এ বছর ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ইংরেজি ১৪২০ বাংলা ১৫ আশ্বিন ২৫৫৭ বুদ্ধাবর্ষ শুভ ভাদ্র পূর্ণিমা। বৌদ্ধদের কাছে দিনটি মধু পূর্ণিমা নামে পরিচিত।
অনেকের মনের প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে পূর্ণিমা কিভাবে মধু হতে পারে। ঘটনাটি আসলে ঠিক তাই। কিছু বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলির কারণে আমরা বৈশাখী পূর্ণিমাকে বুদ্ধ পূর্ণিমা, আশ্বিনী পূর্ণিমাকে প্রবারণা পূর্ণিমা বলে থাকি।
মধু পূর্ণিমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতয় হয়নি। এক মধুময় অনন্য ঘটনা ভাদ্র পূর্ণিমাকে মধুপূর্ণিমার আলপনা দিয়ে সাজিয়েছে। ঘটনাটি সংক্ষেপ করেও বলা যায়।
তখন মহামতি বুদ্ধ কৌশাম্বীতে অবস্থান করছিলেন। বুদ্ধের তখন সংঘ পরিষদ ছিল। সংঘের মধ্যে বিনয়ধর ও ধর্মকথিক ভিক্ষুসংঘ ছিলেন। কৌশাম্বীর ঘোষকারামে একজন বিনয়ধর ও একজন ধর্মকথিক ভিক্ষু ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের ৫০০ জন করে শিষ্য ছিলেন।
একদিন এক সূত্রধর ভিক্ষু প্রস্রাবখানায় প্রস্রাবের পর পানি ব্যবহার করে পানিসহ পাত্রটি চিৎ করে রেখে আসলেন। এর ঠিক পরেই বিনয়ধর ভিক্ষু প্রস্রাবখানায় ঢুকলেন। তিনি দেখলেন ধর্মকথিক ভিক্ষু পানি ব্যবহার করে পাত্রটি চিৎ করে রেখেছেন।
একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর পক্ষে এটি বিনয় সম্মত আচরণ হয়নি। কারণ পাত্রটি চিৎ হয়ে থাকার ফলে কোনো ক্ষুদ্র প্রাণী পাত্রে পড়ে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা ছিল। তাই বিনয়ধর ভিক্ষুর মতে, ধর্মকথিক ভিক্ষু অপরাধ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে দুজনের শিষ্যদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হলো। বিনয়ধর ভিক্ষুর এ মন্তব্য ধর্মকথিক ভিক্ষুর কানে গেল।
বিনয়ধর ভিক্ষু একপর্যায়ে ধর্মকথিক ভিক্ষুকে উক্ষেপেনীয় নামক দন্ড প্রদান করলেন। কিন্তু ধর্মকথিক ভিক্ষুপ্রবর সেটা সহজে মেনে নিতে পারলেন না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে দুজনই পন্ডিত ছিলেন। সেই সূত্রে সংঘের মধ্যে দুজনেরই গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বিষয়টি রীতিমত পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করল।
তাঁদের বিরোধ ভক্ত, পূজারি এমনকি দেবতাদের মধ্যেও পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থান তৈরি করল। বুদ্ধ বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করলেন। তাঁদের অনেক উপদেশ ও উপামা শুনালেন। কিন্তু এর কোনো প্রভাব তাঁদের ওপর পড়ল না।
ধর্মকথিক ও বিনয়ধর হলেও পর তাঁরা তখন ও বিমুক্ত মহাপুরুষ হননি। তাঁদের মধ্যে লোভ, দ্বেষ, রাগ, মান, অভিমান ইত্যাদি রিপুর উপস্থিতি রয়ে গেছে। তাই তাঁরা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলহপ্রিয় হয়ে উঠলেন।
বুদ্ধ ভাবলেন তারা এখন অস্থির ও চঞ্চল হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে প্রতিহিংসা কাজ করছে। তাদেরকে শিক্ষার মাধ্যমে বুঝাতে হবে। বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে ছেড়ে পারলেয়্যক বনে চলে গেলেন। বনে ভদ্রশাল নামক এক বৃক্ষের নিচে বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করলেন সেটি ছিল বুদ্ধের জীবনের দশম বর্ষবাস।
ঘটনাচক্রে এক হাতিরাজ অন্যান্য হাতির উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে ওই বনে আশ্রয় নেয়। বুদ্ধের সর্বজীবে দয়াভাব বুদ্ধকে সর্বজীবের কাছে বন্দনীয় করে তুলেছে। বর্তমানে বনের সবচেয়ে বড় জন্তুটি কোনো ব্যক্তিকে দেখভাল করে বললে অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে।
কিন্তু করুণাঘন বুদ্ধ ছিলেন এমন এক মহাপুরুষ যাকে মানুষ, দেব, ব্রহ্মা, যক্ষ থেকে শুরু করে বনের হিংস্র জীবজন্তু পর্যন্ত পূজা করতেন। বুদ্ধের জীবদ্দশায় দেবদত্ত শত্রুতা হাসিলের জন্য অদমনীয় হস্তীকে ১৬ মণ মদ পান করিয়ে বুদ্ধকে হত্যা করার জন্য বুদ্ধের দিকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন।
বুদ্ধ দিব্যজ্ঞানে জানতে পারলেন যদি তিনি হাতির সম্মুখীন না হন তাহলে অনেক অসহায় মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। তাই হাতি যে পথে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে যাচ্ছিল বুদ্ধ সেই পথে ধীর মন্থর গতিতে হেটে আসচ্ছিলেন।
যাদের বুদ্ধের অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না তারা ভাবলেন উদ্মাদ হাতি এবার বুঝি বুদ্ধকে মেরে ফেলবে। বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দ স্থবির বুদ্ধের অগ্রভাগে থেকে বুদ্ধকে নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বুদ্ধ আনন্দ স্থবিরের সুরক্ষায় নিজে অগ্রভাগে চলে আসলেন।
ওদিকে মাতাল হাতি বায়ু বেগে ছুটে আসছে। যেন সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেবে। বুদ্ধ তখন হাতির প্রতি করুণাচিত্তে মৈত্রীভাব পোষণ করলেন। হাত তুলে হাতিকে অভয় জানালেন। বায়ু বেগে ছুটে আসা হাতি বুদ্ধের পদপ্রান্তে লুঠিয়ে পড়ল।
এ অদ্ভূত এবং দুর্লভ ঘটনা দেখে বুদ্ধবিদ্বেষী দেবদত্ত হতাশ হলেও অসংখ্য মানুষ অবাক হয়েছিলেন। একই সঙ্গে বুদ্ধের প্রতি একান্ত শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েছিলেন। ওদিকে হাতি বুদ্ধসেবায় নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন করে।
হাতি প্রথমে পা দিয়ে প্রহার করে ভদ্রশাল বৃক্ষের পাদদেশ সমান করে বুদ্ধের জন্য আসন পেতে দেয়। সে আসন গাছের শাখা দিয়ে পরিষ্কার করে দিল। ঘটের মাধ্যমে পানীয় ও পরিভোগ্য জল এনে দিত।
আর গরম জলের প্রয়োজন হলে শুঁড়ের দ্বারা কাঠ ঘর্ষণ করে আগুন সৃষ্টি করত, সেখানে কাঠগুলো প্রক্ষেপ করে আগুন জ্বালাত এবং পাথরের খন্ডগুলো গরম করে তা কাঠের খন্ড দিয়ে উল্টিয়ে কোনো ক্ষুদ্র কূপে নিক্ষেপ করত। তারপর শুঁড় দিয়ে পানি গরম হলো কি না তা পরীক্ষা করে দেখত।
গরম হলে বুদ্ধের সামনে গিয়ে বুদ্ধকে বন্দনা করত। বুদ্ধ পানি গরম হয়েছে কি না তা হাতিক জিজ্ঞাসা করতেন। অতপর বুদ্ধ সেখানে গিয়ে স্নান করতেন। হাতি বুদ্ধের জন্য সুমিষ্ট ফল সংগ্রহ করে আনত।
বুদ্ধ যখন গ্রামে পিন্ডাচরণে যেতেন তখন হাতি বুদ্ধের পাত্র চীবর নিয়ে কুন্তোপরি স্থাপন করে বুদ্ধের সঙ্গে যেতেন। বুদ্ধ লোকালয়ের সীমায় প্রবেশ করলে বলতেন, ‘পারিলেয়্য, তুমি আর যেতে পারবে না। আমার পাত্র চীবর আমাকে দাও। ’
হাতি বুদ্ধের আদেশ পালন করত। কিন্তু বুদ্ধ ফিরে না আসা অবধি সে স্থানে দাঁড়িয়ে থাকত। বুদ্ধ পিন্ডাচরণ করে ফেরার সময় বুদ্ধকে আগুবাড়িয়ে নিত এবং পাত্র চীবর নিজে নিয়ে নিত। পাত্র চীবর বাসস্থানে নামিয়ে রেখে ব্রত সম্পাদনের পর বুদ্ধকে শাখা দিয়ে বাতাস দিত।
রাতে হিংস্র জন্তুর উপদ্রবের আশঙ্কায় শুঁড়ে বিশাল দন্ড নিয়ে সূর্য্যদেয় অবধি বনের অন্তরান্তরে বিচরণ করত। যেন এক অতন্দ্র প্রহরী। এভাবে কেটে যাচ্ছিল হাতির বুদ্ধসেবা ও অভিযান। জন্তু জীবন লাভ করেও যেন ধন্য জীবনের অধিশ্বর হলো।
ওদিকে কলহে লিপ্ত কতিপয় ভিক্ষুদের মধ্যে আদৌ কোনো মৈত্রীভাবের উদয় হলো না। বুদ্ধ বিহার ত্যাগ করে বনে চলে আসার খবর পুরো নগরে ছড়িয়ে যায়। রাজা, শ্রেষ্ঠী, উপাসক, উপাসিকারা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলেন। তারা ভিক্ষু সংঘের আহার, পরিচর্যা, দান, দক্ষিণা সবই বন্ধ করে দিলেন।
এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বোধোদয় হলো। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে তাঁরা অন্যায় করেছেন। তাদের এ বিভেদ ভূলে অচিরেই বুদ্ধের শরণে চলে যাওয়া উচিত। বুদ্ধ অনন্ত করুণাময়। তাদের নিশ্চই ক্ষমা করে দিবেন। তিনি যে করুণা সিন্ধু!
ওই বনের বানর রাজা হাতির বুদ্ধসেবা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলো। সে ভাবলো বুদ্ধকে কি দিয়ে পূজা করা যায়। ভাবনার অন্তরালে এক মৌচাক তার নজরে এল।
কোন এক গাছের ডালে
মধুময় মৌচাক দেখিয়া,
আনন্দে নাচিয়া উঠিল
বানরের হিয়া।
আর কিসের এত দেরি! এক লাফে মৌচাকটি তুলে নিয়ে এসে বুদ্ধের হাতে তুলে দেওয়ার সেকি প্রয়াস। একখন্ড কদলী পত্র ছিঁড়ে পত্রের ওপর মৌচাকটি রেখে বুদ্ধকে দান করল। বুদ্ধ তার দান গ্রহণ করলেন।
কিন্তু না, জীবপ্রেমী বুদ্ধ বানরের শ্রদ্ধার দান ভোগ করছেন না। সুচতুর বানর বুদ্ধ তার প্রদত্ত দান গ্রহণ করবেন কি না তা দেখার জন্য বুদ্ধের দিকে চেয়ে রইল। এ কেমন কথা!
বুদ্ধ কি বৃহৎ ও ক্ষুদ্র দাতার বিচারে দান গ্রহণ করেন না! এর প্রকৃত রহস্য বুঝার মতো হৃদয় বানরের ছিল। বুদ্ধ না অবহেলা করছিলেন দাতাকে, না দাতার দানীয় বস্তুকে। বিচক্ষণ বানর এর কারণ কি তা জানার জন্য মৌচাক খানা উল্টিয়ে দেখল। তাতে দেখল মক্ষিকার ডিম। সর্বনাশ!
এরাই তো দানীয় বস্তুর অন্তরায়। বুদ্ধভক্ত বানর এক এক করে মৌচাকের সব ডিম তুলে নিল যেন একটাও থেকে না যায়। সযতনে ডিমগুলো তুলে নিয়ে আবার বুদ্ধকে মৌচাক দান করল। বুদ্ধ এবার বানরের শ্রদ্ধায় প্রদত্ত দান গ্রহণ করলেন।
তার সামনেই তার প্রদত্ত দানের মূল্যায়ন করলেন। বুদ্ধ মধু পান করলেন। বুদ্ধকে মধু পান করতে দেখে বানরের সেকি আনন্দ! সে কি লাফালাফি! সে যেন বিশ্ব জয় করেছে। গাছের এডাল-ওডালে দুলছে আর লাফালাফি করছে।
সেদিন ছিল শুভ ভাদ্র পূর্ণিমা। এরপর থেকেই এ পূর্ণিমাকে মধুপূর্ণিমা বলা হয়। সে অনেক কথা। আপাতত ঘটনার পাশ কেটে গেলাম। বর্ষাবাস শেষ হয়ে এল। কৌশাম্বীর ভিক্ষুসংঘ বুদ্ধের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
মহাকারুণিক বুদ্ধ তাঁদের ক্ষমা প্রদর্শন করলেন। তাঁদের উপদেশ বাণী প্রদান করলেন। ভিক্ষু সংঘ ও আনন্দের সঙ্গে বুদ্ধকে নিয়ে কৌশাম্বীতে ফিরে গেলেন। পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি হারানোর ভয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করছি।
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে জানাই শুভ মধু পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা। ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: সিমা বিহার, [email protected]>
বাংলাদেশ সময় ২০১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৩
এসএইচ/জিসিপি