ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত এবং আতংক!

আদনান সৈয়দ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৩
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত এবং আতংক!

ইদানীং খুব ভয়ে ভয়ে প্রতিদিনের খবরের কাগজের পাতা ওল্টাই। সর্বত্র আঁতকে উঠার মত সব খবর! প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নরকম নাশকতায় পাখির মত মানুষ মারা যাচ্ছে।

হিন্দু বাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে, পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের বসত বাড়ি আর সেই সাথে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মানুষটাকেও। সত্যি বলতে এখন একজন মানুষের মৃত্যু যেন কোনো বিষয়ই নয়। প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর কানে আসছে। হরতালের নাম করে গাড়িতে এবং ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, চলছে সর্বাত্মক ভাংচুর, খুন, জখমসহ নানা নৃশংস অপরাধ। চলছে চালকসহ গাড়িতে পেট্রল বোমা ছুড়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মত নাশকতার ব্যাপক আয়োজন। প্রতিদিন লাশ হয়ে মানুষ ঘরে ফিরছে। আত্বীয় স্বজনদের কান্নায় এখন বাংলার আকাশে নীরব অশ্রু। সে দিন খবরে দেখলাম চট্টগ্রামের একজন সাধারণ  শ্রমিকের জিহ্বা কেটে হত্যা করা হয়েছে। কি ছিল তার অপরাধ? হ্যাঁ, সে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছিল। আর এর শাস্তি হিশেবে শিবিরের ক্যাডাররা তার কান কেটে, জিহ্বা কেটে খুন করেছে। খুন হচ্ছে বাংলাদেশের কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরাও। খুনের পাশাপাশি চলছে আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি চরম হুমকি আর অপমানের নির্লজ্জ মহড়া। বাংলাদেশের পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, পুলিশ মারা হচ্ছে, নিরীহ মানুষদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুম করা হচ্ছে।

প্রিয় পাঠক, এ কিসের আলামত? ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিদের দোসর জামায়াতে ইসলামীর সেই সময়ের ভূমিকার সাথে আজকের জামায়াত-শিবিরদের তাণ্ডবের হুবুহু মিল খুঁজে পাওয়া কি যায় না? খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, আজ স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পর আমাদের অনেক কষ্টে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের গায়ে খামচে ধরছে সেই পুরনো হিংস্র শকুন। যে সাম্যবাদী চিন্তা আর প্রত্যয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ নামে একটি দেশের জন্ম হয়েছিল আজ সেই দেশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে। শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে এই দেশে মন্দির,বৌদ্ধমঠের মত ধর্মীয় জায়গা পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে! এ কোন রাজনীতি? কে জানে হয়তো খুব শিগগিরই সেই ‘৭১ এর মতই রাস্তায় রাস্তায় মানুষের লুঙ্গি খুলে হিন্দু-মুসলমান শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে? চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, এর জন্যই কি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল?  বলি, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর আড়াই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতাকে ধমক দেওয়া কি এতই সহজ? জানতে ইচ্ছে করে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি হোক আর যেই দলই হোক তারা এত স্পর্ধা পায় কোথা থেকে?

বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি যে ভোটের রাজনীতি এই বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। যদি তা-ই না হত তাহলে জামায়াতে ইসলামীর মত যুদ্ধাপরাধীদের দলকে নিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল এতো মাখামাখি করতে পারতো না। মোদ্দা কথা হলো, আমাদের বর্তমান রাজনীতির সংজ্ঞ্যানুযায়ী ’দেশের উর্ধ্বে দল’। আর সে কারণেই যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে নোংরা রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত আমাদের দেশের বর্তমান এই রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা।   বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, প্রতি সপ্তাহে গড়ে দু’তিন দিন করে হরতালের ডাক পড়ছে।   আর সেই সাথে হরতালের নামে মানুষ হত্যা ও সন্ত্রাসী কাজকারবার যেন এখন একটি ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছে। যে বাংলাদেশ আর মাত্র কুড়ি/পঁচিশ বছরের মধ্যেই সিংগাপুর বা থাইল্যান্ডের মত এশিয়ার অন্যতম উন্নত একটি দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছিল সেই দেশকে এখন বিশেষ একটি চিহ্নিত দল আরেকটি আফগানিস্তান বানানোর গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ধীরে ধীরে আমাদের বিনিয়োগ বাজারে এখন রীতিমত ধস নামতে শুরু করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ কারীরা আমাদের দেশে বিনিয়োগের উপর তাদের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। আমাদের দেশের বিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীবৃন্দ বিষয়টি ভাববার সময় পাচ্ছেন কি?
ইদানীং দেখছি, বলা নেই কওয়া নেই খুব সাধারণ কারণেই ’হরতাল’ ডাকা হচ্ছে। বলি, এটা কি মামার বাড়ির আবদার? আমরা না হয় সাধারণ ছাপোষা মানুষ। হরতালের দিন অনেক কষ্টে পায়ে হেঁটে অফিসে যাই। কারণ মাস ফুরোলেই আমাদের বেতন প্রয়োজন। সেই বেতনে সংসার চলে। আর সাথে সাথে দেশটাও বাঁচে। দেশের অর্থনীতির চাকা শক্ত হয়। একজন দিনমুজুরের কথা ভাবুন তো! যার প্রতিদিনের শ্রমের পয়সায় দিন চলে সেই শ্রমিক তার সংসারটা চালায় কিভাবে? আফসোস এই যে, এই সাধারণ হিসেব নিকেশটাও আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা বোঝেন না বা বুঝতে চান না। তবে যারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে হরতালকে বেছে নিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে দুটি কথা বিনয়ের সাথে বলতে চাই। আপনারা কি সত্যি মনে করেন যে, স্বত:ফুর্ত হয়ে এই আমজনতা আপনাদের যখন তখন ডাকা হরতাল পালন করে যাচ্ছেন? আপনাদের বলব খোঁজ নিয়ে দেখুন রাস্তায় মহড়া দেওয়া আপনাদের পালিত মস্তানদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অথবা গাড়ি ভাংচুরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিংবা নিজের জানমাল হেফাজতে রাখার জন্যেই মানুষ হরতালের দিন ঘর থেকে বের হতে ভয় পান। অন্য কোনো কারণে নয়।

এবার একটি ভবিষ্যত আতংকের কথা বলতে চাই। আগেই বলে নিই আমাদের এই দেশে ইসলাম এসেছে সুফিবাদের হত ধরে। সে কারণেই এই বাংলার মাটি পীর পয়গম্বরদের পদধূলায় সমৃদ্ধ হয়েছে। এই বাংলাদেশে হিন্দুরা এসেছে, বৌদ্ধরা এসেছে, মুসলমানরা এসেছে এবং অনেক পরে খ্রীষ্ট ধর্ম এসেছে। আর সে কারণেই বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টানদের কে নিয়েই সমৃদ্ধ একটি দেশে। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশের মুসলমানদের আলাদা একটি সাম্যবাদী উদার পরিচয় আছে। সেজন্য বাংলার মুসলমান আর আফগানিস্তানের মুসলমান কিন্তু এক বস্তু নয়। কিন্তু স্পষ্টতঃ বাংলাদেশের এই উদার সাম্যবাদী শক্তিকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ওহাবী চক্র বেশ তৎপর হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ধর্মকে পুঁজি করে বা ইসলামের নাম ভাঙিয়ে একদল ধর্মব্যবসায়ী ফায়দা লুটতে উঠে পড়ে লেগেছে। এটা কিসের লক্ষণ? আমরা চাই না, বাংলাদেশ একটা তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত হোক। সেদিন এক ডকুমেন্টরিতে দেখছিলাম তালেবানরা প্রথম দিকে আফগানিস্তানের মানুষদের দাড়ি কত টুকু লম্বা তা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে কোকের বোতল (এক লিটার মাপের) দাড়ির পাশাপাশি রেখে এর উচ্চতা মাপতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ কোকের বোতল দাড়িমাপক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশও বুঝি সেই একই পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।   বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানানোর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে একটি দল মেতে উঠেছে!

মনে রাখতে হবে, আমাদের সাম্যবাদী চিন্তাই আমাদের সবচেয়ে বড়  অহংকারের ঠিকানা। সব ধর্মের লোকদের নিয়েই আজকের এই বাংলাদেশ। এই চেতনাবোধ আমাদের একদিনে হয়নি। হাজার বছরের বাংলার সংস্কৃতি, চিরায়ত ধর্মের ভালোবাসার বাণী আমাদের সে কথাটাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ভুলে গেলে চলবে না এই দেশ আউল-বাউল-পীর ফকিরদের দেশ। আমাদের দেশের মানুষ সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষ। এখানে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে যেমন বাউল গানের একতারায় সুর বেজে ওঠে, পাশাপাশি কীর্তনের মোহনীয় সুরে সন্ধ্যায় সূর্য ডুবতে শুরু করে। এই চেতনা বোধটাকে নিয়েই আমরা নতুন প্রজন্ম সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। রাজনৈতিক সব রকম ষড়যন্ত্র থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাক। মুক্তিযুদ্ধের মত পবিত্র একটি যুদ্ধের বিনিময়ে পাওয়া এই বাংলাদেশ বুক উঁচিয়ে পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকুক এই আমাদের একমাত্র প্রার্থনা। বাংলাদেশ চীরজীবী হোক।

(লেখকঃ একটিভিস্ট, ব্লগার এবং ফ্রিল্যান্স জার্নালিষ্ট)[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।