ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সিগারেটের শুল্ক কেন কমনো হয়!

ডা: মোহাম্মদ আব্দুস সবুর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৬ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৩
সিগারেটের শুল্ক কেন কমনো হয়!

অনেকেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিড়ি তৈরি বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলছেন। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনাতেই রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা এ শিল্প বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছেন।



সেই একই সভায় এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে জানানো হয় তামাকজাত পণ্যের মধ্যে সিগারেটের চাহিদা ৬০ শতাংশ আর বাকি ৪০ শতাংশ চাহিদা মেটে বিড়িসহ অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ব্যাপারটি বিবেচনায় নিলে যেহেতু সিগারেটের চাহিদা ও ব্যবহার বেশী তাহলে সেটিই তো বন্ধ করা দরকার সবার আগে। তা না করে যেটির চাহিদা কম, সেটি বন্ধ করার কথা কেন বলছেন?

আমাদের যথেষ্ট ধারনা রয়েছে, একশ্রেণীর আমলা দেশের উপকারের চাইতে নিজের উপকারটি বোঝেন অনেক ভালো। অনেক ক্ষেত্রে দেশের স্বাস্থ্য জলাঞ্জলী দিয়ে হলেও এরা অন্যের স্বার্থ রক্ষা করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়।

ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু ধূমপানের ক্ষতির দিকের ধূয়া তুলো যখন তারা সিগারেট রক্ষাই শুধু নয়, তার সম্প্রসারণের স্বার্থে কাজ করে। তখন তাদের আসল মতলব বুঝতে অসুবিধা হয় না।

ধূমপানের সকল উৎসের মাঝে সিগারেটের ব্যবহার সবচেয়ে বেশী। সুতরাং ধূমপান থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে সিগারেটের ব্যবহারকে করতে হবে সীমিত। অথচ আমরা কি দেখছি?

সিগারেটের জয়রথ চলছে একরকম বিনা প্রতিদ্বন্দিতায়। বছরের পর বছর সিগারেটের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে, বাড়ছে ধুমপায়ীর সংখ্যা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতির স্বাস্থ্য। আর এই সিগারেটের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে জাতীয় এক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়।

যে দেশে দ্রব্যমূল্যের ধাক্কায় সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেখানে সিগারেটের শুল্ক কমানো হয় কার স্বার্থে? ২০০৩-২০০৪ অর্থ বছরে যেখানে সর্বনিম্ন মূল্যস্তরের সিগারেটের শুল্ক ছিল ৩৫ শতাংশ, সেটি পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে কমিয়ে করা হলো ৩২ শতাংশ।

সিগারেটের প্রতি এই খেলামেলা প্রীতি কি জাতির স্বাস্থ্য রক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখায় না? বর্তমানে প্রচলিত সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক চার মূল্যস্তরে করা হয়েছে অতি উচ্চ ৬১, উচ্চ ৫৯, মধ্যম ৫৬ ও নিম্ন ৩৯ শতাংশ হিসেবে।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে যেখানে অতি উচ্চ থেকে উচ্চ ধাপের এবং উচ্চ থেকে মধ্যম ধাপের পার্থক্য যথাক্রমে ২ ও ৩ শতাংশ সেখানে মাধ্যম থেকে নিম্নধাপের পার্থক্য ১৭ শতাংশ কেন? কার স্বার্থে এই কারসাজি?

সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, আমলাদের  সিগারেট প্রীতির ত্রুটি আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সর্বনিম্ন ধাপ লাফ দিয়ে নামিয়ে আনা হয়েছে সস্তায় সিগারেটের লভ্যতা নিশ্চিত করতে। যাতে সিগারেটের বাজার হয় আরও সম্প্রসারিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অনুকূল শুল্ক সুবিধা পেয়ে বাংলাদেশ হয়েছে সর্বোচ্চ সস্তায় সিগারেট প্রাপ্তির দেশ।   

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপালে সিাগরেটের শুল্ক ৭০ শতাংশ, ভারত ও শ্রীলংকায় ৫৮ শতাংশ অথচ বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ। সস্তায় সিগারেটের কারণে ধূমপান বাড়ছে।

উল্লেখ্য, সরকার ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কাঙ্খিত সাফল্য আসছে না। প্রচলিত সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক চার মূল্যস্তরে করা হয়েছে। অতি উচ্চ ৬১, উচ্চ ৫৯, মধ্যম ৫৬ ও নিম্ন ৩৯ শতাংশ হিসেবে।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে যেখানে অতি উচ্চ থেকে উচ্চ ধাপের এবং উচ্চ থেকে মধ্যম ধাপের পার্থক্য যথাক্রমে ২ ও ৩ শতাংশ সেখানে মাধ্যম থেকে নিম্নধাপের পার্থক্য ১৭ শতাংশ কেন? কার স্বার্থে এই কারসাজি?  

বিশেষ গোষ্ঠীর সহযোগিতায় অনুকুল শুল্ক সুবিধা পেয়ে বাংলাদেশ হয়েছে সর্বোচ্চ সস্তায় সিগারেট প্রাপ্তির দেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশুগুলোর মধ্যে নেপালে সিাগরেটে শুল্ক ৭০ শতাংশ, ভারত ও শ্রীলংকায় ৫৮ শতাংশ অথচ বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ। সস্তায় সিগারেটের কারণে ধুমপান বাড়ছে। উল্লেখ্য, সরকার ধুমপানকে নিরুৎসাহিত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কোন কোন কোম্পানিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে।

দুটি সিগারেট কোম্পানীকে অনৈতিকভাবে আর্থিক আনুকূল্য প্রদর্শন করে গত ১৯৯১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১২০ কোটি টাকা ব্যান্ডরোল কেনার জন্য লোন সুবিধা প্রদান করেছে। এই বিশেষ সুবিধার জন্য ওই কোম্পানী দুটি বেআইনি ও পক্ষপাতদুষ্টভাবে ৩৭৮০ কোটি টাকা অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করেছে।

একটি শ্রেণী বহুজাতিক কোম্পানীর দোসর হয়ে সিগারেটের বাজার বৃদ্ধি করতে গিয়ে ধ্বংস করছে দেশের কুটির শিল্প বিড়িকে।

ঔপনিবেশিক আমলে বিদেশি পণ্য বর্জনের আন্দোলনে প্রচলন হয় বিড়ি শিল্পের। তারপর এই শিল্পকে সহ্য করতে হয়েছে আইয়ুব খানের রোষাণল। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের দোহাই দিয়ে বিড়ি শিল্পের অন্যতম কাঁচামালে টেন্ডুপাতা আমাদানি বন্ধ করে দেওয়া হয় ভারত থেকে।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতায় আবার গতি পায় এ শিল্প কুম্ভি পাতায় তৈরী হয়ে। পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে ফের পক্ষাঘাত আসে কুম্ভি পাতার বিড়ি বন্ধের সিদ্ধান্তে।

অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বিড়ি পরিবর্তিত হয় হাতে তৈরী সিগারেট নামে কাগজে তৈরী হয়ে। বহুজাতিক কোম্পানির সিগারেটের বাজার সম্প্রসারণের আগ্রাসনে বিড়ি পরিণত হয় অন্যতম টার্গেটে। ক্রমাগত হারে বাড়ানো হতে থাকে বিড়ির উপর শুল্ক।

২০০০-০১ অর্থ বছরে প্রতি হাজার বিড়ির শুল্ক ছিল ৩০.৯০ টাকা, যেটি ২০১২-১৩ তে হয়েছে ৫০.৮৮ টাকা। একই সমযে শুল্ক হারের আনুকূল্য পেয়ে সিগারেট দখল করেছে বিড়ির বাজার। বন্ধ হয়েছে বিড়ির কারখানা, বেকার হয়েছে বিড়ির শ্রমিক।

অথচ বিড়ির কারখানাগুলো নদী ভাঙ্গন ও মঙ্গাকবলিত অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে গ্রামীণ পরিবেশে হত দরিদ্র মহিলাদের কর্মসংস্থানের আর কোন সুযোগ নেই।

২০০৯ সালের ২৯ জুন জাতীয় সংসদে বলা হয়- “বিড়ি আমাদের, সাধারণত আমাদের গরীব মানুষ ব্যবহার করে। এই বিড়ি বানানোতে আমাদের গরীব মানুষ, মহিলা শ্রমিক ও সাধারণ শ্রমিক একটা শ্রমের সুযোগ পায়, তারা কাজ পায়।

বিড়ির উপর কমিয়ে, মুসক বৃদ্ধির প্রস্তাব বাদ দিয়ে এবং সিগারেটের উপর একটু বেশী করে বাড়িয়ে দিতে হবে। সিগারেটের উপর কমানে যাবে না। ” এরপরও  বিড়ি শিল্প বন্ধ করে দেবার ঘোষণা কেন?

বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানির গোলামী করে আর কতভাবে এই আমলা জাতির স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন?

ডা: মোহাম্মদ আব্দুস সবুর, জনস্বাস্থ্য, সিনিয়র  উপদেষ্টা, সিএইচটিডিএফ, ইউএনডিপি

বাংলাদেশ সময় : ১১৫৫ ঘণ্টা, মে ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।