ঢাকা: পাশের দেশ ভারত। সেদেশে রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠলেই গান্ধী পরিবারের নামটা এসে যায় অনিবার্যভাবেই।
এ হত্যাকাণ্ডের পর স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবারে এসেছিল শূন্যতা। ভারতের রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু তাই বলে ভারত থেমে থাকেনি। কংগ্রেস রাজনীতিও এই শোকে স্থবির হয়ে পড়েনি। খণ্ড-বিখণ্ড হয়নি দল। তাৎক্ষণিকভাবে সোনিয়া গান্ধীকে আসতে হয়নি রাজনীতির মঞ্চ কাঁপাতে কিংবা রাজীব গান্ধীর নিহত হওয়ার ২৩ বছর পরও ভারতের ক্ষমতার প্রধান নির্বাহী হতে হয়নি সোনিয়া কিংবা রাহুল গান্ধীকেও।
নির্বাচনে ভাই রাহুল গান্ধীর পক্ষে সফল নির্বাচনী প্রচার চালিয়েও ৪১ বছরের ভারতের আলোচিত মেয়ে রাজীব তনয়া প্রিয়াংকা এখনও রাজনীতিতেই প্রস্তুত নন। এখনও নিশ্চিত হয়নি প্রিয়াংকা ২০১৪-র নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন কিনা।
রাহুল গান্ধীর একটা সুস্থ ইমেজের কারণে তরুণদের কাছে তিনি আকাঙ্ক্ষিত। ছাত্র সংগঠন ও যুব সংগঠনের সফল নেতৃত্ব দিয়ে রাজনীতিতে পোক্ত হয়েছেন তিনি। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজের শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত সেই রাহুলের পক্ষে ২০০৪ সালে ভারতের সংসদ নির্বাচনে আমেথির আসনে প্রিয়াংকা ভাইয়ের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন এবং সফল ইমেজ প্রভাবিত করেছিল সে সময় আমেথির জনগণকেও।
রাজনীতিতে জনমুখি প্রভাবই মানুষকে রাজনীতিবিদ করে তোলে। গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠিটিও মূলত এই জনমুখিতাই। ইন্দিরা-রাজীবের একাডেমিক শিক্ষা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। পশ্চিমা শিক্ষায় এরা নিজেরা বেড়ে উঠেছেন। তাদের নেতৃত্ব ভারতকে অন্তত পেছনের দিকে ঠেলে দেয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের অবস্থান ছিল সম্মানের। এরই ধারাবাহিকতায় এমনকি রাহুল তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়েই ভারতের ক্ষমতার উচ্চাসনে এসে যেতে পারতেন। হয়ত ভারতও প্রস্তুত এই নেতৃত্বের জন্য। কিন্তু, সোনিয়া পরিবার যেন প্রস্তুত নয়!
কিন্তু বাংলাদেশ!
সম্প্রতি দুটো বক্তৃতা নতুন করে বাংলাদেশকে চমকে দিয়েছে। এক বক্তৃতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের এবং অন্যটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তারেক রহমানের। দুজনই প্রবাসী কিংবা পরবাসী। একজন ব্যবসায়িক সূত্রে; অন্যজন মামলার বোঝা নিয়ে দেশ থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত।
একজন দেশের একটি ইফতার পার্টিতে গিয়েছেন প্রধান অতিথি হিসেবে, অন্যজন আরেক ইফতার পার্টিতে লন্ডনে। প্রথমজন একটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন সারা দেশব্যাপী।
সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা তিনি। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে হঠাৎ করে কোনো এক ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় তিনি এক আশ্চর্য তথ্য দিলেন আওয়ামী লীগ কর্মীদের। বললেন, তার কাছে তথ্য আছে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসছে। কিন্তু, তথ্যটা তিনি খোলাসা করতে পারেন নি।
চার চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর নির্জীব কর্মীরা আশাহীন। এসময় তার এ রকম বক্তৃতায় কর্মীরা হয়ত চাঙা হলো ঠিকই, কিন্তু প্রযুক্তির এই উপদেষ্টা এমনকি তার প্রযুক্তিগত কোনো তথ্য-উপাত্ত কিংবা গবেষণার তথ্য না তুলে ধরে ঢালাওভাবে ক্ষমতায় আসার আগাম সংবাদ দিয়ে তিনি কী জনমনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলেন না! নাকি বিরোধী দলকে একটা টোপ হাতে দিলেন তিনি!
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া যে নির্বাচন স্বচ্ছ হবে না, বিরোধী দলের সেই ইস্যুটাকে আরো যেন হাতের নাগালের মধ্যে তুলে দিলেন তিনি। অথচ হানিফ থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন জয়ের মতোই। সরকারের শেষ সময়ে এবং বলতে গেলে ভোটের রাজনীতিতে পরাজিত আওয়ামী লীগের ব্যানারে এ রকম অর্বাচীন উক্তি কী তাদের আগামী নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নবোধক নয়!
বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, সজীব ওয়াজেদ জয়কে কেন্দ্র করে এখন ঝড় উঠেছে, জয় কি আগামীর প্রধানমন্ত্রী? যুবলীগ-ছাত্রলীগের একটা অংশ থেকে এ দাবি যেন জোরদারই হচ্ছে। জানি না, এ স্বপ্ন সজীব ওয়াজেদ জয় দেখেন কিনা। কারণ, রাজনীতির কতটুকু ধারে-কাছে আছেন মার্কিন নাগরিক সজীব ওয়াজেদ জয়। তার নেই ছাত্র-যুব আন্দোলনের কোনো অতীত। এ অবস্থায় আমেরিকা থেকে উড়ে গিয়ে মায়ের আঁচল ধরে যদি একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়, তবে এ সুযোগ কে অবহেলা করবে!
ঠিক একইভাবে তারেক রহমানও একই সময়ে লন্ডনে এক সভা করেছেন। এ সভায় তিনি তুলে ধরেন আগামীর ভাবনা। রাজনীতিতে তার অতীত কী ছিল তা কারো অজানা নয়। বিএনপি জোট সরকারের শাসনামলে হাওয়া ভবনের দিকে ছিল সারা দেশের চোখ। এই ভবন নিয়ন্ত্রণ করতো তখন সারা বাংলাদেশ। শত শত হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-চাঁদাবাজি-খাম্বা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক নাকি ছিল এই হাওয়া ভবন! এ রকম অভিযোগই মূলত ঘুরে ফিরে আসছে পত্র-পত্রিকায় এবং এখনকার সরকারি দলের বক্তৃতায় বিবৃতিতেও।
অর্থ পাচার, দুর্নীতি প্রভৃতির মামলা মাথায় নিয়ে এখন রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া একজন আধা-ব্রিটিশ তারেক রহমান (কারণ ব্রিটিশ নাগরিক হতে চাইলে তা সময়ের ব্যাপার)। এমনকি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে এরকম অসংখ্য দুর্নীতির কথা। ছাত্র-যুব আন্দোলনে কোনোদিনই তার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। কিন্তু, তারপরও হুট করেই তিনি পরিণত হন বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতায়।
এই তারেক রহমান এখন লন্ডনে বসে কর্মী আর সাংবাদিকদের সামনে তার আগামী বাংলাদেশের ভাবনার কথা বলেন। টেসকো-আসদা প্রভৃতি সুপার মার্কেটে দৈনিক বাজার করে এখন বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছেন তিনি।
বাংলাদেশের কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, প্রযুক্তি-পর্যটনসহ রাজধানীর যানজট, পানিসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছেন। তার পরিকল্পনা আর কেউ লুফে নিক কিংবা না নিক, ব্রিটেনে বিএনপি সমর্থকরা উৎফুল্ল। মোবাইল ফোনে ফোনে তার বক্তৃতার রেকর্ড নিয়ে ঘুরছেন আর বলছেন- নতুন প্রজন্মের সূর্যোদয় তারেক রহমান।
আমার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, বিগত জোট সরকারের আমলে যে নেতা হাওয়া ভবন নিয়ন্ত্রণ করতেন, যে সময় তার কাছে ছিল দেশ গড়ার অনন্ত সুযোগ, সে সময় তারেক জিয়া কোথায় ছিলেন?
ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগে এবং অফুরন্ত সময়ে এখন দেশ নিয়ে ভাবছেন তারেক রহমান। যখন ভাবনার সময় ছিল, তখন ভাবার ফুসরত পাননি। অথচ সে সময় সারাদেশ জুড়ে সবচেয়ে উচ্চারিত বিশেষ নামটি ছিল তার। সে সময় কেন-ই বা এখনকার স্বপ্নের এক পঞ্চমাংশও বলেননি দেশ নিয়ে? সেই নেতা স্বেচ্ছা নির্বাসনে এসে এখন দেশ নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলছেন!
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, তারেক জিয়া বাংলাদেশে আসলে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ ক্ষমতায় আসবে বিএনপি। কিংবা খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু যখন বলেন- তারেক রহমান বাংলাদেশের আগামী প্রধানমন্ত্রী, তখন মনে হয় তাহলে এই নেতারা কেনইবা রাজনীতি করেন!
মহাসচিব-সচিব হয়ে যদি বাংলাদেশের মানুষের ওপর কোনো প্রভাবই ফেলতে না পারেন, তাহলে এই রাজনীবিদদের হাতে বাংলাদেশে মানুষের প্রত্যাশাটাই কী? আন্দোলন-সংগ্রামের কথাই-বা বলেন কেন তারা?
জয় কিংবা তারেক নিঃসন্দেহে তারুণ্যের উদাহরণ হতে পারতেন। তাদের প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা বাংলাদেশের তরুণদের পথ দেখাতে পারতো। দেশ না হোক, অন্তত তাদের রাজনৈতিক ঘরানায় তারা সত্যিকার অর্থেই তারুণের আইডল হতে পারতেন। তারুণ্যের আইডল হয়ে এরা জনমানুষের কল্যাণে নিজেদের নিয়োগ করতে পারতেন। তাদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে দেশ-জাতির আসলেই কোনো সম্পৃক্ততা আছে?
কেউ রাজনীতি না করে, আবার কেউ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা মাথায় নিয়েও ভাবতে বসেছেন তারাই হয়ত বাংলাদেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। দলীয় সমর্থকরা কিন্তু সেটাই করতে চাইছেন।
তারেক জিয়া এখনও জীবিত। অথচ আশ্চর্য লাগে, তাকে জীবন্ত কিংবদন্তি করে গড়ে তুলতে ‘তারেক পরিষদ’ হয়েছে। তিনি একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অথচ তার নামেই যেন আরেক অঙ্গ সংগঠন। জিয়া পরিষদের পাশাপাশি তারেক পরিষদে নেতা হওয়ার জন্য এখন চলবে জোর লড়াই।
জয় কিংবা তারেক, তারা যেন বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ। কোনো কিছুই করার প্রয়োজন নেই। সংগ্রাম-রক্ত সবকিছু দেবে সাধারণ কর্মীরা। তারপরও জয় কিংবা তারেককে দেশের জমিদার হিসেবে দেখতে চান ওই নেতাকর্মীরা। শুধু দেশটা তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কর্মী-সমর্থকরা এখন পাগলপ্রায়। তাহলে এই কর্মীরা কিসের জন্য আন্দোলন করে? নেতারাই বা কিসের জন্য সংগ্রাম করেন, যেখানে নিজেদের যোগ্যতা প্রকাশ করতে চান, আরেকজনের আগমনের সংবাদ দিয়ে দেশবাসীকে?
ভারতের রাহুল গান্ধী ভারতের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আমেথির সংসদ সদস্য। আন্দোলন-সংগ্রামে এখনও রাস্তায় যিনি থাকেন তার দল কিংবা জনগণকে নিয়ে, সেই রাহুলকে দল থেকে রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব দেওয়ার জল্পনা-কল্পনা থাকলেও রাহুল সে দায় নিতে নারাজ।
অপার সম্ভাবনা আর উজ্জ্বল আগামী থাকা সত্ত্বেও প্রিয়াংকা এখনও রাজনীতিতে আসার ব্যাপারেই অপ্রস্তুত। অথচ বাংলাদেশে যেখানে দুটো দলের দুজন মানুষ, যারা জনগণ থেকে মূলত বিচ্ছিন্ন, সেই মানুষগুলো নিয়ে তাদের দল স্বপ্ন দেখে, এদের বসিয়ে দিতে চায় ক্ষমতার উচ্চাসনে! জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীনদের মনোনীত নেতা দিয়ে দেশে প্রধানন্ত্রিত্ব হতে পারে কি?
ফারুক যোশী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১৩
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর