ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

৩৪৫ খুনের যাবজ্জীবন ‘পুরস্কার’

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৩
৩৪৫ খুনের যাবজ্জীবন ‘পুরস্কার’

সম্ভবত ৯১/৯২ সালে রামপুরা থেকে বের হয় সাপ্তাহিক আকর্ষণ। মালিক ছড়ালেখক সৈয়দ আল ফারুক।

আমি নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে। আমার সহকর্মী ছিলেন শিল্পী সৈয়দ ইকবাল, কামাল মাহমুদ, পীর হাবীবুর রহমান প্রমুখ। তখন আকর্ষণের প্রচ্ছদ কাহিনী করা হয়েছিল- কুখ্যাত গোলাম আযমকে নিয়ে। তখন গোলাম আযমের একটা ছবির জন্য মগবাজারে গেলে কাদের মোল্লা ড্রয়ার থেকে গো. আযমের এক গাদা রঙিন ছবি রেব করে দেয়। আমি বললাম, এতো ছবি কেন? কুখ্যাত কাদের মোল্লা বলেছিলেন, লেখার ভেতরে বাঁশ দিলেও হুজুরকে তো আপনারা ফোর কালারে ছেপে ঘরে ঘরে ড্রয়িং রুমে স্থান করে দিচ্ছেন! তাই, যেটা ভাল্লাগে সেটা নিন। আমি কাদেরের কথা শুনে থ মেরে গিয়েছিলাম। আজ আবার থ মেরে থু দিলাম।

মনে পড়লো- কবি কাজী রোজীর কথা। তাঁর কাছে কসাই মোল্লার ভয়াবহ কাহিনী শুনেছি। রোজী আপা আমার দীর্ঘ দিনের প্রিয় প্রতিবেশী ছিলেন। আমার বাসা মিরপুর-৬ ডি ব্লকে আর তিনি থাকতেন মিরপুর-৬ সি ব্লকে। ছুটির দিন বা সান্ধ্যবিকেলের অনেক আড্ডায় কবিতা নিয়ে কথা বলতে বলতে সিকানদার আবু জাফর থেকে শুরু করে শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব, কবি মেহেরুন্নেসার স্মৃতিচারণ করতেন। কাদের মোল্লার নিষ্ঠুরতার বর্ণনার করতে করতে তাঁর চোখ ভিজে যেতো। আজ কাজী রোজী কুখ্যাত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষী, ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু এ বিচারের রায়  মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে, এ রায় মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদের রক্তকে অপমান করার রায়।

তাই দিকে দিকে তীব্র প্রতিবারের ঝড় উঠেছে। এ রায় মানি না, মানবো না। কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। মনে হচ্ছে- `বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা`।

সারাদেশে, বিদেশে, মিডিয়ায়, অনলাইনে, টুইটারে, ফেসবুকে ঘৃণা-নিন্দার আগুন জ্বলছে। আমি নিজেও হতাশ হয়ে বেশ কিছু স্ট্যাটাস দিয়েছি। সেই গুলোই তুলে ধরতে চাই।

কারণ, এ রায়ের পর অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। যেমনঃ

ক] বাচ্চু রাজাকার পলাতক। সে কীভাবে পালালো? অনুপস্থিত পালাতকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আর বান্দা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন! গণহত্যার অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি!!

খ] সংসদে সাংসদ মইনউদ্দিন খান বাদল বলেছেন, মা-বোনের সতিত্ব, নিজেদের অস্তিত্ব এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে আমরা কারও সঙ্গে সমঝোতা করি না, কোনো আপস হতে পারে না। তাহলে কিসের আঁতাত, কিসের আপস?

গ]  রায়ের আগের দিন হঠাৎ করে পুলিশ-শিবিরের শান্তিপুর্ণ ‘বন্ধুত্ব’! রাজধানীসহ সারাদেশে মিছিল-সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ায় সন্দেহের উদ্রেক প্রকাশ করে স্বয়ং বিএনপি।

ঘ] তাহলে কি জামায়াত বিএনপিকে ‘তালাক’ দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘর সাজাবে?

ঙ] কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে  ছয় সুনিদৃষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ অপরাধের মধ্যে ৫টিই প্রমাণিত। তারপরও ৩৪৫টি খুনের শাস্তি কি যাবজ্জীবন সাজা! কেনো? রহস্যটা কী!

রায়ের আগে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, ৩৪৫টি খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। কিন্তু তা হয়নি। ঘৃণিত চিকন আলীরা এভাবেই ‘পুরস্কৃত’ হয়।

এই রায়ে তে শুধু দেশবাসীই নয়; আইনমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, তথ্য মন্ত্রীসহ একাধিক সাংসদ রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন! কারণ, এ রায় ন্যায়ের রায় নয়।

রায়ের আগে ফেসবুকে লিখেছিলামঃ
“আজ সবাইকে খবর দে,/ রাজাকারদের কবর দে। / জয় বাংলা জয় শুনি রব,/ একাত্তরের খুনি সব.../ আল বদরের ফাঁসি চাই,/ সন্তান হারার হাসি চাই। / বিচার হবে, সাজা কার?/ যেই শালারা রাজাকার!”

কিন্তু রাত জেগে রায় পেলাম- খুনির পক্ষের রায়। টিভিতে দেখলাম- খুনি কসাই কাদের হাসছে। দুই আঙ্গুল তুলে বিজয় প্রকাশ করছে। বিজয় তো বটেই। রাজাকারদের বিজয় আর মুক্তিযোদ্ধাদের পরাজয়। এ পরাজয় বিএনপির কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যায়; কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে না!

তাই মনের দুঃখে লিখেছিলাম, ক) ‘আমি যদি ৩৩০ সংসদ সদস্য (কাদের মোল্লার মতো ৩৪৫ বাঙালি) নিধন করি; তাহলে তো আমার শাস্তি আরো কম হবে’। খ) গোলাম আযমের `নাগরিকত্ব` রায়ে ছিলেন বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে `বিব্রতবোধ` করেন। আজ আবার হাবিবুর রহমানদের উত্তরসুরী বিচারপতি ওবায়দুল হাসানেরা কসাই কাদের মোল্লাদের বাঁচিয়ে দেন।

গ) যুক্ত করছি বন্ধু লুফর রহমান রিটনের অসাধারণ ছড়াটিঃ
“রেপ করেছ? ভয় নাই!
খুব অপরাধ হয় নাই।
খুন করেছ? আচ্ছা।
তুমিই বাঘের বাচ্চা!
তোমার বিচার করব
তোমায় জেলে ভরব!
আদালতের রায়—
তোমার পক্ষে যায়!
আমজনতা যতই চেঁচাও নইতো পেরেশান
এই বিচারের মানটা হলো আন্তর্জাতিক মান!
তিন শতাধিক খুন করেছ? তাতে কী যায় আসে!
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঘাতক-খুনি হাসে!
তিরিশ লক্ষ শহীদ কাঁদলে কী আর এমন ক্ষতি?
শাবাশ শাবাশ ট্রাইব্যুনাল আর শাবাশ বিচারপতি!”

পুনশ্চ
এখন বাঙালির সংগ্রামের মাস, ভাষা আন্দোলনের মাস চলছে।   তাই জামায়াতে সাবেক আমির গো.  আযমের সহধর্মিণী আফিফা আযম বলেছেন, ভাষার মাসে ভাষা আন্দোলনের সেনাপতি অধ্যাপক গোলাম আযমকে আটক রাখা বাংলাভাষাকে অবমাননার শামিল।

তাই, সকল শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে (আমার বাবার নাম মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) গো. আযমের মুক্তি দাবি করছি এবং গো.  আযমকে ‘একুশে পদক’ দেয়ার দাবি জানাচ্ছি!

লেখক: কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক, [email protected]

বাংলাদেশ: ১০৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৩
আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।