ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সংবিধান সংশোধন, তবে তার আগে...

এরশাদুল আলম প্রিন্স | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৩
সংবিধান সংশোধন, তবে তার আগে...

ঢাকা: গণতন্ত্রে সংসদই সব রাজনৈতিক কার্যক্রমের মূলকেন্দ্র। বলা হয়, রাষ্ট্রে তিনটি বিভাগ- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ-এর মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রে আইন বিভাগের ভূমিকাই মুখ্য।



রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগের কাজে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করে তাদের কাজকে আরো বেগবান ও ত্বরান্বিত করা ও সেই সঙ্গে দেশকে একটি আধুনিক-গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমুখি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যুগপোযুগী আইন প্রণয়ন করাই এর কাজ।  

কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের সংসদকে আমরা এই ভূমিকা পালন করতে দেখিনি। নবম সংসদও তার ব্যতিক্রম কিছু নয়।

কাজেই সংসদের অধিবেশন মানেই হচ্ছে, সংবিধানের বিধান অনুসরণ করে নির্দিষ্ট সময় অন্তর সদস্যদের হাজিরা দেওয়া। এখানে রাষ্ট্রের গুরুতর কোনো সমস্যার সমাধান হবে সেটি আশা করা বাতুলতা মাত্র। তবে, কার্যপ্রণালী বিধির বাইরে গিয়ে অনেক আলোচনা-সংলাপ হতে পারে। সেটি অধিবেশনের বাইরে। স্পিকার, সংসদনেত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী বা দুই দলের হুইপরা মিলে সংলাপ আলোচনা করতেই পারেন।  

এ সব সুযোগকে ব্যবহার না করে, দূতাবাসে ধরনা দিয়ে আর চিঠি চালাচালি করে আমরা কেবল নিজেদের মর্যাদাহানি করে চলছি।

বাস্তবতা যাই হোক, চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শেষ অধিবেশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস, তার সমাধান এই অধিবেশনে হবে কিনা এটাই আজকের প্রশ্ন।

আগেই বলেছি, সংসদ মূলত বিতর্ক ও আইন পাসের স্থান। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এটাই রেওয়াজ। সংসদের কাজ হচ্ছে, (সংখ্যা গরিষ্ঠের) কণ্ঠভোটে আইন পাস করা অথবা দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সংবিধানের সংশোধন করা। আমাদের সংসদের এ দুটিই মূল কাজ।

এছাড়া, যেকোনো রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই আলোচনা হতে পারে। কিন্তু, সংসদে সমাধান করতে গেলে আইন প্রণয়নের পথে যেতে হবে। আর আইন প্রণয়নের পথে যেতে হলেই কণ্ঠভোট (সাধারণ আইন) ও দুই-তৃতীয়াংশের ভোটের প্রশ্ন আসবে। আর বিদ্যমান রাজনৈতিক সমস্যর সমাধান সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে করতে হলে বিরোধী দল হালে পানি পাবে না।

তাই, সংসদের অধিবেশনে যোগ দেওয়া-না দেওয়ায় বিএনপির জন্য কোনো রাজনৈতিক ফয়সালার পথ খুলে দেবে না। কারণ, সংসদে তাদের উত্থাপিত কোনো প্রস্তাব পাস করিয়ে আনার জন্য যথেষ্টসংখ্যক ভোট তাদের নেই। তাই, কণ্ঠভোটেই নাকচ হয়ে যাওয়ার ভয়েই এ যাত্রায় সংসদ বর্জন।  

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনির্বাচিত সরকারের অধীনে রাষ্ট্রকে ন্যস্ত করার বিধান (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বিলুপ্ত করা হয়। নিঃসন্দেহে এটি গণতন্ত্রের পথে একটি অগ্রযাত্রা। আমরা সরকারকে এ জন্য বাহবা দিতেই পারি।

কিন্তু, এ বিধানটি বাতিল করতে গিয়ে সংবিধানে আরো কিছু অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টিকারী বিধানের অবতারণা করা হলো; যেটি মূলত ক্ষমতা হস্তান্তর বা নির্বাচনকেন্দ্রিক বিষয়।

নবম সংসদ সবচেয়ে আলোচিত যে কাজটি করেছে, তা হলো সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন ১৯৯৬ বাতিল। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। স্বাভাবিকভাবেই সংবিধানের আরেকটি সংশোধনী প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সরকার আদালতের রায় মেনেই এ সংশোধনীটি করে।

কিন্তু, আদালতের নির্দেশের দোহাই দিয়ে পুরো সংশোধনীটিই বাতিল করে দেওয়ায় নতুনতর সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়।  

আমাদের দেশে চার দশকের ইতিহাসে আজ অবধি দুই/একটি সংশোধনী বাদে কোনো সংশোধনীই গণতান্ত্রিক আদর্শ ও চেতনাকে ধারণ করে করা হয়নি। ফলে, সংবিধানের খুঁটিনাটি মৌলিক বিষয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র পরিচালনার অনেক বিষয়ই আধুনিক ও গণতান্ত্রিক চেতনা ও বিচারপ্রসূত নয়।

ফলে, আমরা ভাবতেই পারি, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীটি খুব বেশি দূরে নয়, এটি অবশ্যম্ভাবী! আর যদি বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হয় ও তাতে বিএনপি জয়ী হয়, তবে বিএনপি যে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বা ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে’র কথা বলছে, সেটি তারাও আর ফিরিয়ে আনবেনা।

ফলে, আসন্ন নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের অধীনে হলেও সেটি ভবিষ্যতে অনেক সমস্যার দ্বার উন্মোচন করে দেবে। যদিও আপাত সমস্যার সমাধান করবে। ততদিনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি হলে সেটি ভিন্ন কথা।
 
চলমান রাজনৈতিক সংকটের গোড়াতে আছে পারস্পরিক আস্থাহীনতা। সংবিধানের সংশোধনী সেই সংকটকে ঘনীভূত করেছে মাত্র, সৃষ্টি করেনি। তাই, পারস্পরিক আস্থা থাকলে বর্তমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন ও অন্যান্য রাজনৈতিক ঐকমত্য সম্ভব হতো। কিন্তু, তারপরও পঞ্চদশ সংশোধনীর পরিবর্তন ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া তথা ভবিষ্যৎ টেকসই রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের জন্য অপরিহার্য।

এর অন্যতম কারণ, আমরা নির্বাচন কমিশন বা রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করতে পারিনি। এগুলো কাগজে-কলমে শক্তিশালী হলেও বাস্তবে তারা এখনো রাজনৈতিক দল বা সরকারের প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি।  

ফলে, সংসদীয় গণতন্ত্র সংবিধানে অর্জিত হলেও এমনকি সংসদেও তার প্রতিফলন নেই। ৮৬-এর মিডিয়া ক্যু বা ভোট ডাকাতি, ৮৮-এর নির্বাচন বর্জন বা ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-এর ফলস্বরূপ যে গণতন্ত্রের কথা আমরা বলছি, তার কোনো কিছুই সংবিধান ছাড়া রাষ্ট্রের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা কাঠামোতে এখনো জারি হয়নি। তাই, সংবিধানকেই আমাদের আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে।

একথা সত্য, যদিও কেবল সংবিধানেই আমরা পর্যন্ত সংসদীয় গণতন্ত্র বহাল রাখতে পেরেছি, কিন্তু, তাও রাষ্ট্রের সবগুলো অঙ্গ প্রতিষ্ঠানকে ক্রমান্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে ছিল এবং যার অধীনে তিনটি সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা পেলাম, তাও কিন্তু বিচার বিভাগের অনেক ক্ষতির বিনিময়ে।

কিন্তু তারপরও আমাদের গণতন্ত্রের পথেই হাঁটতে হবে এবং সেটা সংবিধানকে নিয়েই।

বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সংবিধানের আলোকেই সম্ভব, সেটিই হোক। আর বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের মধ্য দিয়েই সূচিত হোক সংবিধানের পরবর্তী সংশোধনীর প্রথম পাঠ।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৩
এএপি/এবি/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।