জিএসপি অর্থাৎ জেনারেল সিস্টেম অফ প্রেফারেন্সেস বা বাজারে অগ্রাধিকার বাণিজ্য সুবিধার কারণে সাড়া পৃথিবীর প্রায় ১২৫টি দেশের ৫০০০ পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক মুক্ত প্রবেশের সুযোগ পায়। বাংলাদেশও এই সুবিধার অন্তর্ভূক্ত ছিলো।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখার ক্ষেত্রে রপ্তানিক্ষেত্রে পোশাকশিল্প একটি ইঞ্জিন হিসাবে কাজ করে আসছে। আর এই ইঞ্জিনের চালকের ভুমিকায় রয়েছেন সল্প বেতনের অবহেলিত শ্রমিক যারা সংখ্যায় ৩২ লাখের বেশি এবং যাদের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ নারী- যারা ন্যুনতমমুল্যে তাদের শ্রম বিক্রি করে আমেরিকা ও ইউরোপে রপ্তানিযোগ্য উন্নতমানের গার্মেন্টস তৈরি করছে। তাদের শ্রমের বিনিময়েই দেশ বৈদেশিক মুদ্রায় সম্মৃদ্ধ হচ্ছে।
এই শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ না থাকায় দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রচুর সমালোচনার ঝড় উঠে বিশেষ করে গত কয়েক বছরে পোশাকশিল্পে উপর্যুপরি কয়েকটি জীবনঘাতী দুর্ঘটনার পর। অনেক শ্রমিক সে দুর্ঘটনাগুলোতে প্রাণ হারায়। ২০০৫ সালে সাভারে স্পেকট্রামে ৬৪ জন, ২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ার তাজরিন ফ্যাক্টরিতে আগুনে দগ্ধ হয়ে শতাধিক, তারপর গত এপ্রিলে সাভারে নয়তলা রানাপ্লাজা ধ্বসে পড়ে এগারো শ’র বেশি নিরীহ শ্রমিক প্রাণ হারায়, আহত ও নিখোঁজও হয় অনেক। এই দুর্ঘটনাগুলোর সচিত্র প্রতিবেদন সাড়া দুনিয়ার মিডিয়াগুলোতে বড় আকারে লিড নিউজ পায়। এর ফলে যা হয় তা হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কর্মরত সাধারণ শ্রমিকদের দৈন্যদশার এক করুণ চিত্রই মুলতঃ বিশ্বব্যাপী মানুষের সামনে আসে। আর এসবের যে একটা প্রভাব আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের কিছু পণ্যের উপর ডিউটি-ফ্রি প্রবেশে বাধা হয়ে আসতে পারে বলে আশংকা অমুলক ছিল না। বিশেষ করে যখন আমেরিকার লেবার ইউনিয়ন ও ক্যাপিটল হিলের ডেমোক্রাটরা বাংলাদেশের ফ্যাক্টরিগুলোতে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার যে প্রচ- অভাব রয়েছে, সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে ওবামা প্রশাসনের টেবিলে নিয়ে আসেন। ফ্যাক্টরিগুলোতে শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বা ঝুকিমুক্ত কাজের পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং সেগুলোতে কাঠামোগত আরো উন্নয়ন সাধনের ফলে কীভাবে শ্রমিকদের অধিকার আরো বাড়ানো যায়, সেই লক্ষে বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তারা ওবামা প্রশাসনের উপরে তীব্র চাপ সৃষ্টি করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত মাসে অর্থাৎ জুনের শেষ সপ্তাহে কংগ্রেসে ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য এই জিএসপি সুবিধাটি সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়। মার্কিন প্রশাসন আসলে অগ্রসর দেখতে চায় যে, বাংলাদেশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, কাজের উপযুক্ত পরিবেশ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের হয়রানি বন্ধ সহ আরো অনেক উন্নয়ন। সেই যথোপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে দ্রুততম পদক্ষেপ ব্যতীত কোনো ঢিলেঢালা, গড়িমসি বা অজুহাত-ই প্রযোজ্য হবে না।
সুতরাং আমেরিকার বাজারে কিছু পণ্যের উপরে জিএসপি সুবিধাটি কেন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হল- তা নিয়ে অনেক হৈ চৈ হলেও এর মূলে রয়েছে উপরক্ত দুর্ঘটনাগুলো এবং কারখানাগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশ।
পাশাপাশি এই বাস্তবতাও আমাদের স্বীকার ও মেনে নেওয়া উচিত যে, আমরা দরিদ্র দেশের নাগরিক। পেটের চাহিদায় তাই অনেক সময় অনেক বড় ঝুঁকিই আমরা নিয়ে থাকি। গার্মেন্টস শ্রমিকরাও তাই করছেন। তারা নিরপরাধ। ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে অনন্যোপায় হয়ে তারা ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলোতে কাজ করেন। অন্যদিকে আমাদের দেশের গার্মেন্টস মালিকরা ও সরকার তাদের জন্য নিরাপদ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেননি বিধায় উপরের এই দুর্ঘটনাগুলোকেও এড়ানো যায়নি, পরিণতিতে অনেক প্রাণই কেবল অকালে ঝরে পড়েছে। আবার বিদেশি ক্রেতারাও এতদিন বাংলাদেশে গার্মেন্টসে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশের কথা যে জানতেন না তা বিবেচনা করাটাও সমীচীন নয়। তারা সবকিছু জেনে শুনেই আমাদের দেশ থেকে গার্মেন্টস আমদানি করে থাকেন মূলত কম মুল্যে পোশাক পাওয়া যায় সে কারণেই- এতে করে তারা তাদের মুনাফার হার বেশি বাড়াতে পারেন সে জন্য। আর তাই উপরোক্ত দুর্ঘটনাগুলোর দায়ভারও কম বেশী কেউ (সরকার, মালিকপক্ষ ও রিটেইলার) এড়াতে পারে না।
সুতরাং ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশকে নিরাপদ কর্মস্থলে পরিণত করার জন্য সবারই ঐকান্তিক আন্তরিকতার বড়ই প্রয়োজন। সেজন্য সরকার, মালিকপক্ষ ও রিটেইলার সবাইকেই এগিয়ে আসা উচিৎ। পোশাক শিল্পে একমাত্র ঝুঁকিমুক্ত বা নিরাপদ কাজের পরিবেশই আবার এর সতেজ ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে পারে বিশ্বব্যাপী। তাই সবার আগে শ্রমিকদের জন্য কিভাবে নিরাপদ কর্মস্থল বাস্তবায়ন করা যায়, একটি শ্রমিকের জীবনও যাতে আর অবহেলায় অকালে ঝড়ে না যায়, কাউকে যাতে আর পঙ্গু হতে না হয়, আর যাতে কেউ মা, বাবা, স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বোন-হারা না হয়, আর যাতে কোনো শ্রমিক নেতা অন্যায় হয়রানির শিকার না হয়-সেই নিশ্চয়তাগুলো কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, তার দ্রুত সমাধান করাটাই হচ্ছে এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। আমেরিকার বাজারে জিএসপি সুবিধাটি পুনরায় ফিরে পাবার নিশ্চয়তাও নিহিত রয়েছে নিরাপদ কর্মস্থল বাস্তবায়নের মধ্যেই।
পোশাকশিল্প বাঁচলে বা জেগে থাকলে দেশের অর্থনীতিও জেগে থাকবে। আর তার সুফল থেকে শ্রমিক, মালিক, সরকার তদুপরি দেশের আপামর জনগণ কেউই বঞ্চিত হবে না।
লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেটে একটি ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত। [email protected]
বাংলাদেশ সময় ০২০৫ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৩
এমএমকে