ভুল হচ্ছে। আমরা ভুল করছি।
আত্মসমালোচনা-পারস্পরিক মতবিনিময় চলবেই। তার মধ্য দিয়েই শুদ্ধতার পথে এগুবে বার্তাকক্ষ। তবে এত্তো ভুল-ভ্রান্তির মাঝেও গণমাধ্যম পাঠক-দর্শকের কাছ থেকে আস্থার স্বীকৃতিটি অর্জন করতে পেরেছে। সেই আস্থাটি হলো- যেখানে যা ঘটছে গণমাধ্যমে সেই ঘটনাটি চলে আসছে চটজলদি।
কোন কোন গণমাধ্যম সেলফ সেন্সরশীপের দেয়াল তুললেও, সেই দেয়াল চুইঁয়ে আসল ঘটনাটি প্রকাশ পেয়েছে। আর যেখানে ওই দেয়ালটি উঠেনি, সেখান থেকে তো পাঠক-দর্শকরা টাটকা খবরই পেয়েছেন। আস্থার জায়গাটির দখল নিতে পেরেছে টেলিভিশন এবং মূলধারার অনলাইন পত্রিকা বা নিউজপোর্টাল। তাৎক্ষণিক খবর জানাতে এই দুই মাধ্যমের জুড়ি নেই।
দেশে বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতার তোড়ে কোন ঘটনাই আড়ালে থাকছে না। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কৌশলটা ভেস্তে যাচ্ছে। যে রাজনীতিবিদরা গণমাধ্যমকে যতো দোষ নন্দ ঘোষের চোখে দেখেন, তারাও এখন গণমাধ্যমের স্তুতি জপতে শুরু করেছেন। নিজেদের রাজনৈতিক ও কর্মের ব্যর্থতাকে যারা গণমাধ্যমের তৈরি বলে গাল-মন্দ করেছেন, তারাও এখন প্রকাশ্যেই বলছেন- গণমাধ্যম হচ্ছে গণতন্ত্রের বিশ্বস্ত প্রহরী।
হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের সমাবেশের পর রাজনীতির এক পক্ষ যখন বলেছে-হাজার হাজার মানুষ হত্যা ও গুম করা হয়েছে। তখন অন্য পক্ষটি বলেছে-গণমাধ্যম স্বাক্ষী সেখানে কোন মানুষ হত্যা করা হয়নি। যদি হতো তাহলে টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধরা পড়তো।
১৫ জুনের চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে। এর কৃতিত্বটাও মিডিয়ার থলিতে জমা পড়েছে।
প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল এজন্য সরকারি দল বা নির্বাচন কমিশনকে বাহবা দিচ্ছে না। তাদের মতে, চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উপর দেশের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে চোখ রেখেছিল, তার সামনে সরকার ভোট কারচুপি বা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর দু:সাহস দেখায়নি।
সিলেট এবং বরিশালের রিটার্নিং অফিসাররাও টেলিভিশন ক্যামেরা দেখেই বাধ্য হয়েছিলেন ওই রাতেই বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করতে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে একই কথা বলা হয়েছে।
ফলাফল ঘোষণার ধীর গতিতে মিডিয়া ক্যু’র মৃদু রব উঠেছিল উভয় পক্ষ থেকেই। কিন্তু শেষমেষ কোরাস কণ্ঠে উভয় শিবির থেকে বলা হয়েছে-গণমাধ্যমের নজরদারির জন্যই কোন নির্বাচনী এলাকায় সহিংসতা হয়নি। কেউ কেউ আরো চড়া কণ্ঠে প্রশস্তি করতে যেয়ে বলেছেন-গণমাধ্যম নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের জায়গাটি নিয়ে নিয়েছে।
এখন আর মাঠে নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের প্রয়োজন নেই। কেউ কেউ গণমাধ্যমকে ছায়া তত্ত্বাবধায়ক বলেও স্বীকৃতি দিয়েছেন।
গণমাধ্যম বন্দনা যারা করছেন, তারা আবার একটি প্রশ্নও জুড়ে দিচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনতো হবে ৩শ’ আসনে।
এখন চারটি বা একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গণমাধ্যম যে কড়া নজরদারি করেছিল, তা কি ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে রাখা সম্ভব হবে?একটি সংবাদ ভিত্তিক টেলিভিশনের বার্তাকক্ষের সদস্য হিসেবে বলতে পারি সম্ভব।
একথা সত্য যে, এই পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের সর্বস্ব ওই এলাকাগুলোতে প্রয়োগ করেছিল। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এই নির্বাচনগুলোকে ড্রেস রিহার্সল, টেলিভিশনের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ড্রাইরান, সেরে নিলো সব বার্তাকক্ষ।
টেলিভিশন সংবাদ এখন প্রযুক্তি নির্ভর। কতো দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি খবর দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা যায়, টেলিভিশনগুলো সেদিকে ঝুঁকছে। আগামী নির্বাচনে নিশ্চয়ই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সবাই প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টায় থাকবে।
যাদের মধ্যে সংশয় আছে, তাদের জানিয়ে রাখা দরকার- টেলিভিশনগুলোর মাঠ পর্যায়ে জেলা এমনকি উপজেলা প্রতিনিধিরা এখন ল্যাপটপ, ডিজিটাল ক্যামেরা ও ইন্টারনেট সংযোগে সমৃদ্ধ। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যুরো স্টুডিও। ফলে ৩শ’ আসনকে কড়া নজরদারিতে রাখার ছকটি তৈরি করতে টেলিভিশনগুলোকে বেগ পেতে হবে না।
নজরদারিতে পিছিয়ে থাকবে না মূলধারার অনলাইন পত্রিকাগুলোও। তাদেরও মাঠ পর্যায় থেকে তাৎক্ষণিক খবর জানানোর সক্ষমতা আছে। আমি জেলা পর্যায়ের অনলাইন পত্রিকাগুলোকেও এক্ষেত্রে স্বাগত জানাবো। কারণ তারাও এখন ভূমিকা রাখছে নিজ নিজ জেলার খবরগুলোকে মূহুর্তে অন্তর্জালবাসীদের জানিয়ে দিতে।
সংবাদপত্র তাৎক্ষণিক খবরগুলো তাদের অনলাইন সংস্করণে জানিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। পরদিন তারা জানিয়ে দিচ্ছে ওই খবরগুলোরই বিস্তারিত।
ফলে গণমাধ্যমের যে বিস্ফোরণ বাংলাদেশে ঘটেছে, তাতে নির্বাচনে কোন পক্ষের অপকর্মই নজরের বাইরে থাকছে না, এমন গ্যারাণ্টি দেওয়াই যায়। আর তাই পর্যবেক্ষক বা ছায়া তত্ত্বাবধায়কের স্বীকৃতির প্রতিও গণমাধ্যম শ্রদ্ধা রাখবে, এমন প্রতিশ্রুতি এখন গণমাধ্যম কর্মীরা দিতেই পারেন। আমার সহকর্মীরাও নিশ্চয়ই সহমত পোষণ করবেন।
তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৬০১ ঘণ্টা, জুলাই ১২, ২০১৩
এডিএ/জেডএম