ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আ’লীগের ইচ্ছেঘুম বনাম শাহবাগ আন্দোলন

জিনিয়া জাহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০১ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৩
আ’লীগের ইচ্ছেঘুম বনাম শাহবাগ আন্দোলন

কাদের মোল্লা নামক ঘৃণ্য রাজাকারের বিচার প্রত্যাখান করে তার ফাঁসির দাবিতে ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে এক এক করে জড়ো হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা তরুণ প্রজন্ম। দলমত নির্বিশেষে সবাই এ কথা এক বাক্যে স্বীকার করে নিতেই হবে যে, এখন পর্যন্ত এ আন্দোলন শতভাগ অহিংস।



শাহবাগের সমর্থক কেউ দেশের কোথাও কোনও অরাজকতা করেনি। বরং অরাজকতা যাতে সৃষ্টি না হয় সে জন্য তারা সকলকে বিনীত অনুরোধ করেছে। হরতালের মত দেশ পঙ্গু করে দেওয়া কর্মসূচি প্রতিহত করার জন্য সকলকেই আহবান জানিয়েছে।

কিন্তু শাহবাগের এই অহিংস আন্দোলনকে থামিয়ে দেবার লক্ষ্যে জামায়াত-শিবির নামক ধর্ম ব্যবসায়ী দলটি সহিংস ঘৃণ্য নীল নকশা তৈরি করে। নীল নকশায় খুনী বাহিনীর প্রথম টার্গেট হল ‘থাবা বাবা’ নামক একজন বিতর্কিত ব্লগার। যেহেতু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির সর্বাগ্রে ব্লগাররা, কাজেই শাহবাগ আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে একজন ব্লগারকে বেছে নেওয়াই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। শুরু হয় রক্তের রাজনীতি।

“শাহবাগ হল ইসলামের বিরুদ্ধচক্র নাস্তিকদের মিলনমেলা” এই প্রপাগাণ্ডাটি দু-একটি পত্রিকা ও ফেসবুকের দ্বারা অতি সহজেই এই ঘৃণ্যচক্রটি ছড়িয়ে দেয়। সাধারণ জনগণের মাঝে যারা মূলত ইন্টারনেট, ব্লগিং এই জাতীয় বিষয় সম্পর্কে খুব বেশি জ্ঞাত নয়, তারা মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে কিংবা এর ওর মুখে শুনেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, দেশে বোধহয় ইসলামের বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে, ইসলাম নাকি ধ্বংসের মুখে!!

ইসলাম রক্ষার এই কল্পিত মিশনে কিছু বুঝে না বুঝেও হারাতে হয় নিরীহ কিছু তাজা প্রাণ। খুব সহজেই দেশের মানুষকে আস্তিক-নাস্তিক এই দু ভাগে ভাগ করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে দিয়ে ঘৃণ্যচক্রটি চরমভাবে সফল হয়।

কাদের মোল্লার ফাঁসি না হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান সাধারণ জনগণ যে শাহবাগে একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, সেটা সরকারবাহিনী কোনও রকম ধারণাই করতে পারে নি। দূরদর্শিতার অভাবে আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে নিশ্চুপ থাকলেও পরে কিছু কিছু নেতা শাহবাগে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। পরবর্তীতে ব্লগার থাবা বাবার হত্যার পর শাহবাগের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সফলভাবেই নিজেদের জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়। আর আওয়ামী লীগের এই হঠাত্‍ শাহবাগ প্রীতি স্বাধীনতাবিরোধী ঘৃণ্যচক্রকে শাহবাগের আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে দ্বিতীয় মোক্ষম হাতিয়ারটি ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়।

শুরুতে শাহবাগের আন্দোলনকারীরা কোনও দলীয় নেতাকে সঙ্গে নেবে না এমন ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার কারণে বিভিন্ন দলের অনেক নেতা শাহবাগে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে যায়। কোনও দলকেই সঙ্গে নেবনা এই ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা ধীরে ধীরে মিইয়ে আসতে শুরু করে।  

কালজয়ী স্লোগান "জয় বাংলা" যেহেতু বিএনপি নামক দলটির কাছে জখমের মধ্যে নুনের ছিটার মত যন্ত্রণাদায়ক, কাজেই বিএনপির অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্বেও শাহবাগে আন্দোলন থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে। আর খালি মাঠে গোল দেবার মতই আওয়ামী লীগের যদু-মধু-কদু সবাই ব্লগার সেজে অনেক কসরতে ঠেলাঠেলি করে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়।

গণআন্দোলনকে দলীয় করার জন্য আওয়ামী লীগের যেমন কূটচাল কাজ করেছে ঠিক তেমনি রাজনীতির মারপ্যাচে শাহবাগের গণজাগরণের অনভিজ্ঞ নেতারাও তাদের মঞ্চে ছাত্রলীগের নেতাদের স্থান করে দিতে বাধ্য হয়েছে। সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে যদি দাবি আদায় করা যায় তাহলে তো খুবই ভাল। কিন্তু সরকারি দল দিয়ে যদি ব্যবহৃত হয়ে জনগণের বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা করা হয় তবে তার পরিণাম দেশের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না।

পাঠক লক্ষ্য করুন গত একুশে ফেব্রুয়ারি শাহবাগে আন্দোলন থেকে ছয় দফা দাবির জন্য নিচের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়:

১. ঘাতক জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ রাজীব হায়দার, জাফর মুন্সী, বাহাদুর মিয়া, কিশোর রাসেল মাহমুদ হত্যাকাণ্ডে  জড়িতদের আগামী সাতদিনের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে।

২.  ছাব্বিশে মার্চের পূর্বে  স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক সন্ত্রাসী জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে সংশোধিত  আইনের অধীনে অভিযোগ গঠন এবং নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

৩. অবিলম্বে সংগঠনগুলোর আর্থিক উৎস, যেসব উৎস থেকে  সকল প্রকার জঙ্গিবাদী এবং দেশবিরোধী তৎপরতার আর্থিক যোগান দেওয়া হয়, সেগুলো চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।

৪. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া গতিশীল ও অব্যাহত রাখতে অবিলম্বে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যনালকে স্থায়ীরূপ দিতে হবে।

৫. গণমানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও তাণ্ডবে বন্ধে অবিলম্বে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে সকল সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ গোপন আস্তানাসমূহ উত্‍খাত করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদের ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ করে দিতে হবে।

৬. যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষক এবং হত্যা ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।     

এই সব দাবির মধ্যে এক থাবা বাবার হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা ছাড়া অন্যগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার আদৌ কী কোনও ব্যবস্থা নিয়েছে? ২৬ মার্চ আসতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি আছে। গণমানুষের দাবি পূরণে সরকার কী আদৌ আন্তরিক? যদি আন্তরিকই হবে তবে আমরা কোনও রকম কার্যক্রম শুরুর লক্ষণ দেখছি না কেন? আমরা কী রাস্তায় থেকে যাব যতদিন না এই সরকারকে পুর্ননির্বাচিত করে আনা না হয়?

দেশে একের পর এক নিরীহ ব্যক্তির খুন, সংখ্যালঘুদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার, ট্রাইবুন্যালে সাক্ষ্য দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বিপণ্ণ, গনজাগরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তির স্বজনদের একের পর এক খুন, স্থবির অর্থনীতি এত কিছুর পরেও সরকার নামক মসনদে বসা আওয়ামী লীগ দলটির নীরবতা সত্যি অত্যন্ত দুঃখজনক।  

সত্যি কষ্ট হয় যখন দেখি আন্দোলনের দাবি দাওয়াকে পাশ কাটিয়ে পুরো দেশের ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তার মুখে ঢেলে দিয়ে  আওয়ামী লীগ ইচ্ছে করেই গভীর ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে!!! আগামী নির্বাচন না আসা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এই ইচ্ছে ঘুম কী আদৌ ভাঙ্গবে? নাকি ঘুম ভাঙ্গলে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখা বন্ধ হবে জেনেই ইচ্ছে ঘুম আরও প্রগাঢ় হবে?  উত্তর পাব কী?
zinia-zahid-1
জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।