সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় চার হাজার শ্রমিক পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা নিজ নিজ পরিবারের উপার্জনে সক্ষম প্রধান ব্যক্তি হওয়ায় এবং ভবন ধসের পর কাজে অক্ষম হয়ে পড়ায়-পরিবারগুলো চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত এগারো শ` ৩৫ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। প্রায় সোয়া তিনশ` শ্রমিক এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
বিভিন্নভাবে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় তিন হাজার শ্রমিক। এদের মধ্যে অধিকাংশই পঙ্গু ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অথবা কাজে অক্ষম। নিহত ও পঙ্গু ব্যক্তি অধিকাংশই পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় হঠাৎ এই বিপর্যয়ে শ্রমিক পরিবারগুলোর সন্তানদের ভবিষ্যতে অন্ধকার নেমে এসেছে।
সাভার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাতটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৮ শিক্ষার্থীর অভিভাবক নিহত, ১৩ জনের অভিভাবক নিখোঁজ ও ৫৩ জনের অভিভাবক আহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে মাত্র ১২৪ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত! কিন্তু স্থানীয় গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের তথ্যানুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক সন্তানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। তারা বলছেন, উপজেলা শিক্ষা অফিসের এই তালিকা অসম্পূর্ণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক সন্তানদের অধিকাংশই শিশু বয়সী। ফলে বেশিরভাগ পরিবারেরই হাল ধরার মত কেউ নেই। পরিবারগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি আর্থিক সহায়তা দেয়া হলেও তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় নিত্তান্তই অপ্রতুল। পরিবারগুলোকে এককালীন মোটা অঙ্কের সহায়তা দেয়ার কথা বলা হলেও এখনও তারা ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি।
স্পষ্ট করে বলা হয়নি, শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কি হবে। গত জুন মাসে জাতীয় সংসদের নতুন বাজেট পেশ করা হলেও রানা প্লাজার বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ কোন বাজেট রাখা হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, শ্রমিক সন্তানদের ভবিষ্যৎ কি হবে? তাদের আগামী দিনের দায়িত্বই বা কে নেবে?
শিক্ষা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিনিয়ত বানিজ্যিকীকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কার্যত ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্থলে এখন শত শত কিন্ডারগার্টেন নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হচ্ছে। বেসরকারি স্কুলের দোহাই দিয়ে সেগুলোতে মোটা অঙ্কের ফি আদায় করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা পাওয়ার স্বপ্ন, দু:স্বপ্ন হয়ে উঠেছে।
খাদ্যপণ্যের দামে দিশেহারা শ্রমিক পরিবারগুলো সন্তানের পড়ালেখার খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই খরচের টাকা জোগাড় করতে না পেরে উচ্চ শিক্ষার আশা ছেড়ে দিয়েছে। গত কয়েক মাসে প্রয়োজনীয় শিক্ষা পণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। পাশাপাশি একদিকে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির তীব্র প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে ভর্তি ফি হিসেবে দিতে হচ্ছে বড় অংকের টাকা। এর উপর বড় আতংক শিক্ষা উপকরণ মূল্যের উর্ধ্বগতি। বেড়েছে টিউশন ফি, বেতন ও পরীক্ষার ফি। সামনে নতুন বছর আসছে। অনেক শিশুকেই স্কুলে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু অর্থাভাবে কিছুই করতে পারছে না তারা।
শ্রমিক পরিবারগুলোর এই বিপর্যয়ের সময় রাজনৈতিকভাবে দেশ বিভক্ত। এক পক্ষের কথা অন্য পক্ষের কাছে যাচ্ছে না। মৌলিক কিছু বিষয়ে আমরা এক হতে পারছি না। দ্বিদ্লীয় রাজনীতির যাঁতাকালে শ্রমিক পরিবারগুলোও বিপর্যস্ত। অথচ এই শ্রমিকদের দিনরাত শ্রমের ফসলে আমাদের রেমিটেন্স বাড়ে, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরে, বৈদশিক মুদ্রা আয় হয়। কিন্তু তারপরও শ্রমিকদের কথা সরকার কিংবা বিরোধী দল কেউই ভাবছে না। এই পরিবারগুলোকে দাঁড়াতে সাহায্য না করলে একটা অশিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি হবে। তাই দল-মত নির্বিশেষে এই শ্রমিক পরিবারগুলোর সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সবাইকেই পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। কোন বাঙালিই এ দায় এড়াতে পারে না।
সিয়াম সারোয়ার জামিল: ব্লগার, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি