ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ডিসিসি নিয়ে আইনি কুটিলতা ও সুলতানগঞ্জ সমাচার

এরশাদুল আলম প্রিন্স, আইন ও মানবাধিকার সম্পাদক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৮ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১৩
ডিসিসি নিয়ে আইনি কুটিলতা ও সুলতানগঞ্জ সমাচার

ঢাকা: জনপ্রতিনিধিত্বহীন জনপদের নাম ঢাকা। সর্বশেষ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হয়েছিল ২০০২ সালের মে মাসে।



সেই হিসেবে সর্বশেষ মেয়রের মেয়াদ শেষ হয় ২০০৭ সালের মে মাসে। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও তিনি স্বপদে বহাল ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। আইনানুযায়ীই তার এ স্বপদে বহাল থাকা।

আইন সংশোধন হয় ২০০৯ সালে। ২০০৮ সালের প্রজ্ঞাপনটিকেই ২০০৯ সালে কিছু সংশোধন সাপেক্ষে আইনে পরিণত করা হয়।

২০০৯ সালের আইনের মাধ্যমে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এ দুইভাগে ভাগ করা হয়। সেটি বাস্তবায়িত হলো আরো পরে।

এরপরে আরো বড় পরিবর্তন আনা হলো কর্পোরেশন দুটিতে। মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একক ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের গদিতে বসলেন দুই প্রশাসক। অর্থাৎ  আগে অন্তত মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও একজন নির্বাচিত মেয়রের হাতে ক্ষমতাটি ছিল। বর্তমানে ঢাকার স্থানীয় শাসন ভার দুই প্রশাসকের হাতে।

আমরা কেন্দ্রীয় শাসনের ক্ষেত্রে একদিকে বলছি,  অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। অন্যদিকে, স্থানীয় শাসনে তারই বিপরীত ভূমিকা পালন করছি।

২০০৭-এ খোকার মেয়াদ শেষ হলেও পরবর্তী দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো নির্বাচন দেয়নি। ২০০৯ সালের পরে বর্তমান সরকারও নির্বাচন করার কোনো রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখায় নি। তারা হয়ত খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কা করছিল!
 
ডিসিসিতে নির্বাচন না দেওয়ার জন্য সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরকে দুষছে। পারস্পরিক এ দোষারোপের মধ্যে মেয়র বা কমিশনার ছাড়াই চলছে ঢাকার স্থানীয় প্রশাসন। অর্থাৎ ঢাকায় চলছে কেবল কেন্দ্রীয় শাসন।

স্থানীয় শাসন এখানে বহাল নেই। কেন্দ্রীয় শাসনের কুফলের প্রভাবে ঢাকার জনগণ স্থানীয় শাসনের সুফল ভোগ করতে পারছে না।     

আমাদের সংবিধানে যে প্রস্তাবনা বা স্বপ্নের কথা বলা আছে, সেখানে স্পষ্টভাবে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এ গণতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিটিও হবে গণতান্ত্রিক। কোনো গণতান্ত্রিক শাসনই প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় জনগণের মতামত বা প্রতিনিধিত্বকে উপেক্ষা করে। অথচ ডিসিসিতে সেটাই করা হচ্ছে।  

ডিসিসিতে নির্বাচন না করার মানে একথা বলছি না যে সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না ইত্যাদি। নির্বাচন না করাটা সরকারের হয়ত একটি কৌশল বা নীতিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু, এ সিদ্ধান্তটি নগরবাসীর কথা বাদই দিলাম, সরকারের জন্যই কতটুকু ইতিবাচক সেটিও একটি প্রশ্ন।

সংবিধানে জাতীয় নির্বাচনকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, স্থানীয় নির্বাচনকে তার চেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কারণ, সংবিধান প্রণেতারা যথার্থই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন হবে না। তাই, কেবল তারা সংবিধানে স্থানীয় শাসনকে rhetoric হিসেবে না রেখে বিধানটিকে আরো স্পষ্ট করে বলেছেন।

সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমুহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক এককাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে। ’ অর্থাৎ স্থানীয় শাসনের ভার জনপ্রতিনিধিদের ওপরই দিতে হবে, কোনো প্রশাসকের ওপর নয়। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রশাসনিক কেন্দ্রে এই স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটিই সংবিধানের আদর্শিক অবস্থান। একই বিধানে স্থানীয় শাসনের রূপরেখা ও দায়িত্বের অধিক্ষেত্রও বর্ণনা করা হয়েছে।

সংবিধানের এই বিধানটিকে আরো কার্যকর করতে ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকারকে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ও এর কার্যক্ষেত্রকে আরো বিস্তৃত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটি বিধির নয়-বাস্তবতার। আমাদের দেশে বিধি ও বাস্তবতার অবস্থান পরস্পর বিরোধী।

সংবিধানের ১১ অনুচেছদটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। এ বিধান মতে আমাদের রাষ্ট্র হবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ বিধানের সবশেষ কথাটি হচ্ছে- প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। সংবিধানের এ বিধান দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সমসাময়িক। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে স্থানীয় শাসনের এ বিধানটি পুনরায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে। একই সালে আমরা সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাও প্রবর্তন করেছি। কিন্তু বাস্তবে আসলে দুটোর অবস্থাই একই রকম।  

স্বাধীন দেশে সংবিধান প্রণয়নের চার দশক পরেও আমরা স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠা ও শক্তিশালী করতে পারিনি। অন্যান্য প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলোতে নির্বাচন হলেও আদতে সেখানে স্থানীয় শাসন এখনো শক্তিশালী হতে পারেনি। এ দায় সরকারের একার নয়। সামগ্রিকভাবে এ দায় দেশের প্রচলিত রাজনীতির।

ডিসিসি নির্বাচন করায় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা ছিল। গত ১৩ মে সে নিষেধাজ্ঞার অবসান হয়। আইনি জটিলতার কথা বলে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। যদিও তারও আগে একটি আইন বা প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়। গদিতে বসানো হয় প্রশাসককে। বিভক্ত করা হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে।
 
বর্তমানে ঢাকার বাইরে অন্য পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে একযোগে নির্বাচন চলছে। কিন্তু ঢাকার নির্বাচন আদৌ হবে কিনা নগরবাসী এ বিষয়ে এখনো সন্দিহান। যদিও এ লেখাটি লেখার সময় দেখলাম সুলতানগঞ্জ নিয়ে যে জটিলতা তার অবসান হয়েছে। এখন কেবল নির্বাচন কমিশনের তফশিল ঘোষণার অপেক্ষা।

এর আগেও একবার ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে তোড়জোর শুরু হয়েছিল। হঠাৎ করে সীমানা নিয়ে আইনি জটিলতার কথা বলে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। জটিলতার শুরু হয় সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নের কারণে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সীমানা পুন:নির্ধারণ করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গত জানুয়ারী মাসে গেজেটের মাধ্যমে সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নের চরওয়াশাপুর এলাকা ছাড়া বাকি এলাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অর্ন্তভূক্ত করে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয়, সুলতানগঞ্জের ওই এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কোন ওয়ার্ডের অন্তভূক্ত হবে সেটি নিয়ে। গেজেটের এ অস্পষ্টতার কারণে নির্বাচন হতে পারেনি।

সীমানা নির্ধারণের কাজটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। হাইকোর্টের নিদের্শ সত্ত্বেও এ কাজটি এতো দিন করা হয়নি। কিন্তু অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে আদালতের দিকে।

হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নির্বাচন কমিশন সুলতানগঞ্জ ইউনিয়নের বিষয়টি স্পষ্ট করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়।

একথা সত্য যে কোনো এলাকার সীমানা নিয়ে আইনি জটিলতা থাকলে নির্বাচন কমিশন সেক্ষেত্রে উক্ত এলাকার নির্বাচন করতে পারে না। কাজেই নির্বাচন কমিশনের অজুহাতের বাস্তব ভিত্তি থাকলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো অজুহাতের কোনো ভিত্তি ছিল না। তারপরও তারা আইনি জটিলতার কথা বলেছে। কিন্তু এ জটিলতা দূর করার দায়িত্ব তাদেরই।

হাইকোর্টে মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থাতেই মন্ত্রণালয় কেন একটি ইউনিয়নকে সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভূক্ত করলো সেটি নিয়ে জনগণের প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। এ থেকে মনে হতে পারে, সরকার বিলম্বিত একটি নির্বাচনকে আরো বিলম্বিত করতে চেয়েছিল।

উল্লেখ্য, সুলতানগঞ্জের ওই এলাকা যে ওয়ার্ডের অন্তর্ভূক্ত হলো সেই ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডটিও নতুন করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের করা হলো। কেন হলো? এটি কি আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের এলাকা বলে? আর যদি তা হয়েও থাকে তাহলে পুরো একটি ইউনিয়নের একটি এলাকাকে নিয়ে জটিলতা ঝুলিয়ে রাখা হলো কেন? এটি কি নির্বাচন ঝুলিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে?

আইনানুযায়ী কোনো সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার কথা থাকলেও সে নির্বাচন হয়নি। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, ২০০৮ সালের স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) অধ্যাদেশে সিটি কর্পোরেশন বিভক্ত করার কোনো কথা ছিল না। অর্থাৎ ডিসিসি বিভক্ত করার কোনো পরিকল্পনা ২০০৮ সালে ছিল না। বলে রাখা প্রয়োজন অধ্যাদেশটি জারি করেছিল তৎকালীল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

বিস্ময়কর বিষয় হলো, ২০০৮ সালের অধ্যাদেশটিকে পরবর্তী সরকার যখন আইনে পরিণত করলো তখন ৩৪/১ এর (ঘ) ধারাটি সংযোজন করে এটি পাস করলো। এ ধারায় বলা হলো, ‘কর্পোরেশন বিভক্ত করিয়া একাধিক সিটি কর্পোরেশন গঠন করা হইলে সেক্ষেত্রে একশত আশি দিনের মধ্যে নির্বাচন করিতে হইবে। ‘ অর্থাৎ ডিসিসি বিভক্ত করার ইঙ্গিত এখানে স্পষ্ট।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে বিভক্ত করা হলো। সেখানে কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কার্যভার দেওয়া হলো দুইজন প্রশাসকের হাতে। বিষয়টি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। রাষ্ট্র বা সরকার বা অন্যকোনো স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রে এ বিধান নেই। সেসব ক্ষেত্রে নতুন নির্বাচিত  জনপ্রতিনিধি না আসা পর্যন্ত পূর্ববর্তী পদাধিকারী তার পদে বহাল থাকেন। কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে মেয়র তার ক্ষমতা প্রশাসনের হাতে ছেড়ে দিয়ে বিদায় হন। জনগণের ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় প্রশাসকের হাতে।

ডিসিসি নির্বাচনের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা হলো সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। তাঁর মতে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে এখন আর কোনো বাধা নেই। বাধা আগেও ছিল না। বিষয়টি নির্বাচন করা বা না করার। নির্বাচন করতে চাইলে আগের তফশিলটি কার্যকর করলেই হবে। শুধু কিছু সংশোধন লাগবে। নতুন করে আর তফশিল ঘোষণা করতে হবে না। ড. তুহিন মালিক ও মাহমুদুর রহমান মান্নাও একই অভিমত পোষণ করেন।

পরের দুজন ডিসিসি নির্বাচনের প্রার্থী আর প্রথম জন সাবেক কমিশনার। তারা সবাই বিষয়টিকে আইনি জটিলতার বাইরে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচনা করেন। আর আইনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নির্বাচন না করা হলে তাকে ‘আইনি জটিলতা’ না বলে ‘আইনি কুটিলতা’ বলাই ভালো।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৯ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।