বিরোধীদলীয় নেত্রী একদিকে ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানান, অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। বৈপরীত্যটি চোখে পড়ার মতো।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা সাবেক ছাত্রনেতা শামসুজ্জামান দুদু একটি জাতীয় গণমাধ্যমে সরাসরি প্রচারিত অনুষ্ঠানে বললেন, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ড. ইমরান এইচ সরকারের দাদা একজন রাজাকার। ড. ইমরান টেলিফোনে সেই একই অনুষ্ঠানে দুদুর এই উক্তিকে সর্বৈব মিথ্যা বলে দুদুকে এই অভিযোগ প্রমাণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। চতুর দুদু তখন বলেন, “সংবাদকর্মীরা এটা প্রমাণ করবে”। যে কেউ যা খুশি বলবে আর তা প্রমাণ করার দায় সংবাদ মাধ্যমের - এটা কোনো সভ্য সমাজের কথা হতে পারে না। অতি সম্প্রতি আরেকটি অনুষ্ঠানে বিএনপির আরেক সাবেক সাংসদ শাখাওয়াত হোসেন বকুল দাবি করলেন, ১৯৭৩ সালে চিহ্নিত রাজাকার শাহ্ আজিজ বঙ্গবন্ধুর সাথে ইসলামি সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) আমন্ত্রণে পাকিসস্তান সফরে গিয়েছিলেন। বকুলের মিথ্যা বলার ধৃষ্টতায় অনেকেই বিমূঢ় হয়েছেন; তবে তার মিথ্যাকে প্রমাণ করার অপপ্রয়াসে যে কারো মনে হতেই পারে, ‘গলাবাজিই তাদের একমাত্র হাতিয়ার’।
বিএনপির এই মিথ্যাচারও নতুন নয়। আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল, ক্ষমতা পেলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবে, এমনকি মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলু ধ্বনি হবে ইত্যাদি নানাবিধ অপপ্রচারে বাংলাদেশের মানুষের কান ভারী করেছে বিএনপি, তাদের জন্মলগ্ন থেকে। বিএনপির এই সাম্প্রদায়িকতাপুষ্ট প্রচারণার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ব্যর্থতা উল্লেখযোগ্য। আওয়ামী লীগ যে হিন্দুর দল নয়, সেটি মিথ্যা প্রমাণ করতে আওয়ামী লীগও আওয়াজ করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা শুরু করে দিল! অথচ সাম্প্রদায়িক মদদপুষ্ট এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আরো বলিষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা কাঙ্ক্ষিত ছিল। ফলে আজকে যখন স্বাধীনতার স্বপক্ষশক্তিখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায়, রাষ্ট্র তখনও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত নয়, বরং সাম্প্রদায়িকতার ক্রমাগত আঘাতে কাতর। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের একের পর এক সাম্প্রদায়িক ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কই?
বিএনপির এ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মূলত নীতি দ্বৈততারই জন্ম দিচ্ছে। মানবতার দোহাই দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা বিএনপি কী করে নিজের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতনকারীদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন দেয়! তাছাড়া বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের মূলে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা, তার সাথেও সংখ্যালঘু নির্যাতন একটি সাংঘর্ষিক বিষয়। যদিও বিএনপির এই কর্মকাণ্ডে হতবাক হবার আছে, কিন্তু অবাক হবার নেই। কেননা, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান অতীতে এমন অনেক নজির রেখেছেন। জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, ২৭ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন – এসবই ঐতিহাসিক সত্য। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ – এটিও ঐতিহাসিক সত্য, যার ভিত্তিতে ’৭২ এর সংবিধানে চার মূলনীতি সন্নিবেশিত হয়েছিল। অথচ মুক্তিযোদ্ধা জিয়া ’৭৫ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ভূ-লুণ্ঠিত করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছেন; চার মূলনীতি একটি একটি করে হত্যা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা জিয়া আর স্বৈরশাসক জিয়া যেন একই ব্যক্তির দুই বিপরীত চরিত্র। এতে জিয়ার সুবিধাবাদী চরিত্র যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি বিএনপির বর্তমান ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ এর ‘শানে নুযুল’ পরিষ্কার হয়।
এই সুযোগে একটি কথা না বললেই নয়, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক(!) বিএনপি শুরুতেই বহুদলীয় ব্যাপারটি দুইভাবে দেখিয়েছে,
এক. বহু মত ও পথ তথা বহুদলের দলছুট রাজনীতিকদের একদলে জায়গা দিয়ে। দুই. একদলকে বহুদলে ভেঙে। বলাই বাহুল্য, এখানেও দ্বৈতনীতিটি লক্ষ্যণীয়।
একটা সময় ছিল, বিশেষ করে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে নব্বইর দশক পর্যন্ত, যখন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনসমূহ যেমন, ছাত্রদল সমর্থন করা আধুনিকতার প্রকাশ বলেই তরুণরা মনে করত। অথচ মাত্র এক দশকের পরিক্রমায় তরুণরা বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এর কারণ, তারানা হালিমের ভাষায়, ‘আদর্শবিহীন আদর্শ’। পরিণতিটি যে শুভকর নয়, তা গত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির মধ্যদিয়ে প্রমাণ হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে, চকচকে মোড়ক খসে পড়ে বিএনপির প্রকৃত কদর্য চেহারাটি ফুটে উঠছে। দ্বৈতনীতি আর মিথ্যাচার আসলে আদর্শহীনতার নামান্তর। এতে রাতারাতি রাজনৈতিক সাফল্য জুটলেও, জনবিচ্ছিন্নতা অবশ্যম্ভাবি– এ বোধোদয়টি বিএনপির জন্য আজকের দিনে খুব জরুরি।
[শাহরিয়ার পাভেল: সিডনি প্রবাসী ব্লগার, কলামিস্ট এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। ই-মেইল: [email protected]]
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৪ ঘণ্টা, ২৩ এপ্রিল ২০১৩
এমজেএফ/আরআর