পলাশীর যুদ্ধের সেই বিশ্বাসঘাতকদের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? হঠাৎ করে শত বছর আগের ইতিহাসে ফেরত যাওয়াতে অবাক হচ্ছেন, তাই তো? ওই যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমেই কিন্তু আমাদের শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে মেনে নিতে হয়েছিলো। আর কে জানে হয়তো এ জন্যই আমাদের মাঝে এক ধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতা গড়ে উঠেছে।
এই যেমন ধরুন, আপনি কিছু একটা কিনতে গেলেন, দোকানি হয়তো বলে বসবে এটা বিদেশি তাই দাম একটু বেশি। আর আপনিও বিদেশি জিনিস ভালো ভেবে চড়া দামে কিনে নিয়ে আশপাশের সবাইকে হয়তো আচ্ছা মতো বলে বেড়াবেন, কাল না একটা বিদেশি জিনিস কিনলাম।
কিংবা ধরুন, আপনি একটি নতুন কোম্পানি খুলবেন, তো আপনার একজন এক্সপার্ট দরকার, আপনার যদি সামর্থ্য থাকে আপনি প্রথমেই ভাববেন দেশের বাহির থেকে, ভিনদেশি একজন এক্সপার্ট আনতে হবে। হয়তো ওই বিষয়ে দেশেই অনেক ভালো ভালো এক্সপার্ট রয়েছে, তারপরও আপনি ওই বিদেশি এক্সপার্টের পেছনেই অর্থ ব্যয় করবেন।
এছাড়া জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু আমরা এ ধরনের বিদেশ প্রীতি দেখিয়ে থাকি। আমার তো মনে হয়, আমরা অনেকেই এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর এই চিন্তা-ভাবনা আমরা আসলে পেয়েছি ওই ঔপনিবেশিক শাসন আমল থেকেই, যখন কিনা বুদ্ধি বৃত্তিক কাজ কর্ম থেকে শুরু করে উপরের সারির সব কিছুই সাদা চামড়ার কিছু বিদেশি শাসক গোষ্ঠী করে থাকতো। আর এ সব দেখে আমাদের মাঝেও এই ধারণা চলে এসেছে, যা এখনো দূর হয়নি।
এই বার আসা যাক আমাদের মিডিয়া বা গণমাধ্যমগুলোতে। একটা সময় ছিলো যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষকে হয়তো ভারতীয় আকাশবাণী কিংবা পরবর্তী একটা সময়ে বিবিসি বাংলা রেডিওর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। এর মূল কারণ হয়তো ছিল দেশে সংবাদ মাধ্যমগুলো সে অর্থে স্বাধীনতা ভোগ করতো না। এছাড়া ছোট খাটো আরও কিছু সমস্যা তো ছিলই।
কিন্তু গত দশ বছরে আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো বেশ ভালোই স্বাধীনতা ভোগ করছে। আর বেসরকারি ক্ষেত্রে তো রীতিমত বিপ্লবই হয়ে গেছে। কে কার আগে সংবাদ প্রচার করতে পারবে, কে কতো ভালোভাবে সেটিকে তুলে ধরতে পারবে, এইরকম একটা প্রতিযোগিতা যেন লেগেই আছে। আর সুস্থ প্রতিযোগিতা হলে যা হয়, সেটিই হয়েছে। দেশের মানুষ এখন দেশীয় সংবাদ মাধ্যমেই চোখ রাখে বেশি। এর মাঝেও একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়, আর সেটি হচ্ছে, ওই যে বললাম- ঔপনিবেশিক মানসিকতা।
যদিও দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আমরা চোখ রাখছি বেশি, কিন্তু একই সঙ্গে দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো এবং দেশের মানুষ জন, দেশের কোনো খবর যদি বিদেশের কোন খবরের কাগজে প্রকাশ প্রায় তাহলে সেটিকে অনেক বড় করে দেখে।
এই যেমন ধরুন, ওয়াশিংটন টাইমস কিংবা সানডে টাইমস পত্রিকা যদি বাংলাদেশ নিয়ে কিছু লেখে, তাহলে দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সেটা ফলাও করে প্রচার করা হবে, আর মানুষও সেই খবরগুলোকে বিশেষ গুরুত্ত্বের সঙ্গেই নেয়। এ নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। অর্থাৎ এখানেও কিছুটা ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রকাশ কিন্তু দেখতে পাওয়া যায়।
‘থিঙ্কিং ফ্রম দ্যা বিলো’ বলে একটা কনসেপ্ট আছে। এর অর্থ হচ্ছে নিচ থেকে চিন্তা করতে হবে। আরও ভালোভাবে যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে ব্যাপারটি আর কিছুই না। আপনি যাদের নিয়ে কথা বলছেন বা যে বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, তাদের কথা বা মতামতকে সব চেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আর তাহলেই আপনি প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে পারবেন বা নিশ্চিতভাবেই একটা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারবেন।
এখন যে মানুষটি আমাদের ভাষায় কথা বলে না, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সেই অর্থে ধারণা নেই; শুধু দেখে, শুনে বা পড়ে যদি একটা মতামত দেয় সেটি কেনো আমরা বিশ্বাস করতে যাবো?
যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো আজকাল এই ‘থিঙ্কিং ফ্রম দ্যা বিলো’ কনসেপ্টে ভর করে নিজেদের দেশের সমস্যাগুলো সমাধান করছে, সেখানে আমরা এর বিপরীতে অবস্থান করে সমস্যাকে কাছে টেনে নিচ্ছি।
আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকাগুলোতে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, সেখানে অনেক ভিন দেশি লেখক তাদের কলাম লিখে থাকেন। বিষয়টি এমন না যে পৃথিবীর অন্য কোন দেশে ভিন দেশি লেখকরা লেখেন না। সেখানেও লেখা হয়, কিন্তু সেটার মাত্রা কি, আর ওইসব লেখক সে দেশে কতটুকু পরিচিতি পান সেটাও একটা দেখার বিষয়।
এই যেমন ধরুন পাকিস্তানি হামিদ মীর। উনি বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রায়শই লিখে থাকেন এবং আমার ধারণা আমরা যারা সব সময় পত্র-পত্রিকায় চোখ রাখি তারা এই নামটি কম-বেশি জানি। এই হামিদ মীরের বাবাকে তো `বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা` পুরস্কারও দেওয়া হয়েছে। আর ওই পুরস্কার বাবার পক্ষ থেকে হামিদ মীরই গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশে এসে। এছাড়া এই পাকিস্তানি নাকি বলেছিলেন- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারাও করবে। আর এ সব খবরই আমরা পেয়েছি দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে। অর্থাৎ এই পাকিস্তানিকে মোটামুটি বীরের মর্যাদায় স্থান দেওয়ার কাজটুকু কিন্তু আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলো করে রেখেছে।
এ পর্যন্ত লিখতে পারলে বোধহয় ভালোই হতো। কারণ সেক্ষেত্রে হয়তো কিছু একটা লিখে উপসংহার টেনে দেওয়া যেতো। কিন্তু বাধ সাধলো অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের দৈনিক ‘জং’ এ লেখা হামিদ মীরের একটি কলাম।
আর এই কলামের খবরও কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশীয় সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি।
এমন নয় যে সরাসরি পাকিস্তানি পত্রিকা পড়ে জানা যাবে না, কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এ দেশের মানুষ ভিন দেশি পত্রিকা পড়ে না। তাই ভিন দেশীয় একটি খবর যদি খুব বেশি প্রচার পায় সেটি কিন্তু এই দেশীয় সংবাদ মাধ্যমের মাধ্যমেই পেয়ে থাকে।
হামিদ মীর তাঁর কলামে কি এমন লিখেছেন যে সেটি নিয়ে আবার এদেশেও লিখতে বসতে হবে? খুব ভালো হতো যদি বিষয়টি নিয়ে না লিখে থাকা যেতো। যাই হোক, তিনি যা লিখেছেন তার সারমর্ম করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে- গোলাম আযম হচ্ছেন একজন জাতীয় বীর আর বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার বিচার করা হচ্ছে।
এছাড়াও হামিদ মির লিখেছেন, ৯০ বছরের বৃদ্ধ গোলাম আযমকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানো উচিত।
এসব কথা কিন্তু তিনিই বলেছেন, যাকে আমরা, আমাদের দেশীয় কিছু খবরের কাগজের সৌজন্যে এই লেখা পড়ার আগ পর্যন্ত বীরের আসনেই বসিয়ে রেখেছিলাম।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তিনি কেনোই বা এ জাতীয় একটি কলাম লিখতে গেলেন বা কোন প্রেক্ষিতে লিখতে গেলেন? দেখুন, উনি কেনো লিখেছেন বা কোন প্রেক্ষিতে লিখেছেন সেটি কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ কিংবা দেশের জন্য গুরত্বপূর্ণ না, যেটি গুরুত্ত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, তিনি আমাদের দেশের একজন চিহ্নিত ও প্রমাণিত খুনি যুদ্ধাপরাধী, যিনি কি না শুধু তার বয়সের কারণে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেলেও ৯০ বছরের কারাদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পাননি, তাঁকে তিনি জাতীয় বীর বলেছেন। আর এও বলেছেন, তাকে দেশের বাহিরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার।
যেখানে আমাদের দেশে গোলাম আযমের চিকিৎসা এবং তাঁর চিকিৎসাকালীন খাবার দাবারের তালিকা দেখে চোখ কপালে তুলছেন অনেকেই। কারণ এই দরিদ্র দেশে অনেক নিরাপরাধ, নিষ্পাপ শিশুকে না খেয়ে থাকতে হয়, যারা কি না মানুষ হত্যা তো দূরে থাকুক, একটা ছোট প্রাণীও হত্যা করতে পারবে না। আর এই গোলাম আযম হাজার মানুষ হত্যা করে যে সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে সেটা নিয়ে লিখতে গেলে নতুন করে আরেকটি লেখা শুরু করতে হবে। তো এই ঘৃণ্য অপরাধীকে যিনি বীরের মর্যাদা দিতে পারেন, তাকে আমরা, এদেশের মানুষ জাতীয় খলনায়কের মর্যাদা তো দিতেই পারি। অপেক্ষায় আছি সংবাদ মাধ্যমগুলোর এ ক্ষেত্রে ভুমিকা নিয়ে।
যাই হোক, লেখাটি শুরু করেছিলাম আমাদের বিদেশি জিনিসের প্রতি অতি প্রীতি দিয়ে। আমার মনে হয় অন্তত গণমাধ্যমগুলোর এই প্রীতি থেকে সরে আসা উচিত। এক্ষেত্রে অবশ্যই সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে, কারণ আমরা স্বাধীন হওয়ার পর বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেছে, আর ঔপনিবেশিক আমল তো অনেক দূরের বিষয়। তাহলে কেনো আমরা শুধু শুধু এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা ধরে রাখবো? তবে সংবাদ মাধ্যমগুলো যদি তাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসে, আমি নিশ্চিত সাধারণ মানুষও এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসবে। আর তাছাড়া আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ভালো এগিয়েছি, কেন শুধু শুধু এ সব অর্বাচীন ধ্যানধারণা নিয়ে বসে থাকবো?
আমিনুল ইসলাম: সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় [email protected], [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২২২৫ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৩
জেডএম