ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জলবায়ু তহবিল ও কার্যকর কূটনীতি

ড. মো. নজরুল ইসলাম প্রান্তিক ও মেজবাহ-উল-আজম সওদাগর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪১১ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০১৩
জলবায়ু তহবিল ও কার্যকর কূটনীতি

ঢাকা: পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জলাভূমি, বনভূমি, উপকূলীয় অঞ্চল ও সমুদ্রের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে আজ।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সমস্যাকে মোকাবেলার জন্য ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় একটি কনভেনশন স্বাক্ষর করে।

পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই এ কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। এই কনভেনশনে স্বীকার করে নেওয়া হয়, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোই দায়ী। তাই, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় তাদের দায়িত্বটাই বেশি। কিন্তু পরে লন্ডন, মেক্সিকো সিটি, কানকুন, ডারবান ও দোহার সম্মেলনেও উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নে ঐকমত্যে পৌঁছতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। নানা গবেষণায় উঠে এসেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিধস, নদীভাঙন, উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত, ভূগর্ভস্হ পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় আর্সেনিকের প্রভাব, ভূগর্ভস্হ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও সর্বোপরি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ক্ষতিকর প্রভাব।

আইপিসিসি’র (ইন্টারগর্ভমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চল থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে যেতে পারেন।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর এক থেকে দেড় কোটি মানুষ বড় বড় শহরের দিকে জলবায়ু অভিবাসী হচ্ছেন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘জার্মান ওয়াচ’-এর গবেষণা প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে গড়ে বছরে ৮,২৪১ জন মানুষ মারা যাচ্ছেন এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ২,১৮৯ মিলিয়ন ডলার, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে যা শতকরা ১.৮১ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিন্তু, বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশের পক্ষে সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ সমস্যা মোকাবেলা করা সহজ নয়। কারণ, সমস্যাটি বহুজাতিক (ট্রান্স ন্যাশনাল)। আর তাই প্রয়োজন আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা।

সত্যি কথা বলতে কী, জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রকৃতি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের গতানুগতিক তত্ত্বে বড় আঘাত হেনেছে। জাতীয়ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কমবেশি প্রতিটি রাষ্ট্রই এককভাবে ব্যর্থ।

অন্যদিকে ‘Silent Spring’, ‘The Limits to Grwoth’, ‘Polluters Pay’ এবং ‘Our Common Future’ ইত্যাদি বহুতাত্ত্বিক ও মৌলিক বিষয়ের বিতর্ক ও ভাবনা আন্তর্জাতিকভাবে সমন্নিত প্রচেষ্টার উদ্যোগকে আরো জটিল করে তুলছে।
 
জলবায়ু পরিবর্তনকে কার্যকরভাবে রোধ করা একমাত্র আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমেই সম্ভব। আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটচালে এ ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন, নিরাপত্তা, জনমত ইত্যাদির বেড়াজাল ডিঙিয়ে কীভাবে একটি কার্যকর আর্ন্তজাতিক উদ্যোগ ও মেকানিজম তৈরি করা যায়, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির তাত্ত্বিকরা নানা মতের অবতারণা করেছেন। রিয়েলিজম ও লিবারেলিজম উভয় তত্ত্বের ঘোর সমালোচক প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ই এইচ কার ১৯৩৯ সালে তার The Twenty Years Crisis বইতে গ্লোবাল কমন চিন্তার ভিত্তিতে কমন গুড (সাধারণ কল্যাণ) খুঁজে বের করার ওপর জোর দিয়েছেন; যেখানে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র এই কমন ‘গুডগুলোর’ সাধনের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসতে পারে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে অভিভাবকহীন বিশ্বে প্রত্যেক রাষ্ট্রই তার নিজের স্বার্থকে যে কোনো কিছুর ওপর প্রাধান্য দেবে এবং অন্যের ক্ষতি তার দেখার বিষয় নয়, এটাই বাস্তবতা। ফলে, কমন গুডের অনুসন্ধানই হচ্ছে একমাত্র উপায়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ঝুঁকি মোকাবেলা হচ্ছে, এ রকম একটি কমন গুড বা গ্লোবাল কমন। বিশ্ব সম্প্রদায় কমন গুড কনসেপ্ট-এর ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ঐক্য গঠনে সফল হয়েছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে Inter governmental Panel on Climate Change (IPCC), United Nations Environment Program (ENEP) এবং United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCC) এর মত আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠিত হয়েছে। IPCC’র অধীনে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং UNFCC’র অধীনে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ক্লাইমেট নেগোশিয়েশনে অনেক অগ্রগতি হয়েছে।

কিয়োটো প্রটোকল ও Bali Action Plan ক্লাইমেট নেগোশিয়েশনের ইতিহাসে দুটি বড় অর্জন। কিয়োটো প্রটোকলে ধনী রাষ্ট্রগুলো গ্রিন হাউস গাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে কাজ করছে।

Bali Action Plan ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণের জন্য অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা দানের কাজও এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার জন্য ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট-২০১০’ নামে একটি ট্রাস্ট স্থাপন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক রাজনীতিতে সবার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে।

সবচাইতে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। অন্যদিকে, দরিদ্র, অনুন্নত ও ঝুঁকির ভেতর থাকা দেশগুলি উন্নত দেশগুলির কার্বন নিঃসরণ কমাতে চাপ প্রয়োগে যতটা না আগ্রহী, তার চেয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থ আদায়ে অনেক বেশি আগ্রহী।

জলবায়ু তহবিল সংগ্রহের পর তা ব্যবহারে যদি স্বচ্ছতা না থাকে, তবে আন্তর্জাতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং আমাদের ন্যায্য দাবিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ক্ষতিকর প্রভাব রোধকল্পে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ‘জলবায়ু কূটনীতি’ নামে নতুন এক প্রপঞ্চের (phenomenon) আগমন ঘটেছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তত্ত্বে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল প্রক্রিয়ায় যেখানে প্রত্যেক রাষ্ট্রই স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো কীভাবে তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে, ধনী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনার কৌশল কী হবে, ক্লাইমেট ফাইন্যান্সের ধরন, ব্যয়ের খাত কীভাবে নির্ধারিত হবে, সুশাসন, জবাবদিহিতা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে কী কৌশল নেওয়া হবে, সে বিষয়ে কার্যকর অবস্থান  এবং প্রতিনিধিত্বই হচ্ছে জলবায়ু কূটনীতি।

জলবায়ু কূটনীতির প্রকৃতি, কৌশল, উপাদানগুলো গতানুগতিক কূটনীতি থেকে ভিন্ন। রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সসিবিলিটি ক্লাইমেট নেগোশিয়েশনে একটি স্বীকৃত বিষয়। কোনো দয়া বা অনুগ্রহ নয় অত্যধিক পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা- এ দুটি বিষয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোর সরল স্বীকারোক্তি ক্লাইমেট নেগোশিয়েশনের বড় অর্জন।

কিন্তু এ সরল স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্লাইমেট নেগোশিয়েশনে নিজেদের জলবায়ু পরিবর্তনগত ঝুঁকিগুলো কার্যকরভাবে উত্থাপন করে যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগে এখন পর্যন্ত দৃঢ়তার প্রমাণ দিতে পারেনি।

এমন কি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ক্লাইমেট নেগোশিয়েশনের ক্ষতিপূরণের কৌশলগত এবং বাংলাদেশের ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’-এর মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ ও Cost-Benefit বিশ্লেষণ করে লাভবান হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে কূটনৈতিক কৌশল ও দক্ষতার  ওপর নির্ভরশীল।

এ মূহূর্তে বাংলাদেশের জলবায়ু কূটনীতি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। কৌশল, দক্ষতা, যোগাযোগের দক্ষতার অভাব সবদিক থেকেই রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের লস ও ড্যামেজ এবং জলবায়ু অভিবাসনের মতো বিষয়গুলোকে ক্লাইমেট নেগোশিয়েশনে নিয়ে এসে কীভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়, তার কৌশল নির্ধারণ এখনই জরুরি।

ড. মো. নজরুল ইসলাম প্রান্তিক: সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে তিনি জাপান সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব সায়েন্স (জেএসপিএস) পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে ইউনিভার্সিটি অব টোকিওতে সমুদ্রের পরিবেশ ও বাস্তব্যবিদ্যার ওপর উচ্চতর গবেষণারত।  




মেজবাহ-উল-আজম সওদাগর: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের স্কলার হিসেবে গ্রাজুয়েট স্কুল অব এশিয়া প্যাসিফিক স্টাডিজ, ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটি, জাপান-এ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণারত।    

বাংলাদেশ সময়: ০৩৫২ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৩
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর, জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।