ঢাকা: সাভারের আট তলা ভবন থেকে এখন লাশ বেরুচ্ছে, হয়ত বেরুবে আরও কয়েকদিন। আমি এখন টিভি দেখছি না।
বাড়তি মুনাফা কিংবা লন্ডন-ম্যানচেস্টার কিংবা নিউইয়র্কের বিশাল দোকান প্রাইম মার্কের তৈরি পোশাক সরবরাহের জন্যে ওই মালিক কিভাবেই না শ্রমিকদের ঠেঙ্গিয়েছেন। পতনের জন্য অপেক্ষা করা ভবনটিতে কিভাবে ওদের ঢুকিয়ে দিয়েছেন? কারণ তারাতো শ্রমিককে আর মানুষ হিসেবে দেখে না, মুনাফা বানানোর জীবন্ত যন্ত্র হিসেবে এই মালিকরা তাদের ব্যবহার করে। তাইতো শত শত নয়, হাজার হাজার শ্রমিককে তারা ঢুকিয়ে দিয়েছে বলতে গেলে একটা ঝুলন্ত-দুলন্ত ভবনে। একটা কবিতার ছন্দের মতো দুলছে ভবন, কাজ করছে শ্রমিক। আর মালিক রানার রক্তে তখন মুনাফার তুফান বয়ে যাচ্ছে। ধ্বসে গেছে আট তলা ভবন। রক্তে আর লাশে তবুও যেন বাড়ছে রানার মুনাফার ডলার।
গার্মেন্টস ফ্যক্টরির মালিক সরকার দলীয় মানুষ, হয়ত প্রকারান্তরে এলাকার একজন মাস্তান। সরকার যাকে পেছন থেকে ঠেলা দিয়ে রাখেন সময়ে সময়ে। সেজন্যেইতো প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগেই ভবন বন্ধ করা হয়েছিলো, মানুষ তার জিনিসপত্র আনতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। কি অদ্ভুদ উক্তি! কি নির্মম রসিকতা ! কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলেন, নড়বড়ে পিলার কিংবা দেয়ালে ধাক্কাধাক্কি করে বিএনপি-জামাতিরা ভবন ধ্বসে দিয়েছে, তখন মনে হয় আমরা আরব্য রজনীর গল্প শুনছি।
সাবেক চৌকস আমলার কি নির্লজ্জ মিথ্যার বেশাতি। এক মধ্যযুগীয় উদাহরণ তিনি নিজেই। যদিও আশার আলো দেখিয়েছেন যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বলেছেন, এটা মানবতা বিরোধী অপরাধ। কয়েকটা নড়বড়ে খুটির উপর একটা আটতলা ভবন নির্মাণ করে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে কর্তৃপক্ষ।
এর জন্যে তিনি দ্রুত বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে এর বিচার দাবি করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারে ক’জন ওবায়দুল কাদের আছেন। আর তাদের মতো নেতা-মন্ত্রীদের কথার মূল্যায়ন-ইবা কতটুকু পার্টির অভ্যন্তরে কিংবা সরকারের উপর মহলে। তবু আমরা বলি, ওবায়দুল কাদের পোড়া খাওয়া জনগণের রাজনীতিবিদ, তাই হয়ত তিনি জনগণের দাবীর প্রতিধ্বনি করেছেন তার কথায়।
ভেঙ্গে পড়া আট তলা ভবন থেকে টেলিফোনে মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি আরও লোমহর্ষক। মানুষগুলো জানছে তারা মরছে। ধুকে ধুকে এরা এখন মৃত্যুর যেন প্রহর গুনছে। একজন পিতাকে ফোন করে তার মেয়ে বলছেন, বাবা আমরা সাত বান্ধবী এখনও বেঁচে আছি, বাবা আমাদেরকে বাঁচাও। তখন পিতা হিসেবে পৃথিবীর অগণিত পিতা জানেন, একজন পিতার অনুভূতি কি হতে পারে। এভাবে হয়ত শত শত পিতা শত শত মা, হাজারো-লাখো মানুষ অপেক্ষার প্রহর গুনছে, কবে বেরিয়ে আসবে তার স্বজনের জীবন্ত শরীর কিংবা রক্তাক্ত-শীতল নিথর দেহ। আমরা শুনছি ভবনে আটকে পড়া দু’জন মা’র নবজাতকের ক্রন্দন। আর টিভি’র পর্দায় দেশবাসী দেখছি আবেগী ফুটেজ কিংবা পত্রিকায় ছবি।
পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিকরা আছে। কিন্তু গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি ক্রমেই বাজার পেয়েছে বাংলাদেশে। কারণটাই বা কি। এখানে শ্রম সস্তা শ্রমিক অসংখ্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পোশাক ব্যবসায়ীরা তাদের পোশাক প্রস্তুতিতে তাইতো তারা দেশ খুঁজে নিয়েছে। চীনে যেখানে একজন পোষাক শ্রমিক প্রায় চার শত ডলার মাসিক মজুরি চায়, কিংবা ব্যাংককে তিনশত, সেখানে আমাদের বাংলাদেশে ৬৫ ডলার। বিদেশি বেনিয়ারা আসবেই না কেন ? ব্যবসায়িরা মুনাফা চায়। দেশীয় লুটেরারা এই সুযোগে হাতিয়ে নেয় অনেক। বড় দ্রুত একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী কোটিপতির খাতায় নাম লিখান।
একটা ডাটা আছে আমাদের মালিকপক্ষের। তারা প্রায়ই সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে বলে বেড়ান তারা প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিকদের কাজ দিয়েছেন। দেশের পোশাকের চাহিদা বিদেশে। বিদেশিরা থাকে পঞ্চমূখ বাংলাদেশের কাপড়ের প্রসংশায়। কিন্তু একটাবারও তারা ভাবনায় নেন না, তারা কিভাবেই না শোষণ করছে ওই শ্রমিকদের। একবারের জন্যেও তারা শ্রমিকদের কোনো স্বার্থ দেখেন না। ওই শ্রমিকরা কোথায় থাকে, সে খেয়ালটুকু তাদের মানবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়লেও শ্রমিরা অবশ্য অতটুকু প্রত্যাশা করে না। একজন শ্রমিক তার কর্মস্থলে অন্তত নিরাপদভাবে কাজ করার পরিবেশেতো থাকতে হবে, কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি মুহূর্তের তার থাকবে মৃত্যুঝুঁকি, সেটাতো মেনে নেয় যায় না।
সরকারের কত যে মন্ত্রনালয়, অথচ দেশের ২৫ লাখ শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনায় কোনো মন্ত্রনালয়ই এগিয়ে আসে না কখনো। এইতো মাত্র মাস চারেক আগে তাজরীন ফ্যাশনস জ্বললো। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হলো শতাধিক মানুষ। এই মানুষগুলো শুধু জ্বলেছিলো মালিকপক্ষের কারণেই। দু’দিন আগেও রানা প্লাজায় যেটা ঘটলো তাও মালিকপক্ষের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। শত শত মানুষকে এরা মেরে ফেললো। মানবতা কোথায় ?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু সেই একই কথা, দলবাজি। রানা যুব লীগের কেউ না। এই সময়টা কি রানা‘র লীগ কিংবা দল নির্ধারণের? লীগ হলেই কি কিংবা বিএনপি হলেই কি? শত শত মানুষ তার কারণেই নিহত হয়েছে, এখনও পাঁচ শতাধিক মানুষ নিখোঁজ। এ এক হত্যাযজ্ঞ। হত্যার দায়ে ঐ মানুষরুপী পিশাচকে আইনের আওতায় আনাটাই এখন সরকারের সামনে প্রধান কাজ। ওর কিংবা ওদের সর্বোচ্চ শাস্তিই দিতে পারে আগামীর গার্মেন্টস শ্রমিকদের অন্তত কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা। লীগ-দল দ্বন্ধটা সামনে আসলেই আমরা ভয় পাই। কারণ আমরা দেখেছি তাজরিনের মালিকেরও কিছু হয় নি। এই লীগ কিংবা দল বাজি আমাদের সবকিছু নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
হাজারো বেদনার মাঝেও তারুণ্য আমাদের ঝিলিক দিয়ে যায়। আশার কথা ধ্বংসস্তুপ থেকে লাশ তোলে আনছে মানুষ। এক ঝাক সাহসী আর মানবতাবাদী অল্পশিক্ষিত তরুণ জান বাজি রেখে কাজ করছে। এরা শত শত মানুষকে নিয়ে আসছে অন্ধকার ধ্বংসস্তূপ থেকে। হামাগুড়ি দিয়ে, দেয়ালের ফাঁকে মানুষ ডোকার মতো ছোট্ট গর্তের মধ্যে দিয়ে এরা ঢুকছে, নিয়ে আসছে জীবন্ত মানুষ। এরাইতো আমাদের বাঁচায়। এরাই একাত্তরে যুদ্ধ করেছে, শহীদ হয়েছে স্বাধীনতা নিয়ে এসেছে। এরাই যুদ্ধ করে, এরাই বাঁচায়। এরা বইয়ের মানবতার সংজ্ঞা বোঝে না। কিন্তু এরাই মানবতা শিখিয়ে দিয়ে যায়। চপেটাঘাত করে মেকি মনবতাবাদীদের। মানবতার মিথ্যা জয়গান গাওয়া নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ একটবারও কি ভেবে দেখবেন না? আর কতকাল আমরা থেকে যাবো বিচারহীন ? আর কতকাল এভাবেই বাড়তে থাকবে লাশের সারি, আহাজারী করা মানুষের মিছিল ?
ফারুক যোশী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৩