি/একটি ক্রেডিট দিয়ে প্রকাশ করে বাকিগুলো অনায়াসে নিজেদের নামে ব্যবহার করছেন।
ধন্যবাদ এই সংবাদপত্রগুলোকে কারণ তারা বাংলানিউজের সংবাদ ও ছবি প্রকাশ করছেন। তবে আরও আন্তরিক ধন্যবাদ জানানো যেতো যদি তারা এগুলো ব্যবহারে বাংলানিউজের বৈধ পাওনা হিসেবে এর নামটি ব্যবহার করতেন। কারণ এটি গণমাধ্যমের খুব প্রাথমিক একটি নৈতিকতা।
তবে এখানে একটি প্রসঙ্গ তুলে ধরতেই হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ও দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে হয় বলে বাংলানিউজের খবরে কিছু ভুল বানান, কখনো ভুল বাক্য এবং কখনো কখনো ভুল তথ্যও প্রকাশিত হয়ে যায়। নজরে আসার পর তা সংশোধনও করা হয়। কিন্তু যেসব সংবাদপত্র দ্রুত বাংলানিউজ থেকে খবরটি কপি করে নেন তারা আর ভুলটি সংশোধন করেন না। ফলে পরের দিন যখন সংশ্লিষ্ট কেউ সেই ভুল নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন ওই পত্রিকাগুলো কিছুই বলতে পারে না। কারণ তারা খবরটি প্রকাশ করেছে নিজেদের স্টাফ করেসপন্ডেন্টের নামে। আর বাংলানিউজে ব্রাউজ করলে দেখা যাবে ততক্ষণে সে ভুলটি সংশোধন করা হয়েছে।
শুক্রবারে প্রকাশিত একটি খবরের কথাই ধরা যাক না। বাংলানিউজে মার্কিন দূতাবাসের কনসুলার বিভাগের প্রধান এই পদবিটিকে ভুলক্রমে কনসাল জেনারেল লেখা হয়। পরে বিষয়টি নজরে এলে দ্রুত তা কারেকশনও করা হয়। কিন্তু শনিবারে দেখা যায় বাংলানিউজের খবরটি নিজেদের নামে প্রকাশ করেছে অন্তত চারটি সংবাদপত্র যারা পদবিটি কনসাল জেনারেলই রেখেছে। অথচ মার্কিন দূতাবাসে কনসাল জেনারেল নামে কোনো পদই নেই।
কাট-পেস্টেও কিছু যোগ্যতা লাগে। কিছু সময় ব্যয় করতে হয়। কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়। একটি সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন এক বন্ধু সম্প্রতি বিষয়গুলো স্বীকার করে নিয়ে বলছিলেন, শিগগিরই সংবাদপত্রে এমন ‘কাট-পেস্ট সম্পাদক’ পদে লোক নিয়োগ করতে হবে।
বাংলাদেশ সময় ১৮৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১২
এমএমকে[email protected], [email protected]