ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

লুঙ্গি, জাতীয় সংসদ ও বারিধারা

সিদ্দিকুর রহমান খান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৩
লুঙ্গি, জাতীয় সংসদ ও বারিধারা

ঢাকা: চাইলে সাংসদরা লুঙ্গি পরে জাতীয় সংসদেও যেতে পারেন। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর স্থাপত্যশৈলী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে লুঙ্গি পরে অধিবেশনে যোগ দিতে আইনগত কোন বাধা নেই।

অথচ, অভিজাত বলে পরিচিত রাজধানীর বারিধারা এলাকায় লুঙ্গি পরা রিকশাচালকদের চলাচলে বাধা দেওয়া এবং এ সংক্রান্ত আদালতের নেওয়া পদক্ষেপের সংবাদ জেনেছি সবাই।

এরইমধ্যে প্রতিবাদী কিছু তরুণ লুঙ্গি পরে বারিধারা এলাকায় সাইকেল চালানোর উদ্যোগ নিলে তারাও বাধার সম্মুখীন হন দারোয়ান ও পুলিশের। তরুণদের মতে, বারিধারা সোসাইটির হর্তাকর্তাদের বাপ-দাদারা লুঙ্গি পরেই চাকরি-বাকরি-ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। নিজ নিজ বাসায় এখনো সবাই লুঙ্গিই পরেন।  

এসব তথ্য ও খবর শোনার পর মনে হলো- বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক কি তা জেনে নিই। অনেকের কাছে প্রশ্ন রাখলেও সুনির্দিষ্ট উত্তর কেউ দিতে পারেন নি, কারণ জাতীয় পোশাক সুনির্দিষ্ট করা নেই। তবে লুঙ্গি নিয়ে যা জানতে পেরেছি তা একটু বলে নিই।

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর লুঙ্গির কথা আমরা সবাই জানি। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হলেও ভাসানী অসামাজিক ছিলেন এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না।

লুঙ্গির আদি উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে স্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া গেলো না। তবে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, কেনিয়া, ইথিওপিয়াসহ আরো কোন কোন দেশে লুঙ্গি ব্যাপক ব্যবহৃত। জাপানে লুঙ্গি একটা উৎসবের পোশাক। দক্ষিণ ভারতের কোথাও লুঙ্গিকে মুন্ডা, কাইলি ও সারং বলা হয়। মিয়ানমারে বর্মিজ ভাষায় লুঙ্গিকে লোঙ্গাই বলে ডাকা হয়। ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ায়ও লুঙ্গিকে ‘সারং’ বলে, ইয়েমেন-সোমালিয়ায় বলে ‘মাআউইস’।

সোমালিয়ায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ জনতা সবাই অফিস সময়ের বাইরে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে- এরা লুঙ্গির সঙ্গে বেল্ট পরেন। ইন্দোনেশিয়ান-মালয়েশিয়ানরা লুঙ্গির মধ্যে জামা ইন করে পরেন। ওপরে বেল্ট থাকে।

তবে লুঙ্গির উৎপত্তি যেখানেই হোক না কেন, লুঙ্গিকে আমরা আত্মীকরণ করেছি বিভিন্ন সঙ্গত কারণে। যেমন- আরামদায়ক, সহজেই বায়ু চলাচল উপযোগী, দামও সর্বসাধারণের সাধ্যের মধ্যে।

আমার জানামতে কোনো জাতীয় ‘জিনিস’ই নির্ভেজালভাবে বাংলাদেশের না। যেমন, ইলিশ, শাপলা, কাঁঠাল, দোয়েল ইত্যাদি অন্য কয়েকটি দেশেও পাওয়া যায়। মুরুব্বীদের কাছে অবশ্য শুনেছি যে আগেরদিনে বাংলার মানুষ বেশি পরতেন ধুতি, শর্ট পাঞ্জাবি (ব্যাপারী পাঞ্জাবি নামে যেটা পরিচিত, দুই পাশে আর বুকে পাঞ্জাবির মতো পকেট) হাতাকাটা ফতুয়া এবং ঢোলা পাজামা। মূল কম্বিনেশনটা ছিলো পাজামার সঙ্গে ব্যাপারী পাঞ্জাবি আর ধুতির সঙ্গে ব্যাপারী পাঞ্জাবি ও হাতাকাটা ফতুয়া দুটোই।

এ লেখার মূল প্রসঙ্গে ফিরি, জাতীয় সংসদে লুঙ্গি পরে যেতে কোনো বাধা নেই। ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকে কথা বলি সাংসদদের কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানালেন, নিকট অতীতে কাউকে লুঙ্গি পরে সংসদে অধিবেশনে যোগ দিতে দেখেননি। তবে স্বাধীনতার পর পর কয়েকবছর অনেক সাংসদকে লুঙ্গি পরে অধিবেশনে যোগ দিতে দেখা গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন তারা।

১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সাংসদ যশোরের খালেদুর রহমান টিটো একটা চমৎকার তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান, “আমি কাউকে দেখিনি লুঙ্গি পরে অধিবেশনে যেতে। তবে, এতে আইনগত কোনো বাধা নেই। ১৯৮৬ সালে যিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি লুঙ্গি পরেই সেখানে অধিবেশনে যোগ দিতেন।

১৯৯১ সালের ১ আগস্টের দৈনিক বাংলার খবরে জানা যায়, ওই সময়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি জাতিসংঘের মহাসচিব পেরেজ দ্যা কুয়েলারের সঙ্গে প্রথমদিনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
 
১৯৭৩ থেকে ৭৫ পর্যন্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আমলে ঝালকাঠী সদর ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগ সাংসদ ছিলেন আবদুল মকিম। শুনেছি বঙ্গবন্ধু সংসদ অধিবেশনে লুঙ্গি পরিহারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক হলেও শেষ মুহূর্তে আবদুল মকিম বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘মুই (আমি) ঠোঙ্গার (পাজামা) মধ্যে হানতে (ঢুকতে) পারমু না। আপনি আইন-ফাইন যা করেন ওসব হবে না’। বাতিল হয় সংসদে লুঙ্গি বন্ধের উদ্যোগ। জানা গেছে, প্রয়াত মকিমের মতামতের সমর্থক ছিলেন ঢাকার আরো কয়েকজন সাংসদ।     

সবশেষে একটা দাবি উত্থাপন করতে চাই-লুঙ্গি ও ফতুয়া অথবা লুঙ্গি ও ব্যাপারী পাঞ্জাবিকে বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হোক।

সিদ্দিকুর রহমান খান: নিউ এইজ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৩
এসএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।