সানিউর রহমান সানি নামে এক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। যদিও কিছু পত্রিকায় ‘ব্লগার’ বলা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তিনি ব্লগে লিখতেন কিনা আমি নিশ্চিত নই।
আমি তাকে চিনতাম কিনা সেটাও নিশ্চিত ছিলাম না। পরে ফারজানা কবির স্নিগ্ধার পাঠানো লিঙ্ক থেকে জানলাম তার ফেসবুক-নেম। সঙ্গে সঙ্গে মনেও পড়ে গেলো কিছু স্মৃতি।
ছেলেটার সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। গতবছর বইমেলায় দেশে থাকাকালে। আমি দেশে এসেছি শুনে তিনিই যেচে দেখা করেছিলেন। আমার সঙ্গে ছেলেটিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আরেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বাংলাদেশ যুক্তিবাদী সমিতির একটি ছেলে –এন. সি. নীল। এইটুকুই। তারপর ভুলেও গিয়েছিলাম তার কথা।
আজ দুপুরে ফেসবুকে ঢুকে জানলাম তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তার স্ট্যাটাসে এবং পেপারে ‘সানিউর রহমান’ থাকায় ধরতে পারিনি প্রথমে। কিন্তু এখন মনে পড়েছে অনেক কিছুই। আসলে তার লেখালেখি আমাকে আগ্রহী করেনি, বরং লেখায় ‘শো অফ’ করার এক ধরনের টেন্ডেসি দেখে বিরক্তই হয়েছিলাম, সরিয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। ফেসবুকে আমার বন্ধু তালিকাতেও তাকে গ্রহণ করিনি আমি। কিন্তু তার সম্বন্ধে যাই মনে করি না কেন, লেখার জন্য তাকে ছুরিকাঘাত করে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হবে, সেটা কখনোই মনে আসেনি।
সানিউর নিজেকে নাস্তিক বলুক আর যাই বলুক, তার লেখা আমার পছন্দ হোক আর নাই হোক, তিনি তো কাউকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেননি, কাউকে হুমকি-ধামকি দেননি। নিজের মতো করে লেখালেখি করেছেন, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা পেইজে, গ্রুপে শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন, আমরা সবাই যেমন করছি। অথচ তার এই ক্ষুদ্র বিচরণে ভয়ে ভীত হয়ে উঠলো প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আবারো।
কেন সানিউর আক্রান্ত হলেন? পাঠকদের হয়তো স্মরণে আছে, রাজীব মারা যাওয়ার পরপরই আমি একটি লেখা লিখেছিলাম–‘কেন কেবল তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন?’ শিরোনামে। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এ প্রকাশিত সে লেখায় বলেছিলাম কিছু কথা যা কিনা আবারো খুব প্রাসঙ্গিক –
বাংলাদেশে মুক্তমনা লেখকদের জীবন হাতে নিয়ে লেখালেখি করতে হয়। লেখালেখি তো অনেকেই করেন এবং বহু বিষয়েই, কিন্তু আমরা দেখছি ক্রমাগতভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন তারাই যারা ধর্মীয় কুসংস্কারকে ক্রিটিক্যালি দেখছেন, কিংবা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেছেন। বাংলার কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্ববরকে ‘সত্যের সন্ধান’ বইটি লেখার কারণে শাসক শ্রেণীর গ্রেফতারি মামলা ও মত প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও কম নিগৃহীত হতে হয়নি তাকে। কবীর চৌধুরী, আলি আসগর, আহমদ শরীফদের এক সময় মুরতাদ আখ্যা পেতে হয়েছে, তসলিমাকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, তার মাথার দাম ধার্য করা হয়েছে, এমনকি ফতোয়াবাজ আমিনী এও বলেছিলেন - তসলিমা নাসরিনের কোনো লেখা আমি পড়িনি, তবে তার ফাঁসি চাই`। তসলিমাকে অতঃপর দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, হুমায়ুন আজাদকে চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রলম্বিত মৃত্যুর দিকে চলে যেতে হয়েছে, আর আজ আসিফ মহিউদ্দীনদের হতে হচ্ছে ছুরিকাহত, আর রাজীবকে তো গলাকেটে মেরে ফেলা হলো। অথচ ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর আর্টিকেল-১৯ এ পরিষ্কার বলা আছে -
“Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers.”
বাংলাদেশের সংবিধানেও (অনুচ্ছেদ ৩৯ দ্রঃ) কিন্তু ‘প্রজাতন্ত্রে নাগরিকদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সুরক্ষিত’ থাকার উল্লেখ আছে সুস্পষ্টভাবেই। অথচ তারপরেও মুক্তচিন্তার লেখকেরা তাদের মতপ্রকাশের কারণে আক্রান্ত হন, নির্যাতিত হন, কিংবা বিপন্ন-বোধ করেন।
যে ধারায় আসিফ মহিউদ্দীন ছুরিকাহত হয়েছিলেন, যে ধারায় রাজীব নিহত হলেন, সেই একই ক্রমধারায় আঘাত নেমে এলো সানিউরের ওপরেও। মোটিভটা পরিষ্কার – বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইছে পিশাচেরা। কিন্তু এভাবে কি কণ্ঠরোধ করা যায়?
স্মরণ করি ‘মাস্টার এণ্ড মার্গারিটার’ বিখ্যাত উদ্ধৃতি –‘পাণ্ডুলিপি পোড়ে না’। মুক্তচিন্তককে আক্রমণ করা যায়, কিন্তু তার চিন্তাকে নাশ করা যায় না। মুক্তপথের সৈনিকদের ওপর ক্রমাগত আগ্রাসনে বোঝা যাচ্ছে, এখন আর ব্লগার এবং ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্টদের প্রভাবকে তারা অস্বীকার করতে পারছেন না। মুক্তচিন্তার প্রসারে তারাই আসলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, তাই বেছে নিয়েছে সহিংসতার পথ। সামান্য কলম আর কিবোর্ডের গতি রুখবার জন্য তারা বেছে নিয়েছে ছুরি, চাপাতি আর আদিম তলোয়ারের পথ। আব্দুল গফফার চৌধুরী যেমনিভাবে তার একটি কলামে লিখেছিলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের শক্তিকে অনেক বড় করে দেখে সেক্যুলারিস্টদের ভীত হওয়ার কিছু নেই। এদের হাতে প্রচুর ক্যাডার, সুইসাইড স্কোয়াড আছে - এটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য জামায়াতিদেরই প্রচার। সরকার কঠোর হলে দেখবেন, এরা একদল কাপুরুষ-ঘাতক ছাড়া আর কিছু নয়’।
যারা কলমের শক্তিতে ভীত হয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে চাচ্ছেন, যারা ‘মসির চেয়ে অসি বড়’ মনে করে ভাবছেন, মুক্তচিন্তার আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে, তাদের জন্য করুণা হচ্ছে। যতোবার আমরা আহত হব, ততো দ্বিগুণ শক্তিতে আমরা ফিরে আসবো, দাবানলের মতোই গ্রাস করে ফেলবো চারিদিক। প্লাবনে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধ চোরাগলি।
আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি
আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই
আমি অগ্নিগিরির কাছে জ্বলতে শিখেছি
আমায় আর জ্বালানোর ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই।
সানিউরের সুস্থতা কামনা করছি।
ড. অভিজিৎ রায়- আমেরিকা প্রবাসী গবেষক, ব্লগার এবং মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ‘ভালবাসা কারে কয়’ সহ (শুদ্ধস্বর, ২০১২) সাতটি আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন ভিত্তিক বইয়ের লেখক।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৩
সম্পাদনা: শিমুল সুলতানা, নিউজরুম এডিটর /[email protected]