এই মুহূর্তে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি দেশ নিয়ে ভাবেন না, এমনকি কোমলমতি শিশুরা যারা হরতালের কারণে স্কুলে যেতে পারছে না, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলিতেও যাদের এখন ক্লাশ করতে হচ্ছে, যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে তারাও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সাধারণ মানুষের এই উদ্বেগ আর রাজনৈতিক দলগুলোর দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে, সন্দেহ নেই।
মজার ব্যাপার হলো, এসবই তারা করছে জনগণের নামে, জনগণের জন্য। হাসবো না কাঁদবো!!!
আমার গাড়িটি আমারই নামে ভাঙা হবে, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবো না, কিছু করতে গেলে হয়তো আমার প্রাণটাও যাবে- জনগণ এই দশায় সত্যিকার অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছে।
অপরদিকে সরকার তার অবস্থানে অনড়, চার-পঞ্চমাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা কোনো সরকারকে
বিরোধী দলের এরকম জনগণবিদ্বেষী প্রোগ্রাম দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না- সরকার এই মেসেজটিই
জনগণকে দিতে চাইছে। এটা অস্বাভাবিক নয়, দেশের ভেতর অরাজকতা নিরসন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব, সরকার সে দায়িত্ব পালন করতে চাইছে। তাতে সরকারকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কঠোরও হতে হচ্ছে, কিন্তু এর বিকল্প আর কোনো কিছু সরকারের হাতে আছে কি না সেটি আমরা কেউই বুঝতে পারছি না, বা চাইছি না। সরকারের এই কঠোরতাকে কেউ কেউ অগণতান্ত্রিক বলে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন, তাদের কথাকেও অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। ফলে দমবন্ধ অবস্থায় পড়েছে গোটা দেশ ও জাতি। এর থেকে উত্তরণের পথ কেউ বাতলে দিচ্ছে না। নিত্য-নতুন ফরমুলার নামে যেসব কথামালা আমরা শুনছি তা আর কিছুই নয়, যেনতেন উপায়ে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে সরিয়ে দেয়া এবং ‘পরেরটা পরে দেখা যাবে’- ভাবখানা এমনই। আসলে আমরা সব সময়ই সমস্যার এরকম একপেশে সাময়িক সমাধানে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
যেমনটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও, একটি জটিল পরিস্থিতিতে সাময়িক সমাধান হিসেবে আমরা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পেয়েছিলাম, আজকে তাই-ই আমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকে এই ব্যবস্থা নিয়েই দু’পক্ষের টানাপড়েনে দেশ, জাতি, অর্থনীতি, সবই আজ গোল্লায় যেতে বসেছে।
আসুন, আমরা সংক্ষেপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা দেখে আসি। যদিও আমার যা বলার কথা সবই আপনারা জানেন, তারপরও স্মৃতি ঝালিয়ে নেয়া যাক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের প্রথম সরকারকে আমরা বাদ দিতে পারি কারণ সেই অর্থে তার সরকার তত্ত্বাবধায়ক ছিল না। জেনারেল এরশাদ সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে তিনি রাষ্ট্রপতি হন, সেই অর্থে তার সরকার একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারই এবং তিনি একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করেই বিদায় নেন। মূলতঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জনপ্রিয়তা পায় মাগুরার তথাকথিত উপনির্বাচনের পর থেকে। ৯৬-এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি’র একদলীয় নির্বাচনের পর তা গণদাবিতেও পরিণত হয়। যদিও সেই সংসদই এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন করে কিন্তু এরকম একটি এক দলীয় নির্বাচনই যে আমাদের আরেকটি ‘‘অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত” ব্যবস্থা উপহার দেয়, তা বলাই বাহুল্য। তবে একটু পেছনে ফিরলে দেখতে পাই যে, ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানকালে তিন জোটের রূপরেখায় বলা হয়েছিল যে, তিনবার তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে এবং গণতন্ত্র স্থিতিশীল হলেই এই ব্যবস্থা তুলে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু বেগম জিয়া ৯৬-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে যথার্থই বলেছিলেন যে, একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়; যার প্রমাণ আমরা বহুবার পেয়েছি পরবর্তীকালে। বিশেষকরে ৯৬-তেই, তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রণীত হওয়ার অব্যবহিত পরেই বেগম জিয়ার রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস তুচ্ছ কারণে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে বরখাস্ত করেন এবং নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার ব্যবস্থা নেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান সে সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে তিনি জীবিত না মৃত বের হবেন সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না।
পরিস্থিতি তখন এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে, বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়েই টান পড়েছিল সে সময়।
যাহোক নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করলো আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছর মোটামুটি সরকার পরিচালনা শেষে বিদায় নিলো দুই বিচারপতির হাতে ক্ষমতা রেখে। প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন বিচারপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও একজন বিচারপতি। দু’জনের বিচারের ওপর জাতির আস্থা রাখার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু দেখা গেলো, ক্ষমতা গ্রহণের আগেই তিনি প্রশাসনকে ওলোট-পালট করে বসে আছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বিচারপতি লতিফুর রহমান যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন তাতে সেনাবাহিনীর ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০১
সালের নির্বাচনে জেনারেল হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে পাকিস্তানের কাছ থেকে অর্থ উৎকোচ গ্রহণের এবং
সেনাবাহিনী যে সেই নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি তা বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও উল্লেখ করেছিল।
তারপরও না হয় তর্কের খাতিরে বলি যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছিল, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার কথা না হয় আমরা
নাইবা বললাম। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের সরকার সম্পর্কেও নতুন করে কিছু বলার নেই।
জাতীয় পতাকার এমন অবমাননা আর কখনও এদেশে হয়নি, আর হবে বলেও বিশ্বাস করি না। এ দেশের
বিরোধিতাকারী রাজাকারের গাড়িতে আমরা উড়তে দেখেছি জাতীয় পতাকা। এলো ২০০৬ সাল। বিএনপি-জামায়াত জোট বয়স বাড়িয়ে বিচারপতি হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে চাইলেন। নির্বাচন কমিশনার করা হলো আরেক বিচারপতিকে, যিনি আবার জজিয়তির দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি নিলেন না। যে ভোটার লিস্ট নিয়ে তিনি নির্বাচন করতে চাইলেন আদালতের নির্দেশেই তা বাতিল বলে গণ্য হলো। তিনি নিজে
আপিল বিভাগের বিচারক হওয়া সত্ত্বেও আরেক কনিষ্ঠ বিচারকের রায়ে তার ভোটার লিস্ট মিথ্যে প্রমাণিত
হওয়ার পরও তিনি আঁকড়ে রইলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদটি। শুরু হলো আন্দোলন। এমনকি বাজারের
মাছ আর সব্জি দোকানিও সিইসির কাছে মাছ-সব্জি বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানালো। বিএনপি-জামায়াত জোট
যখন এরশাদকে তাদের দলে ভেড়াতে ব্যর্থ হলো তখন তার নমিনেশন বাতিল ঘোষণা করলো। এবং সেই সময়
বিচারপতি আজিজ সাহেব এক উক্তি করেছিলেন যা এখনও মনে পড়লে হাসি পায়। যতোদূর মনে পড়ে তখনই তিনি বলেছিলেন, কে কি চাইছে তা দেখার বিষয় নয়, এখন সংবিধান অনুযায়ী সবকিছু হবে, রাম রাম রাম, নির্বাচন নির্বাচন নির্বাচন। এতোকিছুর পরও আমাদের কাছে তত্ত্বাবধায়কই শ্রেষ্ঠ, তাই আমরা আবার পেলাম ইয়াজউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই সম্পর্কে যতো কম বলা যায় ততোই ভালো। তারপর পেলাম ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যদিও আমরা জানি না যে, কোন্্ সে সাংবিধানিক নিয়মে এই সরকার দীর্ঘ দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে পারলো? কেনই বা এই দুই বছরে দেশের রাজনীতিকে একেবারে ছারখার করে দিয়ে গেলো? রাজনীতিবিদদের জেলে নিয়ে, অর্থ দিয়ে কেনাকাটা করে, নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দিতে গিয়ে, ব্যবসায়ী সমাজকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে- এই দুই উদ্দীন-সরকার আমাদের ঘাড় থেকে নামার আগে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছিল। হ্যাঁ, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অনেক নষ্ট’র ভেতরে এটাই একমাত্র ইতিবাচক দিক, কারণ এই প্রথম আমরা দেখতে পেলাম যে, একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকায় দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু তার কৃতিত্ব মোটেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নয়, বরং দেশি-বিদেশি চাপ ও তাপের মুখে দুই উদ্দীন-সরকারের একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া ছাড়া তাদের সামনে “ফেয়ার এক্সিটের” আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখুন, বিগত এতোগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে একমাত্র বিচারপতি হাবিবুর রহমান ছাড়া আর কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাই লোকসম্মুখে নেই, তারা সকলেই চলে গিয়েছেন সমাজের অন্তরালে, তারা এমন কি অন্যায় করেছেন যে, তাদেরকে মানুষের সামনে আসতেও লজ্জা পেতে হচ্ছে? ফখরুদ্দিন, মঈনুদ্দীনতো গিয়ে বসে আছেন আমেরিকায়, অর্থাৎ তারা ভাবতেও পারছেন না যে দেশে ফিরবেন। এইতো হলো, আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইতিহাস এবং আমাদের অভিজ্ঞতা। এখনও কেন তত্ত্বাবধায়ক? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো আমরা এখন।
২.
এই মুহূর্তে জাতির সামনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোটামুটিভাবে দু’টো পথ খোলা আছে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পদ্ধতি মেনে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করা এবং সে অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। দুই. পৃথিবীর উন্নত ও প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশের মতোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠান, যা আওয়ামী লীগ করতে চাইছে।
তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিচ্ছি যে, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হলো। এবং সে অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হলেন। ওদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ সাহেবতো রইলেনই। তখন বিএনপি কী করবে? মেনে নেবে সে সরকারকে? আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে, বিএনপি সে সরকার মানবে না। মজার ব্যাপার হলো, বিএনপি এখনও পর্যন্ত আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেমন হবে তার কোনো রূপরেখা দেয়নি। আওয়ামী লীগও বার বার একথাটিই বলছে যে, আপনারা একটি রূপরেখা দিন তারপর আলোচনায় আসা যাবে। কিন্তু বিএনপি’র এক কথা, তত্ত্বাবধায়ক চাই। কিন্তু একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এমন কোনো আইন সংবিধানে সংযুক্ত করেও তাহলে তাদেরকে কি আমরা দোষ দিতে পারি? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এমন কোনো ”উন্নত গণতান্ত্রিক” ব্যবস্থাও নয় যে, এর জন্য আমাদের প্রাণপাত করতে হবে এবং সরকারকে এ জন্য দোষারোপ করতে হবে।
তারপরও হামিদ-খায়রুলের অধীনে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হয় তাহলে দল হিসেবে হয়তো আওয়ামী লীগের
হারানোর কিছুই থাকবে না, কিন্তু বিএনপি কি সেটা মেনে নেবে?
এবার আসি শেষ এবং বহুল চর্চিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির স্বাভাবিক নির্বাচনী পন্থায়। আওয়ামী লীগ বলতে চাইছে যে, নির্বাচনের আগে ”স্বাভাবিক নিয়মিত সরকার” না থেকে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের মতো তারা কাজ করবে।
সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনই পালন করবে মূল দায়িত্ব। বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো নেতিবাচক বক্তব্য রাখেনি। ফলে ধরে নেয়া যায় যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে তারা মেনে নেবে। সেই
অন্তর্বর্তী সরকারে কোনো স্ট্রাটিজিক সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগ থাকবে না, নৈমিত্যিক কাজগুলো ছাড়া, যেরকমটি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে হয়ে তাকে। বিশেষ করে নির্বাচনে বা নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের ওপর প্রভাব থাকবে এমন কোনো কাজ নির্বাচনকালীন সরকার করবে না, এটাই স্বাভাবিক রীতি। এর বাইরে অন্যথা কিছু ঘটলে, বাংলাদেশের মানুষ সেটা মেনে নেবে বলে বিশ্বাস করি না, মানুষকে আর অজ্ঞ ভাববার কোনোই কারণ নেই।
আমরা জানি যে, আওয়ামী লীগ একটি নির্বাচনমুখী দল, এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিকও বটে। ফলে কোনো রকম প্রভাব বিস্তার করে কিংবা কারচুপি করে কিংবা বিদেশি শক্তির ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, এমনটি বিশ্বাস করা কষ্টকর। কারণ অতীত ইতিহাস আমাদের সেরকম কোনো নির্দেশনা দেয় না। তারপরও যদি আওয়ামী লীগ সেটা করে তাহলে তিন মাসের বেশি দলটি ক্ষমতায় থাকতে পারবে বলে প্রত্যয় হয় না। এবং তার পর আওয়ামী লীগকে যে রাজনৈতিক-মূল্য দিতে হবে, অর্থাৎ জনগণের কাছে দলটিকে যে হেয় হতে হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি’কে মানুষ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আনবে- আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই এরকম মূল্য দিতে রাজি হবে না। আর যদি দেয়ও তাহলে পরিণতিও তাকে ভোগ করতে হবে, সেক্ষেত্রে সেটি হবে এক স্বাভাবিক পন্থায়, কোনো প্রকার অস্বাভাবিক ”তত্ত্বাবধায়কীয়” পথে নয়। মোটকথা এভাবে যদি আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় তাহলেও আজকের পরিস্থিতি বিচারে বলা যায় যে, আওয়ামী লীগ দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরবে না। যদি হারেও সে হার হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় পরাজয় এবং নতুন ইতিহাস সৃষ্টিকারী, যেটা বিএনপি’র জন্যও হবে অত্যন্ত সম্মানজনক জয়। অপরদিকে বিএনপি যদি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দ্বারা স্বীকৃত কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে পরাজয়ও বরণ করে তাহলে তাদের জন্যও সে পরাজয় হবে সুখকর।
মোটকথা বাংলাদেশে এ যাবত যা ঘটেনি, তাই-ই ঘটাতে চাইছে আওয়ামী লীগ। যদি এতে দলটি সফল হয় তাহলে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি এক লাফে বিজ্ঞ হয়ে উঠবে আর যদি আওয়ামী লীগ কোনো দুর্ঘটনা ঘটায় তাহলেও জনগণের কাছে দলটি অনেকদিনের জন্য ”দুই নাম্বারি” হয়ে থাকবে। স্বাভাবিক পথের এই নির্বাচনে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত কিন্তু আওয়ামী লীগই, এবং সবদিক দিয়েই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে বিএনপি-ই।
কিন্তু জনগণের জন্য আজকে এই দু’পক্ষের টানাপড়েন যে অসহ্য সেকথা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। জনগণ
হয়তো সাময়িক সমাধান হিসেবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথাই বলবে কারণ সরকার
এটি মেনে নিলেই বিএনপি সুবোধ বালকের মতো জ্বালাও-পোড়াও-হত্যাকা- বন্ধ করে দেবে, এরকমটিই অনেকে ভাবছেন হয়তো। কিন্তু পরিস্থিতি ততোটা সরল বলে মনে হচ্ছে না। বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মকান্ডে মনে হচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগকে সরাতে পারলেই খুশি, পরবর্তী সময়ে কী হবে সেটা তখন দেখা যাবে। অন্ততঃ এই সরকারকে সরানো গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো যাবে এবং তারপর একটি নির্বাচন যেনতেন প্রকারে হলে ভালো, নাহলে থাকুক না তত্ত্বাবধায়ক নামের কোনো অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক, অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায়, যতোদিন ইচ্ছা!!! কিন্তু ভাইরে, দেশের যে বারোটা বেজে যাচ্ছে, তার কী হবে?
ঢাকা, ৩০ এপ্রিল, মঙ্গলবার॥ ২০১৩॥
[email protected]
সম্পাদনা: জেএম