ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অন্যরকম ১৪ আগস্ট, পেছন ফিরে দেখা

অজয় দাশগুপ্ত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৩
অন্যরকম ১৪ আগস্ট, পেছন ফিরে দেখা

ছেলেবেলায় আমরা কত কি যে ভুল শিখেছি তার ইয়ত্তা নেই। এই যেমন জাপানকে বলা হয় সূর্যোদয়ের দেশ।

অথচ তার ঢের আগে সিডনিতে সূর্যোদয় হয়। তারও আগে নিউজিল্যান্ডের সকাল হয় সিডনির রাত দুপুরে।

নলেজ বিষয়টিকে বিবেকানন্দই চমৎকার খোলতাই করে বলতে পেরেছেন। তার মতে, এটা হাতে থাকা টর্চের মত। যার টর্চের ব্যাটারি যত বেশি তার আলো তত প্রখর। যে যতটা দেখে ততটাই তার পৃথিবী। তখনকার মানুষের দৌড় জাপান অবধি থাকাতেই হয়তো এই ভ্রান্তি। এই যে এখানে এখন রাত গভীর, আর বাংলাদেশে রাত এখনো শিশু। সন্ধ্যার কোলে জেগে উঠছে মাত্র। দুনিয়ার বহু প্রান্তে তারিখ রয়েছে একদিন বা কিছুটা পিছিয়ে। আর আমাদের শহরে আমার শৈশবের স্মৃতি নিয়ে হাজির ১৪ আগস্ট।

ব্রিটিশের লৌহ কঠিন শাসন ভেদ করে স্বাধীন দু’টো দেশ কেন একদিনে স্বাধীন হলো না? কেন একটি ১৪, আরেকটি ১৫ তারিখে স্বাধীন হয়েছিলো? এ নিয়েও দু’ধরনের তর্ক আছে।

একদল বলে জিন্নাহ ছিলেন সন্দেহ প্রবণ। তিনি ব্রিটিশদের বিশ্বাস করতেন না। তর সইবার সময় ছিল না তার।

অন্যদলের মতে, ভারতের নেতারা গ্রহ তারকা আর পঞ্জিকা দেখে দিন ও সময় বেছে নিয়েছিলেন। যে কারণে তারা মধ্যরাতের পর স্বাধীনতা মেনে দেশের শাসন ভার গ্রহণ করেন।

সে যে ভাবেই হোক, দু’টি ভিন্ন তারিখে ভাগ হয়ে যাওয়া দেশের পূর্ব পাকিস্তানই ছিল আমার নিবাস ও জন্মভূমি। জন্ম থেকে বিমাতাসুলভ আচরণ আর ধর্মীয় ভেদাভেদের পরও এই দেশ এই মাটিতেই বড় হয়েছি।

আমাদের শৈশবের স্মৃতি মানেই পূর্ব পাকিস্তান। ছোটবেলায় মানুষের ধর্ম-বংশ-জাত বা অন্য কোন পরিচয় থাকে না। থাকলেও তা গৌণ। আমাদের ও ছিল না।   আমরা জানতাম এ দেশের শাসকরা আমাদের পছন্দ করে না। আমাদের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে ষড়যন্ত্র করে। আমাদের পীড়ন করে। তারপরও সেটি ছিল আমাদের দেশ।

আমরা সে দেশের অচলায়তনের বিরোধী হলেও আমাদের জীবন ছিল পদ্মা নদীর মত সচল। বলতেই হবে পাকিস্তানি শাসনের কু ফলেই আমরা অগণতন্ত্রী। ছেলেবেলায় আমরা যাকে স্যালুট ঠুকে বড় হয়েছি তিনি এক জেনারেল। তার ছবিতে বুক ভরা মেডেল আর মেডেল। কেন পেলেন কে দিলো সে প্রশ্ন করতো না কেউ।

একদিকে মেডেলওয়ালা জেনারেল, আর একদিকে ভয়- ফলে আমাদের বেড়ে ওঠাটাই ছিল দ্বিমুখী। এমন দেশের নাগরিক সহজ-সরল আদর্শের জীবন পাবে কোন উপায়ে?  অথচ ভারতে দেখুন, তারা স্যালুট ঠুকেছে কাপড়হীন সরল জীবনের এক সন্ত কে।

গান্ধীকে আদর্শ আর ছেলেবেলা থেকে স্যালুট জানানো মানুষ মিতব্যয়ী হবেন, পরিমিত হবেন- এটাই তো স্বাভাবিক। শিশু মনের কাদায় পাকি ছাপের কারণেই আজো আমরা উগ্র আর ভোগী।

তারপরও পাকিস্তান-হিন্দুস্তান বুঝতে না পারা এক শৈশবে বড় হওয়া জীবন আমার। একমাত্র ছেলে, দিদিদের আদরের ছোট ভাই. তেল মাখানো পরিপাটি চুল আঁচড়ে দিয়ে কোথাও ছোট্ট কাজলের রেখা এঁকে দিয়ে স্কুল পাঠানো শিশু।

একটু বড় হতেই ইস্কুল এসেমব্লিতে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গাইতাম "পাক সার জমিন সাদে বাদ/কিশ ওয়ারে হাসিন সাদে বাদ"। মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না। মাঝে মাঝে " খাইবার ধারে তার পতাকাবাহী/ মেঘনার কূলে যত বীর সিপাহী...পাকিস্তান জিন্দাবাদ.. গাইতে হতো।

কোনটাই হৃদয় স্পর্শ করতো না যদিও। তারপরও আমাদের জীবন ছিল ভয় মাখানো দেশের মাটিতে আশ্চর্য সুন্দর! পাড়ায় পাড়ায় মাথায় শান্তি ঘট নিয়ে নেমে আসা সন্ধ্যা মায়াবী হয়ে উঠতো তরুণীদের কণ্ঠ সুধায়। এ বাড়ি ও বাড়ি খিড়কি বা জানালা গলে ভেসে আসতো গানের কলি। গান শেখার গান গাইবার কি অপার আগ্রহ।

নামে পাকিস্তান বটে, মানুষ তো বাঙালি। রাজনীতির ময়দান দাপিয়ে বেড়ানো অগ্রজরা তখন হিরো। কি যে কৌতুহল। সময় বুঝে যুবক অগ্রজের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতাম, না কোন রমনীর ছবি নয়। কোন সিনেমা-বায়স্কোপের হিরো হিরোইনও নয়।

সাদামাটা বাংলায় লেখা পোস্টারে ঝুলছে- "বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি"।

কি যে অসাধারণ মমতার সমাজ ছিল আমাদের। দিদি তখন এলাকার একমাত্র এম এ পড়ুয়া. তার পড়া শোনার রাত জাগা পাহারাদার ছিলেন বিহারী মাসী। আসলে সহজ জীবন আর মুক্তির আনন্দে আমাদের বুক জু্ড়ে বেড়ে উঠছিল রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের বাংলাদেশ।

আমাদের অজান্তেই পাড়াগাঁয় বেড়ে উঠছি। কাঁপানো বাঙালি নেতা শেখ মুজিব। নেতা আর রাজনীতি গান্ধীর আগে পরে এমন সম্মান পায়নি কখনো। মানুষ রাত জেগে রোজা রেখে উপোস করে নেতার আদর্শ ও জীবন দীর্ঘ করতে রাজী ছিলো।

পুর্ব পাকিস্তান রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা বাদে এক ঘন তমাল তরুই বটে। একটানা ক্লান্ত মানুষের আশ্রয়। বড় বিচিত্র আমাদের জীবন। ঘরকুনো অলস মেধাহীন আমার মত মানুষকেও তিনটি রাষ্ট্রের নাগরিক বানিয়ে ছেড়েছে। জন্মে পূর্ব পাকিস্তানি, বালক বেলায় উদিত সূর্যের হাত ধরে গর্বিত বাংলাদেশি। আর জীবনের বিকেল বেলায় ক্যাঙ্গারুর দেশের নাগরিক।

তারপরও বলি, আমি ১৪ আগস্ট ভুলি না। আমার অতীত আমারই ছায়া। তার সঙ্গে প্রতারণা চলে না। একজন গর্বিত বাঙালির পাকিস্তান ভেঙে আপন চরিত্র ও স্বদেশ সৃজনের সেই কাল আমি চিরকাল ধারণ করতে রাজি। বিশেষত আমার দেশ যখন আজ সেই সুবর্ণ সময়ের নিকৃষ্ট দালাল ও ধর্মান্ধদের কাছে নতজানু হতে হতেও উঠে দাঁড়াতে পারছে না।

অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া-প্রবাসী সাংবাদিক- [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২২০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।