হেফাজতে ইসলাম দেশের বাণিজ্যিক কেন্দ্রে ১২ ঘণ্টার মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালানোর পর ৬ মে রাতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যৌথ অভিযান “অভিযান শাপলা” পরিচালনা করে। এই যৌক্তিক অভিযানটি যেমন অনেককে স্বস্তি দিয়েছে, তেমনি অনেককেই করেছে হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
অন্যদিকে হতাশ করেছে তাদের, যারা এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।
কিন্তু সরকার সময়োপযোগী অভিযানটি পরিচালনা করায় এই চক্রান্ত সফল হয়নি। এ ঘটনা ক্ষুব্ধ করেছে অনেককেই। কারণ তাদের মতে, সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই সমানভাবে দায়ী। অনেকেরেই অভিযোগ যে সমাজের এই অবহেলিত ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে নিজেদের ক্ষমতার লালসার জন্য নগ্নভাবে ব্যবহার করছে বিরোধী দল। সরকার হেফাজতে ইসলামের নেতা কর্মীদের তাড়িয়ে দিতে যেভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করছে, সেটাও আবার মেনে নিতে পারছে না অনেকে।
হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের প্রথম থেকেই বলে আসছিল তাদের আন্দোলন ইসলামের ঈমান রক্ষার আন্দোলন। কিন্তু যে প্রশ্নটি কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরেফিরে আসছিল, তা হলো শুধুই কি ঈমান রক্ষার আন্দোলন করাই হেফাজতে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য? নাকি ঈমান রক্ষার আন্দোলনের মোড়কে দেশে একটি অরাজক পরিবেশ তৈরি করা, একটি সহিংস প্রেক্ষাপট তৈরি করা— যার ফলে অন্য একটি শক্তির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়। সংগত কারণেই এ ধরনের একটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করা গেলে যে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে এতে সন্দেহ নেই। তাদের আন্দোলনের পেছনে এটিও যে একটি প্রধান কারণ ছিল তা আজ সবার কাছে পরিষ্কার।
মূলত হেফাজত ইসলামের জন্ম হয়েছিল একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে। তারা বর্তমান সরকারপ্রণীত শিক্ষানীতি নিয়ে বেশ সরব ছিল। দেশের অধিকাংশ মানুষই জানতো না হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে। সংগঠনটি রাজনৈতিক আলোচনায় বেশ গুরুত্ব পায় গত কিছুদিন ধরে। বিশেষ করে গত ৫ এপ্রিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নে সরকারকে একমাস সময় দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে তারা। কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এই সংগঠনটির সাথে ১৮ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি ইসলামিক দল জড়িত। তাছাড়া বিএনপির নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন সংগঠনটির ঈমান রক্ষার আন্দোলনের আদর্শিক অবস্থানকে প্রথম থেকেই বিতর্কের ট্যাগ লাগিয়ে দেয়। তবে মূল সন্দেহের তীরটি ছিল জামায়াতে ইসলামীর ওপর।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার মধ্যে বেশ কয়েকটি বর্তমান সংবিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই সব দফা বাস্তবায়ন করতে হলে দেশের শাসন ব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তন করতে হবে, যা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দাবি রাখে। তাই হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনকে রাজনৈতিক না বলার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
দেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক বাস্তবতায় এ দফাগুলো যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয় তা হেফাজতে ইসলামের নেতা কর্মীরাও ভালো করেই জানে। তাদের প্রধান রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও এই ১৩ দফা বাস্তবায়ন করবে কিনা, বিএনপি তাও কিন্তু জনগণের সামনে পরিষ্কার করেনি। হেফাজতে ইসলাম ৫ মে’র সমাবেশ থেকে ঘোষণা দিয়েছিল যে ১৩ দফা বাস্তবায়ন না করলে সরকারে পতনের এক দফা নিয়ে আন্দোলন করবে তারা। যা একটি রাজনৈতিক দাবি।
আমাদের বাঙালির কৃষ্টি, কালচার ও ঐতিহ্য কয়েক হাজার বছরের। আমাদের সংবিধান একটি মহান যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত। এখানে সকল ধর্মের, সকল শ্রেণীর মানুষের ত্যাগ তিতিক্ষার অবদান রয়েছে। হেফাজতের ১৩ দফা আমাদের হাজার বছরের কৃষ্টি, কালচার ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এই ১৩ দফা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী এবং সর্বপরি গণতন্ত্রের পরিপন্থী। তাই তাদের দাবিগুলোকে শুধু ইসলামী ঈমান রক্ষার আন্দোলন হিসেবে একক বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।
ইসলামের ঈমান রক্ষার জন্য বাংলাদেশে এর আগেও আন্দোলন হয়েছে। ১৯৭৮ সালের দিকে ‘আমার ঢাকা বাসি’ ও ‘খতমে নবুয়ত আন্দোলন’ নামে দুইটি সংগঠন পাকিস্তানের অর্থায়নে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। ১৯৯৪ সালে নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ বইকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে কিছু ইসলামিক সংগঠন রাজপথে আন্দোলন করেছিল। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের মতো কোনো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ট্যাগ তাদের গায়ে লাগেনি। কারণ আন্দোলনকারীরা হেফাজতে ইসলামের মতো কখনো বলেনি যে, ক্ষমতায় আসা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়া নির্ভর করবে তাদের দাবি বাস্তবায়নের উপর। তাদের কেউ বলেনি যে, এই তারিখের পর কোনো নাস্তিক সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। হেফাজতে ইসলামের মতো কোনো সংগঠনই দেশব্যাপী সমাবেশ করে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়নি। হেফাজতে ইসলামের মতো মসজিদ ও মাদ্রাসার মাইক ব্যবহার করে মানুষ হত্যার অভিযোগও ওঠেনি তাদের বিরুদ্ধে। হেফাজতে ইসলামের ওপর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিযোগটি হলো, স্বঘোষিত নাস্তিকদের মঞ্চে নিয়ে তথাকথিত নাস্তিকদের বিরোধে আন্দোলন। ইসলামের নামে তথাকথিত ঈমান রক্ষার আন্দোলনের উদ্দেশ্যটা তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
অভিযান শাপলা পরিচালনার পরে এই নব ইসলামিক শক্তির বিষয়ে নানাবিধ তথ্য গণমাধ্যমে আসতে শুর করে। বিশেষ করে হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবু নাগরীকে গ্রেফতার করার পর অনেক সংবেদনশীল তথ্য আমরা জানতে পারি। ৫ তারিখের সমাবেশে আল্লামা শফি আহমদের না আসাটা যে সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের অংশ ও পূর্ব পরিকল্পিত তা এখন সবাই জানে। সরকার বেশ সফলতার সহিত অভিযানটি শেষ করে। অভিযান পরবর্তী সময়েও হেফাজতে ইসলাম নিজেদের রাজনৈতিক বলয় থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে— এমন দেখা যায়নি। এখনও বিএনপির তৈরি করা ধোঁয়াটে আয়নায় হেফাজতে ইসলামকে দেখা যাচ্ছে। বিএনপির দেওয়া নিহতের কাল্পনিক সংখ্যা নিয়ে বার বার হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কী জানাতে তাগিদ দিলেও তাদের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো পরিষ্কার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের এই অস্পষ্টতা হলো রাজনৈতিক অসাধুতা ও হিপোক্রেসি।
মজার বিষয় হলো, কল্পিত গণহত্যার প্রতিবাদে ১৮ দলীয় জোট দুই দিন হরতাল দিলেও হেফাজতে ইসলাম কিন্তু হরতালে সমর্থন দেয়নি। তারা নিজস্ব উদ্যোগে ১২ মে হরতালের ডাক দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের কুখ্যাত গণহত্যাকারী জামায়েতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়ের পর হেফাজতে ইসলাম তাদের পূর্বঘোষিত হরতাল কর্মসূচি স্থগিত করে। গণ মানুষের ধারণা জামায়েত ইসলামকে হরতালের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই তাদের হরতাল কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন সময়, বিষয় ও বৈশিষ্ট্যগত মূল্যায়নে প্রথম থেকেই রাজনৈতিক পোশাকে সজ্জিত ছিল। এই পোশাককে চিনতে সাধারণ জনগণের কিছু সময় লাগলো। ইসলাম ও ঈমান রক্ষার নামে এই সংগঠনটি যে নানা চক্রান্তে লিপ্ত তা আজ স্পষ্ট। তবে এই নতুন রাজনৈতিক শক্তির ভবিষ্যৎ প্রায় অতীত। আর যাই হোক লেজুড়ভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শ ও অন্যের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখে কোনো ঈমান রক্ষার আন্দোলন আজ অবধি সফলতার মুখ দেখেনি। তাই হেফাজত ইসলাম এখন অতীতের পথে। তবে এই আদর্শের উপাদানগুলো আমাদের রাজনৈতিক কালচারে রিজার্ভ ফোর্স হিসাবে থেকেছে। সময় পরিক্রমায় শুধুমাত্র ভোট ব্যাংক হিসাবে না থেকে তারা কখনো নিজস্ব রাজনৈতিক অস্তিত্বকে জানান দেবে কি না, প্রসারিত করবে কি না— তা বোঝার জন্য আরও কয়েকটি টার্ম অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক:
গবেষক ও কলাম লেখক
চন্নাম ন্যাশানাল বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথ কোরিয়া
ইমেইল : [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৩
সম্পাদনা: তানিম কবির, নিউজরুম এডিটর;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর