স্বপ্ন দেখছি কি না বুঝতে পারছি না। নাকে কড়া একটা গন্ধ।
ভোরের ভেজা আলে পা ভিজিয়ে মটরশুঁটি খাওয়া হয় দল বেঁধে। মৌলানারা আগের রাত থেকেই কোরান শরিফ খতম করেন। মাথা ঝুঁকিয়ে মাদ্রাসার তালেবে এলেমরাও চটের মাদুরে লাইন দিয়ে বসে কোরান পড়েন। উঠানের এক কোণে বড় বড় পাতিলে রান্না হয় রাতভর। বৌ-ঝিরা সার বেঁধে পিঁড়িতে বসে পেঁয়াজ-রসুন জোগান দেন। ঢাকা থেকে মেজো চাচা আর তার পরিবার আসে ঠিক আগের দিন বিকেলে। বাড়িতে তখন ধুমধাম। উৎসবের এই আমেজ চলে সপ্তাহখানেক।
দাদার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্কুল থেকে ছুটি নিতে বাবা সঙ্গে যান। হেডমাস্টারের কাছে আবেদন করেন। সেই সাত দিনের জন্য যেন অপেক্ষায় থাকি পুরো বছরটা।
আজান হচ্ছে। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম...। ফজরের আজান। আর একটু পরেই মা ডেকে তুলবেন আমাকে। অন্ধকার এখনো ছাড়ে নি। শীত শীত করছে। চৈত্রের এই সময়টাতে বেশ গরম পড়ে। রাতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। তাই ভোরের এই কাঁথাজড়ানো শীত। সম্ভবত মা কোনো এক সময় কাঁথাটা জড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কড়া গন্ধটা নাক থেকে যাচ্ছেই না। পাশ ফিরতেও আলসেমি লাগছে। চোখ বুঁজে খানিকটা ঘুমানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না।
কালামপুর বাস স্ট্যাণ্ড থেকে তিন মাইল দুরে হাতিরদিয়া গ্রাম। বড় রাস্তা থেকে অবনীবাবুর মোড়। সেখান থেকে ডানদিকে যে কাঁচা রাস্তাটা দিগন্তে মিশেছে তার ঠিক নিচেই আমাদের গ্রামটা। চারপাশে সবুজের সমারোহ। শ’তিনেক পরিবারের বাস। কয়েকটি ঝুপড়ি দোকান ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই হাতিরদিয়ায়। গ্রামের চারপাশে ধুধু মাঠ। বর্ষায় কুলকুল করে পানি এসে ছাপিয়ে যায় চারপাশ। জেগে থাকে কাঁচা সড়কটা। শুকনো মৌসুমে সবুজে ভরে ওঠে চারপাশ। বর্ষায় দল বেঁধে হুটোপুটি খাই কাদা পানিতে। অন্য মৌসুমগুলোতে দল বেঁধে দাড়িয়াবান্ধা খেলি। কাঠের চেলার ব্যাট নিয়ে ক্রিকেট খেলা চালু হলো এইতো বছর খানেক।
সন্ধ্যা হলেই নির্জনতা ভর করে হাতিরদিয়ায়। বছরের এই সময়টায় পশ্চিমা বাতাসে ধুলো ওড়ে। রুক্ষ প্রকৃতি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে কালবোশেখিতে। এ সময়টা তাই স্কুলে যাওয়া বারণ। ঈশান কোণে কালো মেঘের আনাগোনা হলেই স্কুল যাওয়া বন্ধ। ঠিক সকালটাতেই মা বলবেন.. শুভ.. ঘুমা.. ঝড় আইতাছে আসমান ভাইঙ্গা। আমিও বেঘোরে ঘুমাই। অনেক বেলা করে উঠি। অন্ধকার হয়ে আসা পৃথিবীর রূপ দেখি। মাকে ফাঁকি দিয়েই ছুট দিই ভুবনডাঙার বিলে। ধুলোর কুণ্ডলি ওড়ে। কাগজ ছিঁড়ে সেই কুণ্ডলি ধাওয়া করি। ছুটে আসে এ পাড়ার নিহাদ, নাসির, রাব্বি, স্বাধীন মিথুনরা। মাস্টার বাড়ির শোভাও ঘর ফাঁকি দেয়। দুরন্ত শৈশবের কাছে পরাজিত হয় রুক্ষ প্রকৃতি। ঝড় বৃষ্টিতে শিল কুড়িয়ে কতোবার যে জ্বর বাঁধিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।
এইতো সেদিনও। প্রচণ্ড জ্বর। বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছি আমি। মা মাথায় পানি পট্টি দিচ্ছেন। শোভা এলো। জান্নাতুল মাওয়া শোভা। আমার সেরা বন্ধু। সবচে পছন্দের কেউ একজন। একহারা গড়ন। ডাগর চোখে রাজ্যের সরলতা। চুল ঝুঁটিবাধা। আমার পাশে এসে বসলো। কপালে হাত বুলিয়ে বললো ..ভালো হয়ে যাবি তুই। ঠিকই পরদিন ভালো হয়ে গেলাম। শোভার খুব স্বপ্ন বড় মামার মতো ডাক্তার হবে। আমিও দেখতে পাই স্টেথেসকোপ হাতে। শাদা অ্যাপ্রন জড়ানো শোভা। মিটিমিটি হাসছে। আমিও তখন দেশের সেরা একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী। রাজ্যের ব্যস্ততা। কোনো এক ব্যস্ত শপিং মলে ঘুরছি আমরা দু’জন। শোভা আর আমি। হাতে হাত রেখে। কতো স্বপ্ন ছোট্ট এ জীবনে। শোভাকে নিয়ে। মনের ছোট্ট আয়নায় কতো যে ঝাপসা প্রতিবিম্ব। কখন সেই অস্পষ্টতা মুছবে। বড় হবো। কে জানে?
সেদিন কি মনে করে যেন বাবা ডাকলেন। পুকুরপাড়ের কামরাঙা গাছটার ছায়ায় ইজি চেয়ারে শুয়ে ছিলেন তিনি। মোড়া টেনে পাশে বসালেন। জীবনের গল্প শোনালেন। প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, হাসি কান্নার গল্প। বাবার অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। একসময় চোখ ভিজে উঠলো তার। এই আর্দ্রতার কোনো মানে আমি বুঝি নি। হয়তো বোঝার বয়স হয়নি তাই। কিন্তু এটা বুঝেছি অনেক বড় হতে হবে আমাকে। ছুঁতে হবে আকাশ। তাইতো সব কিছুইতেই বাড়তি নজর। বাবা নিজের হাতে যেন গড়ে তুলতে চান আমাকে।
এই তো মাস খানেক আগের কথা। সেই সাত সকালে আমাকে মোটরসাইকেলে চাপিয়ে থানা সদরে নিয়ে গেলেন বাবা। আন্ত:স্কুল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। উপস্থিত বক্তৃতা আর একক অভিনয়ে প্রথম হলাম। বাবা আনন্দে কাঁধে তুলে থানা পরিষদ ঘোরালেন।
বাপের বেটা..এমন পোলাই তো চাইছিলাম রে বাপ.. ক’ কি খাবি তুই..
বাজারে মিষ্টির দোকানে নিয়ে কাঁচের শোকেসের ভেতর মাথা ঠেলে ধরলেন আমার। যতো খাবি খা বেটা।
প্যাকেট করে নিলেন বাড়ির জন্য। বাড়িতে উৎসব লাগলো। দাদি বড় মোরগ জবাই দিলেন। পোলাও রান্না হলো। গ্রামের মানুষ এলো। থানা চ্যাম্পিয়ন দেখতে।
স্বপ্ন যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কিছুতেই চোখ মেলে তাকাতে পারছি না। হাত দুটো অসাড়। মা কেন ডাকছে না এখনো। আজ কি স্কুল বন্ধ ? নাকি ঈশান কোণে কালো মেঘ জমেছে বলে ছুটি। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। আতর লোবানের গন্ধটা বাড়ছে। চিৎকার করে মাকে ডাকছি..
মা..মা শুনছো..পানি ..বুকটা ফেটে যাচ্ছে..মা ও মা..আজ কি ছুটি ?
কেউ কেন শুনছে না আমার ডাক। সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। কোনোমতে গায়ের চাদরটা সরালাম। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেয়াল যেন চেপে ধরেছে আমাকে। বুক ধড়ফড় করছে।
প্রাণপন চিৎকার করছি..মা মা..ও মা...
কেউ শুনছে না। কি আর্শ্চয। দম আটকে আসছে আমার। মাথার ঠিক ওপরেই ছাদ। অন্ধকারে খুব একটা বুঝতে পারছি না। শরিরের সব শক্তি দিয়ে দেয়াল ঠেলে সরানোর চেষ্টা করছি। আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছে শোভা। দুজনে আপ্রাণ চেষ্টা করছি অন্ধকার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। মাথা প্রচণ্ড ঘুরছে। শোভা শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে আমায়। ভোঁ ভোঁ করে হর্ন শুনতে পাচ্ছি। অন্ধকার ফুঁড়ে জ্বলজ্বল করে ধেয়ে আসছে দুটো রক্তচক্ষু। পালাচ্ছি আমি। শোভা। রাব্বি। নাসির। দৌড়াচ্ছি প্রাণপণ।
মা..বাবা..পানি চিৎকারে কেঁপে উঠছে আকাশ বাতাস...
হাসপাতালের মেঝেতে আমাদের রক্তের স্রোত... চারপাশে কান্নার জোয়ার। বুকফাটা আর্তনাদ। আহাজারি চারপাশে। আমি তখনো ঘুমাচ্ছি। মা আমাকে ডাকছেন প্রাণপণ। শুভ ওঠ..স্কুলে যাবি না ? ওঠ বাবা..
উঠোনে স্কুল ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে বারেক চাচা। কিন্তু আজ যে ঈশান কোণে মেঘ। হাতিরদিয়া আজ ডুবে গেছে গভীর অন্ধকারে। আজ কি ছুটি নেই মা?
মা ডাকছেন প্রাণপন..ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল এসে জমছে আমার থেতলানো মুখে। আমি যে অনেক বড় হতে চাই মা। আমাকে নিয়ে যাও। একটু খানি পানি দাও মা। একটুখানি জড়িয়ে রাখো তোমার কোলে। কাঁদছি আমি। হাউমাউ করে কাঁদছি। কিন্তু কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না এই অন্ধকার। বারবার তেড়ে আসছে রক্তচক্ষু দুটো। পিষে থেতলে দিচ্ছে আমার কোমল মুখ। মুক্তি দাও মা। এই দুঃস্বপ্নের জাল থেকে বের করো আমাকে..। হাতিরদিয়া গ্রাম ছাপিয়ে এই চিৎকার পৌঁছে যাচ্ছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। ছুটে পালাচ্ছি আমরা। পেছন পেছন ছুটছে ট্রাক। বিড়িতে সুখটান দিয়ে ঢেঁকুর তুলছেন চালক সমীর মিয়া। মুখ দিয়ে ভকভক করে বেরুচ্ছে চোয়ানির গন্ধ।
ওই যাবি কই ছোকরার দল...
ছোট্ট খিড়কি দিয়ে গলা বের করে খিক খিক করে হেসে ওঠে সমীর মিয়া। তরমুজের বিচির মতো দাঁতের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানের রস। স্কুলভ্যানে থাকা শিশুদের নিয়ে গোল্লাছুট খেলতে থাকে। প্রাণপণ প্যাডেল চাপেন বারেক চাচা। সাথে পালাচ্ছি আমরাও। কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছি না কিছুতেই। বড় অন্ধকারে তলিয়ে আছে হাতিরদিয়া।
জিটিভি, ১৭.০৩.২০১৩
[email protected]; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর