জাতীর পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন--রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সে উচ্চারণ যেন বার বার ফিরে আসে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্র সম্পর্কে।
দেশের স্বার্থবিরোধী রাজনীতিকরা তাদের ক্ষমতার মসনদ পাকা-পোক্ত করার জন্য আমদের পুরনো পরীক্ষিত শত্রুর কাছে বার বার বিকিয়ে দেয় দেশের স্বার্থ।
রানা প্লাজায় যখন মৃত্যুর মিছিল, মানবতার মহাশ্মশান, মহানীরবতা, তখন স্বার্থ ও লুটপাটের ধান্দায় লিপ্ত উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমেরিকা। সঙ্গে আছে এ দেশীয় পুঁজিবাদের মোসাহেব দোসররা।
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, দায়দায়িত্ব, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা হচ্ছে, সভা-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যেই আরও জোরদার হয়েছে বাংলাদেশকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধা প্রত্যাহারের হুমকি। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি স্বাক্ষরের চাপ। ঘর পোড়া আগুনে আলুপোড়ানোর ধান্ধায় ওঁৎ পেতে আছে আমেরিকা।
আমাদের বর্তমান সময়ে এ বিষয়ে সারা দেশে প্রচলিত ও প্রচারিত উদ্বেগের সারকথা হলো, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার গার্মেন্টসের বিশাল বাজার হারাবে। এই বাজার রক্ষা করতে হবে। অতএব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অতি তাড়াতাড়ি টিকফা চুক্তি সম্পাদন করা উচিত। ”
এছাড়া প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস হলো, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অর্থ দেয়, খাদ্য দেয়, নানা রকম সুবিধা দেয়, নইলে বাংলাদেশ ডুবে মরত। তাই তার কথা অমান্য করা যাবে না। কিন্তু এসবের মধ্যে সত্যতা কতটুকু তা আমাদেও ভাবতে হবে। বুঝতে হবে, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অপার সম্ভাবনার এ দেশে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটেন প্রায় দু’শ বছর লুটপাট করেছে আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি আমেরিকা তাদের স্বার্থে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বন্ধু নেই, আছে শুধু ‘স্বার্থ’ (প্রথম আলো, ৩০/০১/২০১১)। ”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তি কী ফল বয়ে আনবে
টিকফা কী, এটা আসলেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত কোনো চুক্তি কি না তা তলিয়ে দেখতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো হয়, সেগুলো মূলত তিন ধরনের তাড়না থেকে হয়। সেগুলো হলো- অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাড়না, কৌশলগত তাড়না আর সুনির্দিষ্ট বাণিজ্য বিষয়ক ও ঘটনাকেন্দ্রিক তাড়না।
সরকার যে চুক্তিটা করতে যাচ্ছে, সেটার কোনো খসড়া প্রকাশ করেনি। তাই নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা যাচ্ছে না। তবে পৃথিবীর অন্য যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের যে চুক্তিগুলো ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে টিকফা কিংবা টিফা একটা কৌশলগত একটি চুক্তি। কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাড়না থেকে এ চুক্তি উৎসারিত নয়।
এটাকে বলা যেতে পারে একটা পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত চুক্তি সম্পাদনের প্রাক-দলিল অথবা প্রাক-সমঝোতা। এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ স্বার্থ এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্পাদিত হয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের যে নিজস্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত আইনি এবং মানগত কাঠামো রয়েছে, সেগুলোকে তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়। অথচ এ ধরনের সমঝোতা কাঠামোতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট অঙ্গীকার থাকে না। যেসব বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত, সেসব বিষয়ে বাংলাদেশের কর্মপন্থা ও অবস্থান কী হবে তারই একটি প্রাক-নির্ধারণ হচ্ছে এই টিকফা।
বাংলাদেশে টিকফার ইতিহাস
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে মার্কিনরা সরকারের ওপর টিকফা চুক্তি সই করার জন্য চাপ প্রয়োগ শুরু করে। এ জন্য তৎকালীন সরকারের সঙ্গে মার্কিনদের দেনদরবারও হয়। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া আলাপ চলতে থাকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। তবে সেবার বিএনপি সরকার টিকফা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় বাম ও কিছু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ব্যাপক বিরোধিতার কারণে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও টিকফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করা থেকে পিছিয়ে আসে জনমত টিকফার বিপক্ষে থাকার কারণে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বন্ধ থাকা টিফা চুক্তির ব্যাপারে আলাপ শুরু হয়। এ আলাপে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি নাম পরিবর্তন করে টিকফা চুক্তি করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
টিফা বা টিকফা যে নামেই হোক, এ চুক্তির মধ্যে কী ধরনের শর্ত রয়েছে, সে সম্পর্কে দেশের মানুষের কোনো ধারণা নেই। কারণ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সমান গুরুত্ব দিয়ে গোপন রেখেছে। টিফা নিয়ে বাংলাদেশের সরকারগুলোর এ রকম গোপনীয়তার কারণে জনগণের মধ্যে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের হাতে আছে ২০০৫ সালে প্রস্তাবিত TIFA-এর খসড়া। এই খসড়া টিফার সঙ্গে কী সংযোজন হবে আর কী বিয়োজন হবে, তাও নির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছে না সরকারের পক্ষ থেকে।
সামরিক কৌশল
বাণিজ্য চুক্তির আড়ালে টিকফা বা টিফার সামরিক গুরুত্বও রয়েছে। ভূ-কৌশলগত দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগর মার্কিন প্রভাবে রাখার জন্য টিফার সামরিক গুরুত্ব রয়েছে। চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের পরই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। মার্কিনদের চীন ঘেরাও নীতির ফলে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে পশ্চিমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্থান।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলে যুক্তরাষ্ট্র সিয়াটো-সেন্টো চুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রাচ্যমুখি নীতি অব্যাহত রেখেছিল। তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সম্পূর্ণ মার্কিনবিরোধী শক্তি কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের চীন ঘেরাও নীতি বাস্তবায়নে সফল হয়নি।
১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। পৃথিবী চলে যায় মার্কিনদের একমেরুকেন্দ্রিক বা ইউনিপোলার নেতৃত্বের হাতে। ভেঙে পড়ে পৃথিবীর রাজনীতি ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও শুধু বাণিজ্যই এসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তির একমাত্র লক্ষ্য নয়, ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে মার্কিনদের প্রভাব বিস্তার করাও এসব চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তি এবং জিএমও প্রবর্তনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল চেষ্টা রয়েছে। জিএমও বায়োলজিক্যাল উইপন সিস্টেম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নতুন ক্ষেত্র। আবার অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক পরীক্ষাগার বানাতে চায়। আর এ ধরনের কৌশলগত তাড়না থেকে উৎসারিত চুক্তি কেবল বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়ে জড়িত নয়, এতে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট স্বার্থও জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে যুক্তরাষ্ট্র যেসব রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে এই যুদ্ধ চালাচ্ছে, তাদের বেশির ভাগের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যস্বার্থের সঙ্গে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট স্বার্থও যুক্ত হয়ে পড়েছে।
সরকার কেন চুক্তির খসড়া প্রকাশ করছে না
যখন এ ধরনের চুক্তিতে জনমানুষের স্বার্থ রক্ষা করা হয় না, তখনই অস্বচ্ছতা তৈরি হয়। সামনে নির্বাচন। তাই এ ধরনের চুক্তি প্রকাশ হয়ে পড়লে সরকার সমালোচনার সম্মুখীন হতে পারে। এই অস্বচ্ছতা দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় খুব ভাল ফল বয়ে আনবে না।
এই চুক্তি হলে আমরা কী ধরনের অসুবিধার মধ্যে পড়ব
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাজার উন্মুক্ত করার ব্যাপারে আমাদের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটাই এই বহুপক্ষীয় দরকষাকষি ফোরামের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উন্নয়নশীল সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা যে ছাড়গুলো স্বাভাবিকভাবে পেয়ে থাকি, সেগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত হব। সেসঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আলোচনায় আমাদের এক প্রাকার দ্বৈত অবস্থান তৈরি হবে।
এ সংস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে অবস্থান নিয়ে আমরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করি। এছাড়া অথবা মেধাস্বত্ত্ব অধিকার, লেবার স্ট্যান্ডার্ড বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের যে ঐতিহ্যগত অবস্থান, তা এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কারণে অনেক নড়বড়ে হয়ে পড়বে।
দ্বিপক্ষীয় না বহুপক্ষীয়- দীর্ঘমেয়াদি কোন অবস্থানকে আমরা গুরুত্ব দেব, সেটা আমাদের বিবেচনা করা খুব জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র যখন এ জাতীয় চুক্তিগুলো করে, তখন সেটা পুরো মাত্রায় তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্যই করে।
বাণিজ্যিক সুবিধার মিথ্যা তথ্য
বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য আসলে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধার তেমন কোনো ফল পাচ্ছে না। বরং সে দেশে গড় আমদানি শুল্ক হার যেখানে শতকরা ১ ভাগের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ, কোনো কোনো পণ্যে আরও বেশি। গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির প্রায় শতকরা ২৩ ভাগ গেছে, সেই হিসাবে এ বছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক বাবদ প্রদান করেছে কমপক্ষে প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে, তার ছয় গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের জোগান দিচ্ছে প্রতিবছর! এবং যুক্তরাষ্ট্রই মুক্তবাজার নীতিমালা ভঙ্গ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ করে রেখেছে! (আনু মুহম্মদ, দৈনিক প্রথম আলো, ২৩/০৫/২০১৩)
অর্থাৎ প্রচারণা বা বিশ্বাস যা-ই থাকুক, তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে কোনো বিশেষ সুবিধা পায় না, বরং অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে সেখানকার বাজারে প্রবেশ করতে হয়। এবিষয়ে নেপালের অভিজ্ঞতাও অভিন্ন। কেননা, নেপালও জিএসপি-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বলছে, শিল্পায়িত দেশগুলোর বেশিরভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক কম থাকলেও কৃষি, যে পণ্যগুলো গরিব দেশ থেকে আসে তার অনেকগুলোর ওপরই মার্কিন শুল্কহার অস্বাভাবিক রকম বেশি। গড় শুল্কহারের চেয়ে কখনো কখনো ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। কাপড় ও জুতার ওপর আমদানি শুল্ক শতকরা ১১ থেকে ৪৮ ভাগ।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের তুলনা করে আইএমএফই স্বীকার করছে যে, যে বছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার পণ্য আমদানি বাবদ ৩৩ কোটি ডলার আমদানি শুল্ক আয় করল, সে বছরেই সমপরিমাণ শুল্ক তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে আয় করল। অর্থাৎ ধনী দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। এটাই বিশেষ সুবিধা! (আনু মুহম্মদ, দৈনিক প্রথম আলো, ২৩/০৫/২০১৩)
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছে, টিকফা চুক্তির মধ্যেও এই বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর আরোপিত উচ্চহারে শুল্ক কমিয়ে তাদের গড় শুল্কহারেরও সমান করে, তাতে যে পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে, তাতে ৪০ লাখ শ্রমিকের মজুরি তিন মাস অতিরিক্ত শোধ করেও নিরাপত্তাজনিত সব ব্যয় বহন সম্ভব হবে।
বলা হচ্ছে, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর হলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের উন্নতি হবে। বাংলাদেশের দিক থেকে এই উন্নতির অর্থ কী এই যে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চরম বৈষম্যমূলক ও সংরক্ষণবাদী শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্র পরিবর্তন করবে? মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কাছে মাগুরছড়ার গ্যাসসম্পদের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকা কি শোধ করার ব্যবস্থা করবে? সব সামরিক-বেসামরিক চুক্তি কি জনগণের কাছে প্রকাশ করবে? এগুলোর বিষয়ে কোনো কথা নেই চুক্তিতে। কোনো সরকারের মুখে এই কথাটা কেন আসে না যে আমাদের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে না। আন্তর্জাতিক রীতি-নীতিবিরোধী বৈষম্যমূলক সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য ব্যবস্থা তোমরা বাতিল করো।
মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএন ‘ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’-এর গবেষণা থেকে হিসাব করে দেখিয়েছে, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পোশাক যে দামে বিক্রি হয়, তার শতকরা ৬০ ভাগই পায় সে দেশের বায়ার ও বিখ্যাত ব্র্যান্ড বিক্রেতারা, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বাকি ৪০ ভাগের মধ্যে উৎপাদন প্যাকেজ ও পরিবহন খরচ এবং মালিকের মুনাফা অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকের মজুরি একেবারে তলায়, শতকরা ১ ভাগেরও কম।
অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র টিফা করতে পারেনি। অথচ ওই সব দেশের সঙ্গে মার্কিনদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্যসম্পর্ক। এসব দেশের তালিকায় রয়েছে কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারতের মতো দেশগুলো। টিফা আসলে সেই সব দেশের সঙ্গে করা হয়, যেসব দেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল।
এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যতগুলো দেশের সঙ্গে টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তার কোনোটির সঙ্গেই কিন্তু সম্পর্ক শুধু বাণিজ্যকেন্দ্রিক নয়। এর বাইরে সামরিক ও ভূ-কৌশলগত বিষয়টি রয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের গায়ে আওয়ামী লীগ খুব গন্ধ পায়। তাদের মুখদেখা, আলাপ-আলোচনায়ও ঘৃণা বোধ করে। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাকে রুখে দিতে ১৯৭১-এর পরও যে আমেরিকা বিরোধিতা করেছে, তার সঙ্গে কেন ‘সুসম্পর্ক’ রাখে আওয়ামী লীগ, তা জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন।
বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও আমেরিকান এসব আগ্রাসনের বিপক্ষে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। এ দেশের মালিক দেশের জনগণ। এ চুক্তির ফলাফল ভোগ করতে হবে জনগণকে। সরকারের উচিত এ চুক্তিতে কী আছে তা জনগণের সামনে প্রকাশ করা।
এদেশের সিংহভাগ মানুষই বিশ্বমানবতার শত্রু আমেরিকার সঙ্গে সুদূর প্রসারী কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায় না। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে এবং চুক্তি সই করার সকল অপতৎপরতা বন্ধ করা সরকারের দায়িত্ব।
খান শরীফুজ্জামান: লেখক ও গবেষক- [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৩