ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ডিয়ার অনন্ত, স্পিক দ্য ট্রুথ

জিনিয়া জাহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৩
ডিয়ার অনন্ত, স্পিক দ্য ট্রুথ

কয়েকদিন ধরেই মিডিয়া সরগরম বাংলাদেশে ডিজিটাল মুভি প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত নায়ক অনন্ত জলিলের সাংসারিক ঝামেলা সংক্রান্ত মুখরোচক বিষয় নিয়ে। চিত্রনায়ক অনন্ত এবং তার সাবেক স্ত্রী চিত্রনায়িকা বর্ষার একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি জিডি করার মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে বিদ্যমান তিক্ত সম্পর্কের কথা জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়।

অনন্ত-বর্ষার এই পারিবারিক স্ক্যান্ডালের  আপডেট খুব আগ্রহ নিয়েই আমি রোজ ফলো করছি।

এর কারণ শুধু তারকাদের স্ক্যান্ডালের খবরের দ্বারা বিনোদন প্রাপ্তি নয়, আমি আসলে এই ব্যাপারটির মাঝে আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মনস্ত্বাত্ত্বিক কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করছিলাম।
 
আমাদের পুরুষশাসিত এই সমাজে খুব কমন একটা বিষয় হলো নারীর চরিত্রের ওপর দোষারোপ করা। মুখ ফুটে না বলে শুধু বলে দিলেই হলো যে অমুকের চরিত্র খারাপ। ব্যস, তাহলেই কাজ হয়ে গেল। আদৌ সেই নারীর চরিত্র খারাপ কি না কেউ এ বিষয়ে সত্যমিথ্যা কিছুই যাচাই করবে না। আর কোনো স্বামী যদি স্ত্রীর চরিত্র খারাপ বলে প্রচার করে তবে তো কোনো কথাই নেই। পাবলিক সহানুভূতি অটোমেটিক সেই বেচারা (!!) স্বামীর পক্ষে চলে যাবে।

এক্ষেত্রে জনাব অনন্ত জলিল মোটেও ব্যতিক্রম কেউ নয়!! নারীকে সমাজে হেনস্তা করতে তিনি সেই চিরাচরিত ফর্মুলাই ব্যবহার করেছেন। তিনি তার স্ত্রীর চরিত্র খারাপ এ কথা জানিয়ে থানায় আগেভাগে গিয়ে একটা জিডি করে রেখেছেন।
 
স্ত্রীর চরিত্র খারাপ এ কথা তিনি সংবাদ সম্মেলনেও সবার সামনে বেশ জোর দিয়েই বলেছেন। তিনি এও বলেছেন যে তার স্ত্রী নাকি কোন ক্রিকেটারের সঙ্গে পরকীয়া  করছে। তিনি সেই ক্রিকেটারের নাম-ঠিকানা সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেননি, কারণ এতে নাকি সেই ক্রিকেটারের ক্যারিয়ার নষ্ট হবে।

অথচ কি অবলীলায় একজন নারী, যে কি না তার স্ত্রী ছিলেন, একসময় সুখে দু:খের সাথী ছিলেন তার চরিত্রকে সকলের সামনে অবলীলায় কলঙ্কিত করলেন। যার সাথে এত দিন  ঘর করলেন তার ক্যারিয়ারের কথা একবারও ভাবলেন না অথচ কতই না মহত হয়ে তিনি ভাবলেন তার স্ত্রীর তথাকথিত(?) প্রেমিকের ক্যারিয়ারের কথা!!!
 
পত্রিকা পড়েই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, সামান্য খাবার দেওয়া নিয়ে ঝগড়া লাগায় তিনি তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছিলেন। অথচ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে বর্ষার টেলি কথোপকথন থেকে জানতে পারি যে, অনন্ত প্রায়ই বর্ষাকে মারধর করতেন। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অনন্ত বলেছিলেন, ব্যবসা, ফিল্ম, অনেক মানুষের জীবিকা ইত্যাদির গুরুদায়িত্ব মাথায় থাকে জন্য অনেক সময়ই নাকি তার মাথা ঠিক রাখা সম্ভব হয় না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো বাইরে ঝামেলা থাকলেই কি কেউ সংসারে ঝগড়া লাগলেই স্ত্রীকে মারধর করতে পারে? অবাক হতে হয় যখন দেখি স্ত্রীকে মারধর করে উল্টা স্ত্রীর চরিত্র খারাপ এমন অভিযোগ করে সবার আগে তিনি থানায় গিয়ে জিডি করে দেন!!!
 
পুরুষশাসিত এই সমাজ ব্যবস্থায় আরও একটি বিষয় খুব কমন। স্বামী-স্ত্রী দুজন যদি একই পেশায় নিয়োজিত থাকেন তবে স্বামীর থেকে স্ত্রীর ক্যারিয়ারে বেশি উন্নতি হতে থাকলে অধিকাংশ সময় পুরুষেরা স্ত্রীর সেই সাফল্য স্বাভাবিকভাবে উপভোগ করতে পারেন না। তারা অনেক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন। আশেপাশের মানুষ নানা ধরনের কথাবার্তা বলে তাদের সেই হীনমন্যতার আগুনে প্রায়ই ঘি ঢেলে তা আরো উস্কে দিয়ে থাকে। ঠিক একই বিষয় পরিলক্ষিত হয় অনন্ত জলিলের মাঝে।
 
অনন্ত-বর্ষা জুটির সিনেমা যারাই দেখেছেন, তারা এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, বর্ষা প্রতিভাময়ী একজন অভিনেত্রী। ভালো ও দক্ষ কোনো সিনেমা নির্মাতার সাথে কাজ করলে নিঃসন্দেহে বর্ষা আরও ভালো করবে। একারণেই হয়ত তিনি দেশে বিদেশের অনেক সিনেমা নির্মাতার কাছ থেকে ছবি করার অফার পেয়েছিলেন। অনেক অর্থের বিনিময়ে নামী একটি পণ্যের বিজ্ঞাপনে বর্ষার সাম্প্রতিক উপস্থিতি রুপালি জগতে তার চাহিদার  জ্বলন্ত প্রমাণ।

এছাড়াও কলকাতার ছবিতে অভিনয়ের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য তার কলকাতা উড়ে যাওয়াও প্রমাণ করে যে, দেশে বিদেশে বর্ষা নামক এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর চাহিদা রয়েছে। আর এক্ষেত্রে অনন্ত জলিল বিষয়টিকে যে সহজে মেনে নিতে পারেননি সাম্প্রতিক সাক্ষাত্কারগুলি তারই প্রমাণ।     
 
সিনেমায় স্ত্রীর অভিনয়ে আপত্তি নেই, অথচ অন্য কারো সাথে অভিনয়ে প্রবল আপত্তি। অর্থ্যাৎ যতদিন স্ত্রীর গ্ল্যামার থাকবে তাকে নিয়ে যত খুশি সিনেমায় অভিনয় করিয়ে অর্থ বানিয়ে নেবে, তারপর স্ত্রীর বাজারে কাটতি কমে গেলে ছুড়ে ফেলে অন্য নায়িকা নিয়ে সিনেমা বানাবে!! এখন অত্যাচারী, হিংসুক স্বামীর ঘরে দিনের পর দিন মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য না করে যদি স্ত্রী তার ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে, তবে সংসার ভাঙ্গার সকল দোষ সেই স্ত্রীর ঘাড়ে বর্তাবে কেন?

অনন্ত জলিলের ভাষ্যমতে ডিভোর্সের পরেও তিনি বর্ষাকে নিয়ে তার নির্মাণাধীন ছবি করতে আগ্রহী। কারণ হিসেবে বলেছেন, যেহেতু ছবির বেশ কিছু দৃশ্য শ্যুটিং হয়েছে অন্য কাউকে নিয়ে সেই ছবির রিশ্যুট করা ব্যয়সাপেক্ষ, সময়সাপেক্ষ যা কি না ব্যবসায়ী অনন্তের পক্ষে পুনরায় করা সম্ভব নয়। কাজেই তিনি বর্ষার সাথেই সেই ছবি শেষ করতে চান।

স্ত্রী ফ্রি লাইফ লিড করতে চায়, রাতে অন্য মানুষের সাথে চ্যাট করে বেড়ায়, একা স্বামী ছাড়া কলকাতা যায় ইত্যাদি যাবতীয় অভিযোগ পেশ করে, জোর করে স্ত্রীর কাছ থেকে তালাক আদায় করে নিয়ে সেই সাবেক স্ত্রীর সাথে অভিনয় করতে চাওয়া কি আদৌ কোনো সুস্থতার লক্ষণ?
 
সংসার ভাঙ্গার সব দায় কেন শুধুই একজন নারীর ওপর বর্তাবে? কেন ডিভোর্সের পরেও সাবেক স্বামী দ্বারা সর্ব সম্মুখে সেই নারী চরিত্রহীনা বলে বিবেচিত হবে?  সংসার জোড়া লাগানোর দায় নারীর, ভাঙ্গার সব দায়ও কি নারীর?  তবে কি সংসার ভাঙ্গার কোনো দায় পুরুষের থাকে না?
 
জনাব অনন্ত জলিল, আপনি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ভালো ইংরেজি জানা সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি। স্ত্রীর ওপর কড়া নজর রাখেন।   রেগে গেলে স্ত্রীকে মারধর করেন। সংসার ভাঙ্গার কোনো দায়ই কি আপনার নেই? সব দায় একা বর্ষার ওপর চাপিয়ে দিয়ে সাধু না সেজে "প্লিজ স্পিক দ্য ট্রুথ"।  
 zinia-zahid
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্লগার  



বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, ২৭ মার্চ, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।