পানি ঘোলা করে খাওয়া’র প্রবাদটা সবারই জানা। ক্ষমতাসীনরাও অনেক বিষয়ে পানি ঘোলা করে খেয়েছে।
অনেক সময় মেলানো হিসেব মেলে না। আর হিসেব না মেলার কারণে খেসারত দিতে হয়, হয়েছেও। এতোদিনে অন্তত খেসারতের হিসেবগুলো ক্ষমতাসীন দল করেছে নিশ্চয়ই! না করলে হিসেবে আরো গরমিল যে দেখা দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সেই পুরোনো খাতা খুলতে গেলে শুরু করতে হয় পদ্মাসেতু দিয়ে। সবাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, প্রমাণ দিলো- কিন্তু সরকার প্রধান কোন দোষই খুঁজে পেলেন না বিশেষ একজনের। ফলাফল, কেবল বিশেষ সেই জনই থাকলেন, সরে গেলো বিশ্বব্যাংক।
নিজেদের দেশবাসীর কাছে স্বজনপ্রীতির চরম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরলো ক্ষমতাসীনরা। শক্ত হাতে দুর্নীতি দমনের প্রত্যয় ব্যক্তকারীর কণ্ঠে ফুটলো নমনীয় সুর। জনগণের ইচ্ছা-আশা-আকাঙ্খা গুরুত্বই পেলো না যেনো!
এরও আগে অবশ্য শুরু হয়েছিলো কালো বিড়াল কাহিনী। সে তো সবারই জানা। রেলমন্ত্রী এখন দপ্তরবিহীন। বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে আটক এপিএসের সে লজ্জা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দলে, দেশে।
দপ্তরবিহীন করলেও লৌহমানবীর কাছ থেকে আরো জোরালো পদক্ষেপ আশা করেছিলো সাধারণ জনতা। যিনি বলেন, যে দলেরই হোক দুর্নীতিবাজদের রক্ষা নেই, সেই তিনিই ফের দুর্নীতিবাজেদের রক্ষা করেন। যাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ গড়ার শপথ নিলেন, তাদের চেয়ে বর্ষীয়ান নেতার অবদান গুরুত্ব পেলো বেশি। হয়তো তাই ঠিক, পাওয়াই উচিত, কিন্তু জনরায়ে এর প্রভাবটাও খেয়াল করেছেন নিশ্চয়!
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার একটা ভালো উদাহরণ শেষ পর্যন্ত দিতে পেরেছেন তারা। শুরুর দিকে মানতেই চাইচিলো না প্রশাসন। এতো এতো টিভি ফুটেজ, পত্রিকায় ছবি প্রকাশের পরও যেনো আসামি চেনাই যাচ্ছিলো না। কতদিন এ নিয়ে জলঘোলা! অবশেষে টনক নড়েছে। শুরু হয়েছে সঠিক পথে বিচার।
যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা নিয়েও টালবাহানা ভালো চোখে দেখেনি জনসাধারণ। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ। তারপর তো সৃষ্টিই হলো নতুন ইতিহাস। জেগে উঠলো তরুণ সমাজ।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলো আপামর জনসাধারণ। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের কথা ভিন্ন। পরে গোলাম আজমের ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশে আবারো ফুঁসে ওঠে গোটা দেশ। একদিন বিরতি দিয়ে মুজাহিদের ফাঁসির রায়, সে আগুনে কিছুটা পানি ঢালে মাত্র।
দ্বিধাদ্বিত জনতা। রায় কার্যকর হবে কি না। যেদিন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা হয়, সেদিন সরকারের জনপ্রিয়তার পারদ যতটা উঠে, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি নীচে নেমে যায় যেদিন যাবজ্জীবন বা অন্য কোনো শাস্তির আদেশ দেন বিচারক। রায় তো হচ্ছেই, ঘুরে ফিরেই...কিন্তু জল ঘোলা না করলে যেনো শান্তি নেই সরকারের।
জামায়াত শুরু থেকেই এই ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার একটা চেষ্টা করেছে। তাদের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। ট্রাইব্যুনাল অনেক বেশি স্বচ্ছ, মানসম্পন্নও। বিশেষ করে আসামি পক্ষের সুযোগ-সুবিধা পৃথিবীর অন্যান্য ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি। আসামিদের এত বেশি সুযোগ রাখার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি না।
স্কাইপ কেলেঙ্কারি এই ট্রাইব্যুনালের একটি বড় দুর্বলতা। সেই বিচারপতির সরে যাওয়া বা সরিয়ে দিয়ে, একটা সম্মানজনক সমাধান হয়েছে। অনেক ট্রাইব্যুনালে আপিলের সুযোগ থাকে না, এক্ষেত্রে আসামিরা গুরুত্ব পেয়েছে।
উপরন্তু বিতর্কিত করার জন্যে ‘স্বচ্ছ’ ও ‘আন্তর্জাতিক’ মানের জামায়াতী প্রচারণার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে সরকার। সমালোচনার একটি জায়গা এটা বটে।
আলজাজিরা বা ইকোনোমিস্ট দিনের পর দিন প্রচারণা চালিয়ে গেলেও সরকার নীরব। দূতাবাসগুলোকে কাজে লাগানো হয়নি। আলজাজিরা যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিপক্ষে, জামায়াতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কাজ করছে, তার প্রতিবাদ করতে পারেনি সরকার। সরকার তার অবস্থানও ব্যাখ্যা করতে পারেনি। জামায়াতের পক্ষে আলজাজিরা কাজ করছে, সরকার এটা তুলে ধরতে পারেনি।
হেফাজতে ইসলামকে নিয়েও বেশ বিপাকে পড়েছে সরকার। কিন্তু কেন সেই বিপাক, সেই হিসেবটা এখনও মেলে না। এটা তো বাংলাদেশ, আফগানিস্তান বা পাকিস্তান না। তারপরও কিভাবে জামায়াত-শিবির, হেফাজতে ইসলামের মতো দলকে দমনে দ্বিধান্বিত সরকার। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শক্ত হাতে দমন করতে গিয়েও কখনও কখনও শিথীল হয়েছে যেনো। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ, সমাবেশ শেষে কর্মীদের ঢাকা ছাড়া করা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি এবং তা বলিষ্ঠতার সঙ্গে না সামলানোর ঘটনা অনেকটাই অজনপ্রিয় করেছে সরকারকে।
এটা তো সবাই জানেন এবং মানেন নিশ্চয়, যে সবাই শক্তের ভক্ত নরমের যম। সরকার এই শক্ত, এই নরম।
আস্তিক-নাস্তিক বিভেদ তৈরি করে ব্লগারদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদসহ নানান ঘটনা কেবল বিতর্কিতই করেছে সরকারকে। যার ফলাফল পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কারণ ভোটও আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। সাধারণ হিসেবে যা হওয়ার কথা না।
বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের উপর ক্ষুব্ধ-বিরক্ত হয়ে তারা ভোট দিতে যায় নি। যারা দিয়েছে তাদের ভোটও ভাগ হয়েছে।
অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যা করেছে, তা সংখ্যালঘুরা প্রত্যাশা করে নি। সংখালঘুদের ঘর-বাড়ি-মন্দির-প্রতিমা ভাঙচুর এর সময় জামায়াত-শিবিরের এই তাণ্ডবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভূমিকা, একটি ঘটনারও আন্তরিকভাবে সঠিক তদন্ত না করাসহ আরো অনেক অসন্তুষ্টি যোগ হয়েছে।
শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে বলেই যে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে মানুষ, এমন ঢালাও সরল সমীকরণ বোধহয় ঠিক হবে না। আমজনতা যুদ্ধাপরাধীর বিচারের পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত দেশ ও সুশাসন আশা করে। সেই বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা না করে, কথার চেয়ে কাজ বেশি করাটাই হবে বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত। কথা নয়, কাজই ফিরিয়ে আনবে বিক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত হওয়া আমজনতাকে।
সাজেদা হক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, বৈশাখী টেলিভিশন, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩১ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৩
জেডএম/