৬শ কোটিরও বেশি মানুষের এই পৃথিবী নামের গ্রহে বেশির ভাগ মানুষ আজো দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট। দারিদ্র্য নামের এই বিভীষিকা অধিকাংশ মানুষের ‘স্বাস্থ্য, বল আর আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু’ লাভের আশাকে টুঁটি টিপে মারছে।
বুকে প্রবল সাহস আর অফুরান স্বপ্ন নিয়ে কয়েক দশক আগে বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুরু করেছিলেন ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা। আর সে প্রচেষ্টা এরই মধ্যে দেখেছে আকাশছোঁয়া সফলতা ও অর্জন। তার নিজের ও তার প্রতিষ্ঠানের নাম খ্যাতি ও দ্যুতি ছড়িয়েছে বিশ্বময়।
সেই সঙ্গে নানা নেতিবাচকতা ঠেলে বাংলাদেশের নামটিও এখন সবার মুখে মুখে। ইউনূস আর বাংলাদেশ—দুটি নামই এখন উচ্চারিত হচ্ছে যুগপৎ---বাংলাদেশের ইউনূস আর ইউনূসের বাংলাদেশ!
শান্তির জন্য প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ড. ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণব্যাংক নোবেল শান্তি পুরস্কার এনে দেয়। এরপর পেলেন আরও অনেক পুরস্কার। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদকও পেলেন। আর সবশেষে পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘ইউএস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’।
ড. ইউনূস ও বাংলাদেশ এবং গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য, বলা উচিত, এ এক বিরলতম ঘটনা। ড. ইউনূসের নিজের সফলতার মুকুটে যোগ হলো আরো একটি উজ্জ্বল পালক। সাম্প্রতিককালে নানা নেতিবাচকতায় আক্রান্ত বাংলাদেশ পেল এক বড় রকমের ইতিবাচক ভাবমূর্তি; সেই সঙ্গে পেল নতুন আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণা---‘আমরাও পারি। ’
২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখটি নিছকই এক তারিখ হয়ে থাকলো না; ড. ইউনূস, বাংলাদেশ ও গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য ১৭ এপ্রিল হয়ে উঠলো এক গৌরব ও প্রেরণার দিন। এদিনই মার্কিন কংগ্রেসের এই সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘ইউএস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’টি তিনি গ্রহণ করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এক জমকালো অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসের হাতে তুলে দেওয়া হলো এই পুরস্কার ও সম্মাননা। প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার জন বোয়েনার যখন হাস্যোজ্জ্বল ড. ইউনূসের হাতে পদক তুলে দেন তখন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যালঘু ডেমোক্রেট দলের নেত্রী সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি।
‘ইউএস কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’ নামের এই পুরস্কার পেয়ে এক সঙ্গে অনেকগুলো বড় ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এক, তিনিই প্রথম বাংলাদেশি যিনি এই পদক পেলেন। দুই, মুসলিম বিশ্বের তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এ পুরস্কার পেলেন। ৩. ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের চিরাচরিত দ্বন্দ্বের রশি টানাটানির ছিটেফোঁটাও ছিল না ইউনূসকে এই পদকের জন্য মনোনয়ন দেবার ক্ষেত্রে। একটি পত্রিকা লিখেছে:
In today’s highly charged and partisan political environment in Washington DC, where the two major parties in the United States Congress seem to agree on nothing, it is remarkable for a foreign national to receive such widespread support from both parties. The award certainly demonstrates the high esteem Professor Yunus enjoys amongst members of the United States Congress and Senate, and among the American citizens.
চার, তিনি সেইসব বিরল মানুষদের তালিকায় নাম লেখালেন যারা ইউএস প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল এবং কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল দুটোই পেয়েছেন। এবং সেইসঙ্গে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার।
‘‘Not everyone who has received this award has also received the US President’s gold medal, the highest civilian award the United States President can bestow. Finally, the list of people who have been honoured with these two awards, along with a Nobel Prize, is very short indeed.’’
ড. ইউনূস আবারো প্রমাণ করলেন মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড় ----যতক্ষণ সে উদ্যমী আর পরিশ্রমী, যতক্ষণ সে লড়াকু আর ভয়হীন, যতক্ষণ সে আত্মবিশ্বাসী আর আপন লক্ষ্যে অবিচল। একদিন হয়তো দারিদ্র্য সত্যি সত্যিই চলে যাবে যাদুঘরে। দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠানোর যে স্বপ্ন একদিন ছিল তার একার, এখন তা হয়ে উঠুক সবার। স্বপ্নের সাথে যোগ হোক উদ্যম।
সকল নেতিবাচকতা ভুলে গিয়ে, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা দূরে ঠেলে, স্বার্থচিন্তার চেয়ে দেশপ্রেমকে বড় করে এখনই সবার হাতে হাত লাগানোর সময়। কেননা ‘’একটা ভালো কিছু ভালো অনেক কিছুর জন্ম দেয়’’, বিন্দু বিন্দু জল সমুদ্র রচনা করে। তেমনি ছোট ছোট চেষ্টা মিলিত হয়ে সাফল্যের সৌধ রচনা করবে বাংলাদেশের পরিশ্রমী মানুষ। যদি আমরা হানাহানি আর বিভেদ ভুলে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য একজোট হতে পারি।
বাংলানিউজ পরিবার ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। দেশকে তিনি যে বিরল সম্মান এনে দিলেন তা আমাদের জাতিকে নতুন নতুন স্বপ্নের পথে, নতুন উদ্যম সাধনার পথে ঠেলে দিক। আমাদের আর আত্মতুষ্টির সময় নেই, বসে থাকার সময় নেই: দারিদ্র্য নামের দৈত্যকে যাদুঘরে পাঠাতেই হবে। তবে তার জন্য যে অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ, সংঘাতহীন ও উদার মানবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দরকার তার জন্য এখনই কাজ শুরু করতে হবে।
মানুষের বিকাশের অনুকূল, সকল মানুষের মর্যাদা ও বিকাশের জন্য অনুকূল বৈষম্যহীন, দারিদ্র্যমুক্ত এক শান্তিময় এক দেশের স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি। তবে সেজন্য নিশ্চেষ্ট বসে বা ঘুমিয়ে না থেকে আমাদের দিতে হবে অনেক পথ পাড়ি: ‘‘মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’’-----(ঘুমাবার আগে আযোজন পথ বাকি!’’
e-mail: [email protected]