বাংলা ব্লগের পথিকৃৎ মিনার মাহমুদ। কোনো ব্লগার বন্ধু এটুকু পড়েই দয়া করে বিতর্ক শুরু করবেন না।
মিনার মাহমুদের পত্রিকা ‘বিচিন্তা’ নামেই তার প্রমাণ। বাংলা একাডেমীর ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ অনুযায়ী ‘বিচিন্তা’ শব্দের অর্থ ‘নানাভাবে চিন্তন’। এরশাদের স্বৈর শাসন আমলে প্রথম প্রকাশিত ‘বিচিন্তা’ ছিলো তথ্য বিশ্লেষণের সঙ্গে সেই চিন্তা প্রকাশের তরুণ সমাজের প্রথম মাধ্যম, ভিন্ন মাধ্যমে আজ যা ব্লগ।
সাংবাদিক হিসেবে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই দৈনিক পত্রিকা, বার্তা সংস্থা, অনলাইন এবং বেতার ও টিভিতে কাজের অভিজ্ঞতা হলেও এখনও কিশোর পার হওয়া বয়সে ‘বিচিন্তা’র একজন কর্মী হতে পারাই আমার নিজের জন্য সবচেয়ে গৌরবের বিষয়। ‘দুই মলাটের ভেতর নিষিদ্ধ বারুদ’ ‘বিচিন্তা’র প্রথম প্রজন্মের সঙ্গে আমি ছিলাম না, তখনও আমি স্কুলে পড়ি; যে ঢাকা শহরে না থাকলে কথিত মূলধারার কোনো কিছুর সঙ্গেই সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া যায় না, সেই ঢাকা শহরেও আসা হয়নি।
তবে ‘বিচিন্তা’র শুধু পাঠক থেকে কর্মী হওয়ার গৌরবের অংশীদার হয়েছিলাম প্রথম সুযোগেই। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ পতনের পর ‘বিচিন্তা’র দ্বিতীয় যাত্রায়। মিনার মাহমুদকে তখনই প্রথম আর শেষ কাছাকাছি দেখা। এর আগে তার সম্পর্কে যেমন অনেক গল্প শুনেছি, পরেও শুনেছি অনেক। তার সবই এক মহানায়কের কথা, শেষ পর্যন্ত যিনি ট্র্যাজেডির নায়ক হয়েও বুড়ো সান্তিয়াগোর মতোই স্বপ্নের বাতি জ্বেলে রাখা এক মানুষ।
একটি পত্রিকা যে একটি প্রজন্মের স্বপ্ন, স্বপ্ন পূরণের স্বপ্ন আর স্বপ্ন অপূর্ণ থাকার বেদনার কাব্যগাথা হতে পারে ‘বিচিন্তা’ তার বড় এক প্রমাণ। যে মানুষটিকে কেন্দ্র করে এই মহাকাব্য তিনি মিনার মাহমুদ, বাংলা ভাষায় ‘বিচিন্তা’ শব্দটিই এখন যাঁর নামের সমার্থক, ‘বিচিন্তা’ তার আসল অর্থ থেকে বদলে গিয়ে ‘প্রজন্মের বারুদে সাংবাদিকতা’র এক নতুন অর্থ।
প্রচলিত জার্নালিজম করেননি মিনার মাহমুদ, তাঁর ‘বিচিন্তা’ও প্রচলিত সাংবাদিকতা করেনি। সেখানে যা বলা হয়েছে তা একদম সরাসরি, কোনো রাখঢাক না রেখে। শাদাকে সবসময়ই শাদা বলেছে ‘বিচিন্তা’, কালোকে কালো। ‘বিচিন্তা’ শুধু তথ্য জানানোর কাজ করেনি, আবার তথ্যের বিশ্লেষণেও পক্ষপাতিত্ব ছিলো; তবে সেই পক্ষপাতিত্ব সব সময়ই বাংলাদেশ এবং মানুষের জন্য। শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্যইতো সব কিছু, সাংবাদিকতাও। তাহলে ব্যাকরণ থেকে বেরিয়ে পক্ষপাতিত্বে সমস্যা কোথায়!
তবে সাংবাদিকতার প্রচলিত ব্যাকরণ যে ‘বিচিন্তা’ মানেনি, তাও নয়। সেই ব্যাকরণ মেনেই একের পর এক অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয়েছে। এমন কোনো উদাহরণতো নেই যেখানে যাকে নিয়ে রিপোর্ট সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেননি। পার্থক্য হলো সেই বক্তব্য তারা যে ঢংয়ে দিয়েছেন, সেই ঢংও তুলে ধরেছে ‘বিচিন্তা’। আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে প্রতিবেদন। আজ টেলিভিশনের পর্দায় যেভাবে ছবি দেখে অনেক কিছু বোঝা যায়, সেদিন ‘বিচিন্তা’র বর্ণনার স্টাইলেই তা ছিলো স্পষ্ট।
একে অনেক ‘ভদ্রলোক সাংবাদিক’ এখনও সাংবাদিকতা বলতে চান না। তাদের কাছে এখনও পশ্চিমাদের তৈরি করে দেওয়া ম্যানুয়ালই হলো সাংবাদিকতার নীতিমালা। সেই নীতিমালা দিয়ে তারা এখনও শুধুই ‘টু ইনফর্ম’ (তথ্য জানানোর) সাংবাদিকতার পক্ষে। তবে পশ্চিমারা নিজেরাই যেমন পরে তাদের সুবিধা অনুযায়ী নিজেদের মডেল ভেঙ্গেছে, মিনার মাহমুদ ‘বিচিন্তা’র মাধ্যমে তা ভেঙ্গেছেন অনেক আগে, এবং সেটা মানুষের স্বার্থে।
মিনার মাহমুদ আসলেই ছিলেন এক ‘রাহাত খান’, তাঁর রিপোর্টাররা একেকজন ‘মাসুদ রানা’। একজন ‘মিনি মাসুদ রানা’ হিসেবে অভিজ্ঞতা অনেক। ব্যক্তিগত সেইসব অভিজ্ঞতা আর ঘটনার বয়ানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মিনার মাহমুদের দর্শন। শুধুমাত্র ‘বিচিন্তা’র প্রিন্টার্স লাইন দেখলেই তাঁর সেই দর্শন স্পষ্ট, যে প্রিন্টার্স লাইনে নাম ছাপা হতো নামের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী টানা ছাপায়, যে প্রিন্টার্স লাইনে ‘বিচিন্তা’র কর্মী বাহিনীর জন্য রান্না করা মহিলাটির নামও ছাপা হতো অন্যদের সঙ্গে একই কাতারে।
বৃহত্তর জীবনেও এরকমই একটি রাষ্ট্রীয় পরিবারে সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন মিনার মাহমুদ। সমতার সেই লড়াইয়ে ভিন্ন ধরণের এক সাংবাদিকতাকে হাতিয়ার করেছিলেন তিনি। হয়তো অভিমানে, হয়তো হতাশায় সেই লড়াই অপূর্ণ রেখেই তিনি চলে গেছেন। ১০ মার্চ, ১৯৫৯ জন্ম নিয়ে মাত্র ৫৩ বছর ১৯ দিনের জীবন শেষে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি। এমনকি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ‘বিচিন্তা’ও ছেড়ে গেছেন তিনি আজ ঠিক এক বছর।
তবে শুরুতে যে কথা বলেছিলাম, তাই আবার বলি। ব্লগের মধ্যেই আমি প্রতিদিন নতুন রূপে ‘বিচিন্তা’কে দেখি। এর কিছুটা সাংবাদিকতা, কিছুটা না; কিছুটা ‘বিচিন্তা’র মতো, অনেকটাই না। তারপরও আশির দশকে ‘বিচিন্তা’র মাধ্যমে মিনার মাহমুদ যে নতুন লড়াই শুরু করেছিলেন, নানা উপায়ে নানা মাধ্যমে সেই লড়াই চালু রেখেছে তাঁর উত্তর প্রজন্ম। আমাদের মতো অনেকের কাছে মিনার মাহমুদ তাই সব সময়ই সাংবাদিকতার সবচেয়ে উঁচু মিনার।
জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই ([email protected])