ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আমাদের ব্যর্থ কূটনীতির শূন্যহাত

অজয় দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৩
আমাদের ব্যর্থ কূটনীতির শূন্যহাত

বিটিভি তার একক দৌরাত্ম্যের কালে আমাদের যা দিতো, যা গেলাতো তাই গিলতে বাধ্য হতাম আমরা। সাহেব-বিবি- গোলামের বাক্স নামে পরিচিত আমাদের রাষ্ট্রীয় চ্যানেলে একখানা প্রোগ্রামের নাম ছিল ‘সর্ম্পকের নতুন দিগন্ত’।

জানি না আজো তা চলে কিনা। ঐ প্রোগ্রাম দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল একটাই: `দেখো দেখো আমি কত বড় এক নেতা বা সরকারপ্রধান"। যেদেশেই যাই আমার কত খাতির আর সম্মান। বিদেশের পথঘাট নদীনালা সাহেব-বিবি-চাকর-বাকর হোটেল রেস্তোরাঁরার বয়-বাবুর্চিদের দেখিয়ে বলা হতো, কোটি কোটি টাকার সফর সাকসেসফুল। এই আর ক’দিন মাত্র চীনারা, ইংরেজরা, আফ্রিকান, আমেরিকান বা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষরা হুমড়ি খেয়ে পড়লো বলে। তখন এরশাদ আমল। ঐ প্রোগ্রামের মাজেজা হলো, তাঁর আমলে সব দেশের সরকারপ্রধান নেতা-নেত্রীরা বাংলাদেশকে নিয়ে মহা ব্যস্ত। ধন্য ধন্য রবে পৃথিবী ব্যাকুল। শেষে  দেখা গেল জনরোষে ভূপাতিত সেনাশাসকের পাশে কেউ নেই। বাংলাদশ যে এতিম সে এতিমই পড়ে রইলো। তিনি ঢুকলেন নির্জন সেল বা বাড়ি নামের এক আধুনিক কারাগারে।

সময়ের বির্বতনে আমাদের দেশে গণতন্ত্র এসেছে. এখন তা ঘাত প্রতিঘাতে শক্ত হচ্ছে, আঘাত সামাল দিতে শিখছে। কিন্তু মোসাহেবি আর চামচাগিরি যায়নি। বর্তমান সরকার যখন বিপুল ভোটে জিতে শাসনভার হাতে নিলো তখন আমরা সবাই উল্লসিত হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের ধারণা ছিল ডিজিটাল স্বপ্ন দেখানো সরকারে আর যা-ই হোক এনালগ ভূত ঢুকতে পারবে না। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। কিছু দিন যেতে না যেতেই কচিকাঁচার আসর নামে পরিচিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে লাগলো। কেউ  টাকার বস্তা  নিয়ে বিপদে, কেউ ভবনধসের পর বাজে কথা বলে বিপাকে, কেউ বা সেতু গিলে ফেলার দায়ে  জননিন্দিত। সবাইকে টেক্কা দিয়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর মন্ত্রী হয়ে উঠলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এমনই যে তাঁকে সংবাদ সম্মেলন করে বলতে হচ্ছে তিনি আসলে কতটি দেশ কতবার সফর করেছেন। কতবার উড়াল দিয়েছেন। প্রথম কথা হলো, পররাষ্ট্র বা বিদেশমন্ত্রী তো বিদেশ সফরে যাবেনই, এতে ব্যাখ্যা দেয়ার কি আছে? ব্যাখ্যার কারণ হবে তাঁর এই সফরগুলোয় দেশ বা জনগণের কি লাভ হয়েছে? সেটা তিনি আদপেই তুলে ধরতে পারেননি। উল্টো নিন্দুকেরা বলে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আকাশে থাকার সময়গুলোতেই নাকি ইউনুস-বিভ্রাটের জমিন তৈরি করেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

সে তিনি যাই করুন তাঁর আমলে আমাদের বিদেশনীতি বা বৈদেশিক নীতির কোনো হেরফের ঘটেনি। ঘটেনি বলেই আওয়ামী লীগের পরম বন্ধু বলে পরিচিত ভারত সফরে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে তাঁকে। এটা আর যাকেই বিস্মিত করুক আমাকে করেনি। ভারতীয় সুধিজন বা সুশীলদের আমরা জামাই আদর দিই। তাঁদের থার্ড ক্লাস প্রতিভাকে মাথায় তুলে নাচি, দেশে ডেকে এনে তাঁদের যে অযাচিত সম্মান আর উপহার দিই তাতে তাঁরা যতটা খুশি তারচে’ অধিক মুখ টিপে

হাসেন তারা। ভাবেন, এই তোমাদের স্ট্যান্ডার্ড?  গাধাকে তো আর বলে দিতে হয় না যে সে গাধা, ফলে তারা খুব ভালোই জানেন আমরা তাদের চেয়েও বড় গাধা। একাত্তরে আমাদের পাশে দাঁড়ানো ভারত আর আজকের ভারত কি এক? সে ভারতের চোখে ছিল সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন। দুনিয়াজোড়া সাম্যবাদের জয় জয়াকারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় ছিল আদর্শ আর মানবিকতার বিজয়। মার্কিন বিদ্বেষী সেই ভারত আজ আমেরিকার জানি দোস্ত। তার বহুজাতিক বাজারের দুয়ার খুলে আগত

ব্যবসায়ীরা এই দেশের খোল নলচে পাল্টে দিতে ব্যস্ত। নরেন্দ্র মোদী এখন প্রধানমন্ত্রীত্বের ঘোরে আছেন। সেদেশে বিজেপির মত দল একক গরিষ্ঠতায় কংগ্রেসের চেয়েও জনপ্রিয়। আজকের ভারত জিনস-পাতলুন বিকিনি-প্যান্টি সাধু-সন্তের মিশ্রণে এক জগাখিচুড়ি দেশ। তারা জিডিপি,বাজার, কমোডিটি, সিরিয়াল, পরকীয়া  মদ খানাপিনা আর স্বল্পবাস ছাড়া কিছুই বোঝে না। এমন বাণিজ্যনিভর্র দেশ ও সমাজে কেবল আশার হাত বাড়ালে মাড়োয়ারিরা দু’চার টাকা ভিক্ষা ছাড়া কিছুই দেবে না।

আমরা আমাদের ন্যায্য চাওয়া, এমনকি আমাদের ওপর অন্যায্য আক্রমণের বিরুদ্ধেও সরব  হতে ভুলে গেছি। আমাদের এই প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের সঠিক কোন দৃষ্টিভঙ্গিই নেই। আমরা আমাদের ন্যায্য চাওয়াও তুলে ধরতে পারি না। ওপার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে নিয়ে দিল্লি যত উপহাস আর বিদ্রুপ করুক না কেন আখেরে তার কথামতই পানি বন্টন বাঁধ ও সীমান্ত বিষয়ে আমাদের কিছু দেয়নি দেবেও না। এই  অপমান আর হাত ধুইয়ে দেবার কূটনীতি সামাল দেয়ার জন্য যে মেধা আর কৌশলের প্রয়োজন দীপু মনির তা নেই। জুলফিকার আলী ভুট্টো, বন্দরনায়েক. নেপালের রাজবংশ এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলার ইতিহাস আছে ভারতের। তারা ঝানু ও মেধাবী। তবে সেদেশের আনাচে কানাচে সমস্যা। মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, কাশ্মীর কোনোটাই তারা হাতের বাইরে যেতে দেয় নি। সেখানে আমাদের মত দেশের শুধু  ইংরেজি বলতে জানা বিদেশমন্ত্রীকে তারা কতটা কি দেবেন সেটা আনুমান করা কি সত্যি কঠিন?

দীপুমনির খালি হাতে ফেরা আসলে আমাদের রাজনীতির আদর্শিক দীনতারই পরিচায়ক। আমরা নিজেরা নিজেরা মারামারি হানাহানি করি আর সালিশের জন্য  ভিনদেশিদের ডেকে আনি। আমাদের দেশের নির্বাচন কিভাবে হবে কখন হবে কে পাওয়ারে আসবে কে বিরোধী দলে থাকবে সে নির্দেশনাও নাকি আসে দূতাবাসগুলো থেকে। আমাদের রাজনীতি বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মত দেশপ্রেমিক নেতা হারাবার পর থেকে ক্রমাগত অনাথ হয়ে এখন দিশেহারা। ভারত এর  আগাগোড়া সব জানে। শুধু জানেই না, তাদের হিসাবের খাতা আমাদের মত গোলমেলে বা গোঁজামিলে ভরা নয়। যেদেশের রাজনীতি না চাইতে নতজানু হয়ে পড়ে যে দেশের নেতারা পালা করে গিয়ে তাদের প্রণামী-সেলামী দিয়ে আসে তাদের তারা কিভাবে ট্রিট করবে সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স জানতে হয় না।

মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর দেশে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নিরাপদ নন। জনশ্রুতি আছে, একবার রবীন্দ্র জয়ন্তীতে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীকে প্রধান অতিথি করা আনা হয়েছিল।   সভা শেষের ভাষণে নাকি তিনি বলেছিলেন  রবীন ঠাকুর বহুত বড় ঠাকুর আছিল। তিনি বিলায়েত গেলেন তো আসার সময় একটা নোবেল ভি নিয়া আসিলেন।   সে টাকায় শান্তি লিকেতন বানাইলেন। এতক্ষণ লেড়কা লোক গানা শোনাইল আর লেড়কি লোক নাচা দেখাইল। আগার আপনি সজ্জন ব্যক্তিহ ইবেন তো জরুর কুছ দান করিবেন। এইবার ভাবিয়া দেখেন রবিন ঠাকুর কত বড় ব্যবসায়ি আছিলো"।

এমন দেশ সফরে আত্মসম্মান আর মর্যাদা না থাকলে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে খালি হাতে ফিরে আসবেন তাতে আশ্চর্যের কি আসলেই কিছু আছে?

সিডনি

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, ‍জুলাই ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।