প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভিয়েতনাম ও রাশিয়া সফর করেছেন। রাশিয়া বাংলাদেশকে আট হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় ঋণ দেবে।
জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ বিচারে মুসলিম বিশ্ব তথা মধ্যপ্রাচ্য সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবিদার। কারণ, রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক উন্নয়নে প্রয়োজন দুদেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন। সে ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের মানুষের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও মূলবোধ্যের মিল ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে ও করবে। জনশক্তি রপ্তানি আমাদের উন্নয়নে অন্যতম গুরুত্ব বহন করছে। তাই জনশক্তি রপ্তানির বাজার সৃষ্টি আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্কের অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। এ সকল বিচারে পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্ব হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ গুরুত্বের।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদ- হয়ে উঠছে প্রবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্স। তাদের পাঠানো বিরাট অঙ্কের রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতি টিকে আছে। কিন্তু, এই শ্রমিকেরা প্রবাসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসে এসব শ্রমিকের থাকা খাওয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও সম্ভব হয় না। বাহরাইনে একটি ভবনে আগুন লেগে সম্প্রতি মারা গেছেন ১১ জন শ্রমিক।
সরকারি হিসাবে এখন সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের ৮০ লাখ অভিবাসী রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যাই এর চেয়ে কম। এই ৮০ লাখ অভিবাসী রয়েছেন বিশ্বের ১৪৩টি দেশে। যদিও তাদের ৯০ শতাংশকে পাওয়া যাবে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, মালয়েশিয়া, লিবিয়া ও সিঙ্গাপুরে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য যে ছয় হাজার ৮৭ জন দেশ থেকে বের হন, তাদের বেশির ভাগেরই গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য। প্রতিবছরই এই হার বাড়ছে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম বড় উৎস। ২০১১ সালে তারা পাঠিয়েছেন এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি অর্থ। এই অর্থ আমাদের জিডিপির ১৪ শতাংশ। এমনকি সেটা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ১৩গুণ এবং তথাকথিত বৈদেশিক উন্নয়ন সাহায্যের ছয় গুণও বটে!
বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরবে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। সৌদি আরব বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার হলেও নানা কারণে সেদেশে জনশক্তি রফতানি হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ লোক সৌদি আরবে গেলেও গত চার বছরে মাত্র ৩০ হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরবে গেছেন। তবে নেপাল ও ভারত থেকে এখনো জনশক্তি আমদানি করা অব্যাহত রেখেছে সৌদিআরব। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হওয়ায় ১৯৭৬ সাল থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি শুরু করে এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জনশক্তি বা শ্রমিকের সংখ্যাই ছিল সর্বোচ্চ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার বাংলাদেশি বৈধভাবে কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন। এরমধ্যে ২৩ লাখ ৭১ হাজার সৌদি আরব, ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫৯ জন সংযুক্ত আরব আমিরাত, ৪ লাখ ৭৭ হাজার কুয়েত, ৩ লাখ ৮৫ হাজার মালয়েশিয়া এবং ২ লাখ ৫৭ হাজার ওমান গেছেন।
মালয়েশিয়ার পামবাগানের জন্য ৩০ হাজার কর্মী নিয়োগের খবর সারা দেশেই একধরনের উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ইরাক, কুয়েত, কাতার, লিবিয়াও বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশের শ্রমিক আমদানি। এই বিপর্যয়ের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার শুধু বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ করেছে। গত চার বছর ধরে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির সবচেয়ে বৃহৎ বাজার সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত ও কাতারে জনশক্তি রফতানি বন্ধ আছে। প্রতি বছর আরব আমিরাতে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় তিন চার লাখ কর্মী পাঠানো হতো। কিন্তু ২০১২ আগস্ট মাসের শেষের দিকে সেদেশে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ নানা অজুহাতে হঠাৎ করেই বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে পৃথিবীর বহু দেশে বৈধ অবৈধসহ অবস্থানগত ও কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় এক কোটি পনের লাখ। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই প্রায় আশি লাখ বাংলাদেশি রয়েছে। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যাই এক কোটির নীচে। তাই জনশক্তি রফতানিকে মাথায় রেখে পররাষ্ট্র সম্পর্ক নির্ধারণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ।
আগামী ২০২২ সালে ধনী দেশ কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হবে। সেজন্য কাতারে অত্যাধুনিক প্রায় ৩৫টি স্টেডিয়াম নির্মাণসহ নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন খাতে ১০ লক্ষাধিক বিদেশি শ্রমিক প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কাতারে দক্ষ শ্রমিক রফতানির সুযোগ নিতে পারে।
আমেরিকা-ভারতের সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থাকা সত্ত্বেও এদেশগুলোর প্রতি আমাদেও নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আমাদের পররাষ্ট্র সম্পর্কের সবচেয়ে দুর্বল দিক। ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের অনবরত চেষ্টা বর্তমান সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। অথচ ভারতের সাম্প্রতিক আচরণ কোনোভাবেই বন্ধুসুলভ বলা যায় না। ফারাক্কা, টিপাইমুখ ও আন্তঃনদী সংযোগ দিয়ে পানি আগ্রাসন, কাঁটাতারের বেড়া ও বিএসএফের সীমান্ত আগ্রাসন, আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো নিষিদ্ধ রেখে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রেখে অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালাচ্ছে ভারত। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত ও মানবাধিকার ক্ষুন্ন হওয়া বিপদ জনক সীমান্ত। ইসরাঈল-ফিলিস্তিন সীমান্তেও প্রতি বছর এতো মুসলিম হত্যা হয় না। গত একদশকে ১০০০ এর বেশি ও শুধু ২০১২ সালে বিএসএফ ৩৮ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। বিএসএফ ইদানিং ককটেল মারছে, দরজা খুলে ঘরে ঢুকে নির্যাতন করছে, গাছে ঝুলিয়ে পেটাচ্ছে, ন্যাংটা করে পেটাচ্ছে, বেয়নেট খুঁচিয়ে জখম করছে, কুপিয়ে মারছে। ভারত একা নয়, মায়ানমারও আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও জালানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। কিন্তু, মায়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের তেমন কোনো বাস্তবমুখী পদক্ষেপ আমরা দেখছি না।
মধ্যপ্রাচ্য শুধু আমাদের জনশক্তির বাজার নয়, আমাদেও ঔষধ ও সবব্জি রপ্তানির এক বিশাল বাজার। আমাদের ৯০ ভাগ জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম আমদানি হয় মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো থেকে। এছাড়া আমাদের দেশে কোনো প্রকার দাদাগিরি ছাড়া যে সকল নিঃশর্ত সাহায্য ও অনুদান বা দান আসে তা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে । আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (মসজিদ-মাদ্রাসা) লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষা, বই-পুস্তক, খাদ্য ও অন্যান্য সুযোগ পায় মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সাহায্য থেকে। ২০০৭ সালের বন্যার সময় আমরা দেখেছি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সৌদি নাগরিক বিশাল অঙ্কের দান করেছিলেন। আমাদের উপলব্ধি করা উচিত, কী ছিল আমাদের প্রতি তার টানের উৎস! তিনি কী মুহম্মদ (স) এর এই বাণী উপলব্ধি করেছিলেনÑ“মুসলিম উম্মাহ একই শরীরের অংশ”।
মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে নতুন করে জনশক্তি রপ্তানি করতে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বর্তমান সরকারের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী গত বছর ওআইসির সম্মেলনে গেলেন না। মুসলিমদেশ ও মুসলিমদের সংগঠনের প্রতি তার এতো বিতৃষ্ণা কেনো! অথচ এটি জাতিসংঘের পর বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংগঠন। রোহিঙ্গা সমস্যা সংশ্লিষ্ট দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবের সঙ্গে এ ফোরামে আলোচনা করে রহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেত। সরকার চাইলে মুসলিম বিশ্ব থেকে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে আমাদেও দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে আগ্রহী করা সম্ভব।
লেখক: মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
এমএমকে