ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বাঁচতে চাও? তবে ফিনিক্স হও

শিহাবুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৩
বাঁচতে চাও? তবে ফিনিক্স হও

পনের আগস্ট রাতে চামেলিবাগের ফ্লাটে দম্পতি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মা-বাবা তথা সমাজের জন্য যেমন বজ্রাঘাতসম, তেমনি যুগপৎ কিশোর-কিশোরীদের জন্যও বেদনাদায়ী ও বিব্রতকর। অভিযুক্ত সন্তান ঐশী রহমান প্রকৃতপক্ষে মা-বাবার হন্তারক কিনা, সে সিদ্ধান্তে যাওয়ার এখতিয়ার আদালতের এবং তার জন্য বাকি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাকে উদ্ধৃত করে পুলিশ যেসব কথা বলেছে তাতে অনুমান করা যায়, ও নিজে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, ঘটাতে সাহায্য করেছে কিংবা ঘটনা ঘটবে বলে অবগত ছিল।

ঐশী বাংলাদেশের সমাজের সিংহভাগ কিশোর-কিশোরীর প্রতিনিধি নয়, এখানে বেশিরভাগ সন্তান এখনও জন্মদাতা-দাত্রীদের জন্য অপার সম্মান, ভালবাসা ও মমত্ববোধ লালন করে হৃদয়ে। তা সত্ত্বেও এ ঘটনা কোনো কোনো সন্তানের জন্য এমন একটি দুর্ভাবনার জায়গা তৈরি করেছে যে, যাদের নাড়ি ছিড়ে তারা এ পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখেছিল, যাদের অপার যত্নে তারা প্রতিপালিত হচ্ছে তারা কি সন্তানদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছেন। কোনো কোনো মা-বাবা হয়তো সত্যিই তাদের সন্তানের দিকে নিজেদের অজান্তেই একবার চোখ বুলাচ্ছেন একেবারে অন্য এক দৃষ্টিতে, যে দৃষ্টি আগে কখনও তাদের চোখে ছিল না। হয়তো অজান্তেই প্রশ্ন করছেন ওকি আমার হন্তারক হবে, হতে পারে?

ঐশীর ঘটনা নিয়ে এ পর্যন্ত কলাম লেখকদের অনেক কালি খরচ হয়েছে, খরচ হয়েছে পত্রিকার বিস্তর জায়গা অথবা বৈদ্যুতিক তথ্যমাধ্যমের অনেক সময়। বেশিরভাগে লেখা-কথায় একটু রাখ-ঢাক করে অথবা খোলামেলাভাবে ঐশীর বাবার পেশার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আয়-জাত অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনকে এই চূড়ান্ত পরিণতির জন্য দায়ী করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এসেছে সামাজিক পরিবেশের কথা, যার পরতে পরতে রয়েছে কুশিক্ষার সব রকম উপাদান।

এসব কথা কবুল না করার সাধ্য কোনো সুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের নেই। ঐশী যে জৌলুসের মধ্যে বেড়ে উঠছিল, তা ওর একটি ব্যয়বহুল ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার মধ্য দিয়ে, ইয়াবার মতো অভিজাত নেশাদ্রব্যে আশক্তির মধ্য দিয়ে প্রকটভাবে ফুটে ওঠে।

প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়, এমন জৌলুসের ছোঁয়া না পেলে চামেলিবাগের ফ্লাটের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতো না; ঘটতো না রাজনৈতিক ও পুলিশি প্রশ্রয় ও সমর্থনে মাদকের বিস্তার, এমন আগ্রাসী রূপ না নিলে বাঁচতো ঐশী, বাঁচতো ওর মা-বাবা।

এসব বাস্তবতা মেনে নিয়েই ঐশীর বয়সীদের প্রতি কিছু নিবেদন রয়েছে। ঐশী এখনো শিশু নাকি পূর্ণ বয়স্ক সেটা নিরূপণে ওর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে, যার প্রতিবেদন হয়তো ক’দিনের মধ্যে পাওয়া যাবে। পরীক্ষায় শিশু প্রমাণিত হলে ওর বিচার প্রক্রিয়া যেমন কোমল হবে, তেমনি দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তিও হবে লঘু।

কিন্তু ইতোমধ্যে যদি সে পূর্ণবয়স্ক হয়ে থাকে, তাহলে ওর বিচার হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এবং যে কোনো কঠিনতম শাস্তি ওর হতে পারে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এসব আইন শিশুদের অনেকগুলো বিশেষ সুরক্ষা দেয়।

কিন্তু এসব আইনের অর্থ এই নয় যে, একটি শিশু ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত একেবারে অবুঝ থাকে, আর ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন থেকেই সে একেবারে বুঝমান হয়ে ওঠে। মানুষের বুদ্ধির বিকাশ শুরু হয় দোলনা থেকে।

তাই এটা আশা করা যায় যে, ঔশীর সমবয়সীরা এই অপরাধের গুরুত্বটা বুঝবে; বুঝবে এমন অপরাধের জন্য কী কষ্টকর প্রক্রিয়া ও অসম্মানের মধ্য দিয়ে ও যাচ্ছে এবং কী কঠিন শাস্তি ওর জন্য অপেক্ষা করছে। যদিও যে যন্ত্রণা, যে গ্লানি ওকে সইতে হচ্ছে তা অনেকের কল্পনার চৌহদ্দিরও বাইরে।

আড়াল থেকে সামনে টেনে এনে আলোচিত্রীর ক্যামেরা তথা দেশ ও বিশ্ববাসীর সামনে ‘একজন খুনি’ হিসেব দাঁড় করানো কিংবা পুলিশি টানা হেঁচড়া থেকে শুরু করে বয়স নির্ধারণী ডাক্তারি পরীক্ষা প্রতিটি পর্যায় কি নিদারুণ অসম্মানের, কি ভয়ানক গ্লানির।

অবশ্য ঘটনার অব্যবহিত পরের এসব দুর্যোগই সব নয়; আসল দুর্যোগটা শুরু হবে যখন ওর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সময় হবে (যদি ঘটনার সময় ও শিশু হয়ে থাকে এবং সে অনুযায়ী লঘু সাজা হয়)। পৃথিবীর ৭শ’ কোটি মানুষের মধ্যে ও এমন একজনকেও খুঁজে পাবে না, যিনি ওকে নাড়িছেঁড়া মায়ের আশ্রয় দেবেন, যিনি ওকে ভাল রাখার জন্য সোজা-বাঁকা সব পথে হাঁটতে সহাস্যে রাজি থাকবেন। আজ যাদের প্ররোচনায় ও এমন কাজ করেছে বলে অনুমিত হচ্ছে, তারা ওর সঙ্গী থাকবে এ দুর্যোগের পর?

মা-বাবা, সমাজকে আমরা দোষ দিচ্ছি দেদার। এই দোষারোপে হয়তো কোনো কোনো মা-বাবাকে তাদের ভুলটা শোধরানোর সুযোগ করে দেবে, সমাজে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করলেও করতে পারে (যদিও তার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। সমাজ হিসেবে আমাদের যাত্রা আলোর পথে নয়; আমাদের অনন্ত যাত্রা অন্ধকার গহ্বরে)। কিন্তু তাতে কী লাভ হবে ঐশীর। ওর সাজা এবং পরবর্তী ভোগান্তি কি তাতে কমবে এক দণ্ড? ওর একারই সব দুর্ভোগ, সব যন্ত্রণা ভোগ করে চলতে হবে আমৃত্যু। শুধু কি শারীরিক শাস্তি? ওকি একটি রাতের জন্যও দুঃস্বপ্ন তাড়াতে পারবে? স্বপ্নে কি দেখা দেবে না ওর মা, ওর বাবা? ওকে কি বলবে না ‘মা আমরা তোমাকে আজও ভালবাসি’? কী জবাব দেবে ও? ওকে কি কোনো দিন ক্ষমা করবে ওর সবচেয়ে প্রিয় ছোট ভাইটি, এমনকি সেই সন্তানটি যে ওর নিজের অন্তরে ঘুমিয়ে আছে? সমাজকে দায়ী করে দিস্তা দিস্তা কাগজে নিবন্ধ লেখা হলেও এ দায় থেকে ওর মুক্তি মিলবে না।

তবে কি সমাজের বিষে নিঃশেষ হতে থাকবে ঐশীরা; পূর্বসূরীদের জ্বালানো অনলে পুড়ে মরতে থাকবে? না ওদের আর এভাবে মরা চলবে না। বাঁচার জন্য ওদের নির্ভরও করা চলবে না তাদের ওপর, যারা সমাজকে বিষময় করেছে। ওদেরকে ফিনিক্স হয়ে আকাশে উড়তে হবে। ওদের শুধু মাদক, মা-বাবার বৈধ-অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ-সূচিত অন্ধকার গলিগুলো দেখলে চলবে না। ওদেরকে দেখতে হবে সেই কিশোর লিমন হোসেন-তৈরি আলোর মহাসড়ক, যে শুধু বিষময় সমাজ নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের বৈরিতার মুখেও আলোর পথ ছাড়ে নি; যে দরিদ্রের ঘরে জন্ম নিয়েও যে ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ওদেরকে শিখতে  আমাদের সেই কিশোর-কিশোরীদের কাছ থেকে যারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে এমি পুরস্কার ছিনিয়ে এনে। সেই শক্তি ওদের প্রত্যেকের ভেতর আছে। শুধু দরকার অন্তর্নিহিত সেই শক্তির সন্ধান লাভ এবং তা কাজে লাগানোর মনোবল গঠন।

তাহলেই ওরা পারবে মেষের পালের সঙ্গ ছাড়তে আর আধমরা সমাজটাকে ঘা মেরে বাঁচিয়ে তুলতে। তাতে বাঁচবে ওরা; বাঁচবে সমাজ, দেশ।

শিহাবুর রহমান: বেইজিংয়ে চীন আন্তর্জাতিক বেতারে বিদেশি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।