ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আহমদ শফী ও পুরুষতন্ত্রের হেফাজত

সীনা আক্তার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৯ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৩
আহমদ শফী ও পুরুষতন্ত্রের হেফাজত

সম্প্রতি ইউটিউবে প্রচারিত হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর নারীবিরোধী বক্তব্যের  মূল বিষয় হলো নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও জনসমক্ষে বিচরণ বন্ধ করা। এই বক্তব্য হেফাজতের নারী সংশ্লিষ্ট দাবির ব্যাখ্যা বলা যেতে পারে।


 
স্পষ্টতই আহমদ শফীর এই বক্তব্য নারীদের জন্য অবমাননাকর এবং  বৈষম্যমূলক যা সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন ব্যাহত করতে পারে।

সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হলো- তিনি এসব বক্তব্যে ধর্মের নামে পুরুষতান্ত্রিক মতবাদ, রীতি-নীতি প্রচার করছেন- যা রীতিমত অসততা, সহজ সরল মানুষের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা।
 
আহমদ শফী মনে করেন, মেয়েদের চতুর্থ/পঞ্চম শ্রেণির অধিক পড়াশোনার দরকার নেই। নারীর উচ্চশিক্ষা মানে টাকার অপচয়....! নারী ঘরের বাইরে যাবে না। এমনকি নারীরা ঘরের বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নিতে পারবে না।

নারীর প্রতি  এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্টতই তার পুরুষতান্ত্রিক দর্শন, মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে তিনি দেশে একটি পুরুষতান্ত্রিক [Patriarchal] সমাজ ব্যবস্থাকে হেফাজত করতে চাইছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণত পুরুষ [এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নারী] অন্যায় ও বৈষম্যমূলক নিয়ম–কানুন প্রয়োগ করে  নারীর উপর কর্তৃত্ব করে, নারীর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে; যা ইসলাম ধর্ম এবং দেশের সংবিধান বিরোধী।

পবিত্র কুরআন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেয় না, বরং যে কোন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণকে শিরক্ হিসাবে অবিহিত করে।

ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবীজির স্ত্রী খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী, অন্য স্ত্রী আয়েশা (রা.) ছিলেন একজন বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি, যিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার -প্রসার-উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন, এমনকি  সেসময় তিনি যুদ্ধেও নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ইসলাম ধর্মে প্রত্যেক নারী-পুরুষ এর জন্য শিক্ষা এবং জ্ঞান অর্জনকে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) জ্ঞান অর্জনের জন্য সাগর-মহাদেশ পাড়ি দিতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে চীনে যাও।

ধর্ম মতে, নারী-পুরুষ সবারই দায়িত্ব রয়েছে অন্যের প্রতি, পরিবার ও কমিউনিটির সদস্যদের প্রতি, মুসলিম-অমুসলিম সবার প্রতি, পুরো মানবজাতির প্রতি। ইসলাম ধর্মে কোথাও নারীকে ঘরের বউ হয়ে থাকার কথা বলা হয়নি।

কিন্তু আহমদ শফীর বক্তব্যে যে সব নারী ঘরের বাইরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, যেমন পোশাক শ্রমিক, তাদের সম্পর্কে যথেষ্ট অশালীন মন্তব্য করা হয়েছে। কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া পোষাক শ্রমিকদের সম্পর্কে এমন মন গড়া,  অশোভন মন্তব্য মানে তাদের অবমাননা করা, পরিবার এবং রাষ্ট্রে  তাদের অবদানকে অসম্মান করা।

নারীকে মানসিকভাবে আহত করা, মিথ্যা, কুৎসা রটিয়ে সমাজে তাদের হেয় করা- এসবই পুরুষতান্ত্রিক কূটকৌশলের অংশ যা অনৈতিক ও নিন্দনীয়।

অন্যদিকে তিনি নারীকে পুরুষের প্রতিপক্ষ বা পুরুষের শিক্ষা গ্রহণে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করছেন।

তার মতে, নারীদের দেখলে পুরুষের যৌনানুভূতি হয় যা তাদের মনোযোগ বাধাগ্রস্ত করে!  চরম আত্মবিশ্বাসহীন কোন পুরুষেরই কেবল এরকম হতে পারে- যা একান্তই ওই পুরুষের সমস্যা।

এখানে লক্ষণীয়, আহমদ শফী তার নিজস্ব ধারণা বা অভিজ্ঞতা দিয়ে [Subjective experience] পুরো পুরুষ জাতিকে বিচার করছেন এবং তার বিপরীত অভিজ্ঞতার পুরুষদের বিদ্রুপ করছেন। নারীর প্রতি তার এই দৃষ্টিভঙ্গী তার সমমনা পুরুষদের এই বার্তাই দেয় যে, -নারী ভোগের সামগ্রী এবং তাদের দেখলে পুরুষের যৌনানুভূতি হওয়া উচিৎ!
 
ব্যক্তিগতভাবে একজন পুরুষ নারীকে তেঁতুল বা মধু যাই মনে করেন সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু সে বিষয়ে জনসমক্ষে সাধারণীকৃত [Generalised] বক্তব্য এবং  অন্যকে প্ররোচিত করা অন্যায়। এই সমাজের অধিকাংশ পুরুষ নারীকে মানুষ মনে করেন, নারীদের সঙ্গে একসাথে পড়াশোনা করেন, কাজ করেন এবং নারীর সহযোগিতায় পাশে থাকেন। আর এই জন্যই সমাজ টিকে আছে। ইসলাম ধর্মে মানুষে মানুষে এই সহমর্মিতা-সহযোগিতার কথাই বলা হয়েছে।

চূড়ান্ত পুরুষতান্ত্রিক আচরণ হলো- কিছু পুরুষ নারীকে ভোগ্যবস্তু ভেবে লালায়িত হয়। আহমদ শফী ও তার শিষ্যরা এজন্য নারীকে দায়ী করে তথাকথিত পর্দা মেনে চলার ফতোয়া দেন।

ধর্মের নামে, পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্ব করে ওই সব পুরুষের চারিত্রিক সমস্যার দায় নারীর উপর চাপানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পর্দার মূল বিষয় হচ্ছে শালীনতা- মনে, চোখে ও পোশাকে। আমাদের দেশের প্রায় সব নারী প্রয়োজনীয় শালীন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করেন।

তাছাড়া ধর্মে নারী-পুরুষের শালীনতা সমান গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি, আহমদ শফী তার অনুসারী ও ছাত্রদের যথাযথ শালীনতা সম্পর্কে জ্ঞান দেবেন। বিশেষ করে মনের ও চোখের পর্দা সম্পর্কে। যাতে ওই সব পুরুষ নিজেদের সংযত করে চলতে পারে, নারীর শরীরের কোনায় কোনায় দৃষ্টি না দিয়ে নারীকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করতে শেখে।
 
প্রসঙ্গত, এ দেশের  মুসলিম নারী বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির আলোকে ধর্মের রীতি-নীতি মেনে চলেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। এদেশের নারী সৌদি বা আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক রীতি নীতি মানতে বাধ্য নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ধর্মের রীতি-নীতি কে, কিভাবে পালন করছে তা বিচার করার অধিকার রাখেন কেবল আল্লাহ্, কোন মানুষ নয়।

হেফাজতে ইসলাম বা আহমদ শফীর বক্তব্য আপাতত দেশের নারী শিক্ষা-উন্নয়নে কোন নেতিবাচক  প্রভাব হয়তো ফেলবে না। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে সেরকম কিছু হতে পারে, যা মোটেও কাম্য নয়।

কারণ আহমদ শফী ও তার অনুসারীরা অনেকেই হয়তো গ্রামে-গঞ্জে এভাবেই ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।

এতে ধর্মের নামে এই অপশিক্ষা পাচ্ছে শিশুরাও।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু বয়সে কোমল মনে মানুষ যা বিশ্বাস করে পরবর্তীতে তা দূর করা বা পরিবর্তন করা কঠিন। তাই কাওমী মাদ্রাসার শিশুরা ইসলাম ও নারী বিষয়ে নারীবিরোধী বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বড় হচ্ছে।
 
এরই মধ্যে আমরা এই সহজ সরল শিশুদের হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক কাজে ব্যবহৃত হতে দেখেছি। আগামী পাঁচ বছর পরে এই শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কি করবে আমরা জানি না। যদিও আমি এই ছাত্রদের কোন দোষ দেখি না। তাদের যারা শিক্ষা দিচ্ছেন পুরো দায় তাদের।

ধর্মের নামে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক রীতি-নীতি বা বৈষম্যমূলক অপসংস্কৃতির এই চর্চা বন্ধে তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবাইকেই উদ্যোগী হতে হবে। কারণ, এটা আমাদের সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতিসহ সমগ্র উন্নয়নের বিষয়। তাই বিষয়টিকে শুধু আলোচনা ও রাজনীতিকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

সীনা আক্তার: গবেষক,  <[email protected]>

বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০১৩
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।