শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে দেশের প্রধান বিরোধীদল এবং সবচেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার দল বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানতে সময় লেগেছে সাত দিন। এই সময়ে দলের নেতারা বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য রাখলেও তা ছিলো তাদের ব্যক্তিগত মত।
এইসব বক্তব্য গণমাধ্যমে কমবেশি আলোচিত হলেও বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে কি বলে সেই বিবৃতির অপেক্ষায় ছিলো সবাই। অবশেষে শাহবাগ আন্দোলনের এক সপ্তাহ পূর্তির রাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে গণমাধ্যমে সেই বিবৃতি পাঠানো হয়। দলের দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী ওই বিবৃতিতে সই করেন।
কিসের নিন্দা কিসের প্রতিবাদ?
যদি ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ হয় তাহলে বিবৃতির শিরোনামই বলে দেয় বিবৃতিতে কি আছে। ছয়শ ৮৭ শব্দের বিবৃতির শিরোনাম: ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নিন্দা ও প্রতিবাদ’।
গত কয়েকদিন বিএনপি নেতাদের নানামুখি বক্তব্যের পর এই শিরোনামে যখন বিবৃতিতে বলা হয়, তরুণদের ‘এই উচ্ছ্বাস ও আবেগের প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সবসময়ই ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে এসেছে‘ তখন তাদের কাছে তা কতোটুকু ইতিবাচক তরুণ প্রজন্মের নিশ্চয়ই সেই প্রশ্ন আছে। বিএনপির অবস্থান কতোটুকু ইতিবাচক তাও বোঝা যায় যখন ওই বিবৃতিতেই বলা হয়: ‘তরুণদের দাবির যৌক্তিকতা থাকতেই পারে’। এমন দায়সাড়া বক্তব্যে তরুণদের দাবি দল হিসেবে বিএনপির কাছে কতোটুকু যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য তাও স্পষ্ট।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
এটা বাস্তব গত চার বছর বিএনপিকে সরকার খুব একটা স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। সরকার যেমন সবকিছুর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র খোঁজার চেষ্টা করেছে, তেমনই ‘কেষ্টা ব্যাটাই চোরে’র মতো সবকিছুর জন্য সরকারকেই দায়ী করেছে বিএনপি। নিজেদের আদর্শিক অবস্থান আর তরুণদের হৃদয় পড়তে না পারার কারণে শাহবাগের গণজাগরণ ঘিরেও তাই সরকারের ষড়যন্ত্র দেখতে পেরেছে প্রধান বিরোধীদল।
এজন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি বলছে: ‘তরুণদের এই দাবি মহল বিশেষ দলীয়করণ করার সর্বাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচেছ। তরুণদের উচ্ছ্বাসকে একদলীয় অখ- কর্তৃত্বাধীন করার জন্য ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের কুটিল ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি নীলনকশায় তরুণদের এই আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার বিষয়টি ইতোমধ্যে জনগণের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। ’
এমন অভিযোগ কে করছে? সেই দল করছে যে দলের কোনো প্রতিনিধি একবারের জন্যও শাহবাগ যাননি। যে দলের সভা-সমাবেশ থেকে গণজাগরণের পরও একবারও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতো দূরের কথা, বিচারের দাবিও উঠেনি। যে দল ক্ষমতায় থাকার সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করার জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামকেও রক্তাক্ত করেছে। যে দল ক্ষমতায় থাকার সময় এই আন্দোলনের উদ্যোক্তা জাহানারা ইমামসহ বরেণ্য ব্যক্তিদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছে।
ফাঁসির দাবিতে ফ্যাসিবাদের প্রতিধ্বনি!
এটা কোনা লুকোছাপার বিষয় নয় যে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে দুয়েকটি পত্রিকার কপিতে প্রতিকি আগুন দেওয়া হয়েছে, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বয়কটের আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রতিবাদের এই ভাষা স্বতঃস্ফূর্ত থাকলেও বিএনপির অভিযোগ ‘শাহবাগ চত্বরের সমাবেশ স্থলে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা আমার দেশ, নয়াদিগন্ত, সংগ্রাম পত্রিকায় অগ্নিসংযোগ করেছে এবং পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেয়ার জন্য প্রতিদিন হুমকি দিচ্ছে। পাশাপাশি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে নির্ভিক স¤পাদক মাহমুদুর রহমান ও গণতন্ত্রের স্বপক্ষে আপোষহীন উচ্চকন্ঠ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ড. পিয়াস করিমকেও নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়েছে। ‘
কেউ যদি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে শাহবাগ থেকে তার জন্য ‘ফ্লাইং কিস’ পাঠানো হবে না এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি হয়তো ভুলে গেছে মাহমুদুর রহমান একগুঁয়েমি করার পরও তার পক্ষে লেখালেখি করেছেন সেই ব্লগারদের অনেকে যারা শাহবাগের ঐতিহাসিক আন্দোলনের পুরোধা। তখন মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে মাহমুদুর রহমানের পক্ষে দাঁড়ালেও ব্লগাররা যে এখন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এর একমাত্র কারণ মাহমুদুর রহমান শুধু যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেই দাঁড়াননি, পত্রিকার নামে লিফলেট প্রকাশ করে একাত্তরের ‘দৈনিক সংগ্রামে‘র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বিএনপি তার বিবৃতিতে ‘৭৫-এর একদলীয় ফ্যাসিবাদের সু¯পষ্ট প্রতিধ্বনি’ যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছে তাও মাহমুদুর রহমানের পত্রিকার ব্যানার হেডলাইন থেকেই ধার করে নেওয়া। বিএনপি যাই বলুক, ওই এক শিরোনামই বলে দেয় মাহমুদুর রহমানের জন্য শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কি ব্যবস্থাপত্র দেওয়া উচিত।
আর যে ডক্টর পিয়াস করিমকে বিএনপির বিবৃতিতে ‘দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী’ বলা হয়েছে তিনি আসলে গত কয়েক বছরে টেলিভিশন টক-শো’র একজন নিয়মিত টকার ছাড়া আর কিছু নন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তিনি জনগণের চাওয়াই প্রধান এবং একমাত্র সমাধান বললেও শাহবাগ আন্দোলন প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, কোনো মঞ্চ থেকে শাস্তি ঠিক করে দেওয়া যাবে না। উচিত কথা। তাহলে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে জনগণের চাওয়ার কথা বলে মুখে ফেনা উঠিয়ে ফেলেন কেনো? আর যদি জনগণের চাওয়াই মুখ্য হয় তাহলে এখানে তিনি গণজাগরণ নিয়ে সমালোচনামুখর কেনো?
তরুণ প্রজন্ম অবশ্য এরইমধ্যে পিয়াস করিমের পিতৃপরিচয় জেনে গেছে। সন্তান যে পিতার মতোই হবে তা নাও হতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি; তাই পিয়াস করিম বিএনপির কাছে ‘দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী’ হলেও শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি সেই ব্যক্তি যার আদর্শিক পিতা জামায়াতি রাজনীতি যে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে নতুন প্রজন্ম। তাই পিয়াস করিম যেমন শাহবাগের আন্দোলন দেখে সহ্য করতে পারছেন না, তেমনই শাহবাগের আন্দোলনকারীরাও তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এটাই স্বাভাবিক।
বাংলা পরীক্ষায় কেমিস্ট্রি
ফেইসবুকে এরইমধ্যে একটি পোস্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে নিশ্চয়ই। তাতে এইরকম প্রশ্ন যে শাহবাগ আন্দোলনে আরও অনেক ইস্যু যোগ করা হচ্ছে না কেনো? উত্তরটি এইরকম যে এখন বাংলা পরীক্ষা, তাই আগে এটা শেষ হোক; কেমিস্ট্রি পরীক্ষার সময় কেমিস্ট্রি নিয়ে আলোচনা করা যাবে। খুবই সহজ এবং সাধারণ সমীকরণ।
কিন্তু আসলে বিএনপি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা শেষ পর্যন্ত যেহেতু যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তাই তারা শাহবাগের জন্য প্রলাপের মতো আরও অনেক ইস্যু নিয়ে এসেছে। সীমান্ত হত্যাকা- ছাড়াও পদ্মাসেতু, শেয়ারবার্জা, হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেংকারি, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম ও আমিনুল ইসলামের গুম হওয়া এবং অতীতে সিরাজ শিকদারসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যার কথা উল্লেখ করে এসব ইস্যুও শাহবাগে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি।
সবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিও শাহবাগে যোগ করার আহ্বান জানিয়ে বিএনপির বিবৃতিতে বলা হয়েছে: ক্ষমতাসীন দল ছাড়া সারাদেশে দল-মত-শ্রেণী-পেশার সকল মানুষ আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার। একমাত্র নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষ তার নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার স্বাধীনতা লাভ করে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্তর্নিহিত শক্তি ছিলো বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রেরণা। চিরায়ত গণতন্ত্রের মধ্যেই মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার নিশ্চিত হতে পারে। তাই তরুণদের এই আন্দোলনে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপনে দাবির বিষয়টি থাকলে এটি আরো সার্থক হয়ে উঠতো। ’
বিএনপির বিবৃতির শেষদিকে বোঝা গেলো তাদের আসল চাওয়া, যুদ্ধাপরাধীর বিচার ইস্যু দূরে রেখে শাহবাগকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মঞ্চে পরিণত করা; যে মঞ্চ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি তুলে ধরা হবে। ধান ভানতে শিবের গীতের মতো এভাবে শাহবাগ আন্দোলনে বিএনপির সব এজেন্ডা যোগ করার প্রস্তাব একদিকে যেমন আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা তেমনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু আড়াল করারও অপচেষ্টা। বিএনপির বোঝা উচিত তারা যে এতোদিন এতোসব গরম ইস্যু পেয়েও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি, তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের বক্তব্য পৌঁছাতে পারেনি তার অন্যতম কারণ তাদের আন্দোলনে অংশীদার যুদ্ধাপরাধী জামায়াত; যে জামায়াতের নেতাদের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দাবিতে এখন ঐতিহাসিক এক আন্দোলন গড়ে তুলেছে নতুন প্রজন্ম।
(দ্বিতীয় কিস্তিতে থাকবে বিএনপির দ্বিতীয় বিবৃতির পর্যালোচনা এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়)
জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই ([email protected])