ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজধানীতে যানজটের কারণ অপ্রতিরোধ্য প্রাইভেট কার

সৈয়দ সাইফুল আলম ও মারুফ রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৩
রাজধানীতে যানজটের কারণ অপ্রতিরোধ্য প্রাইভেট কার

ঢাকা: প্রাইভেট কার রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ হওয়া সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে ঢাকা শহরে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

ঢাকা শহরের রূপটি গোড়াপত্তনের সময় একেবারেই অন্যরকম ছিল।

মানুষের প্রয়োজনে শহরের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোও আগামীতে শহরের গণ্ডি সীমানায় চলে আসবে।

প্রশ্ন হচ্ছ, এ শহরের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনে কি ধরনের পরিকল্পনা কার্যকরি ভূমিকা রাখবে সে বিষয়টির প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া। রাজধানীবাসীকে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাতায়াতের জন্য। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবই এ সমস্যার অন্যতম কারণ। এ সংকট থেকে উত্তরণে পরিকল্পনাবিদদের আরো দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে।

বর্তমানে ঢাকায় প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হলেও প্রতিদিন প্রায় একশ নতুন গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। যা নানা সমস্যা তৈরি করছে। যেমন পার্কিংয়ের জন্য জায়গা, জ্বালানি খরচ, দূষণ, দুর্ঘটনা, অবকাঠামোগত ব্যয় সর্বপরি জনদুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখনই প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারকারীদেরও নানা দুর্ভোগের শিকার হতে হবে।

ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে কাছাকাছি এলাকায় বাসা, বাজার, হাসপাতাল, শিক্ষা ও বিনোদন সুবিধা রাখা প্রয়োজন। যাতে অল্প দূরত্বে মানুষ প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হন। আর এই অল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য হেঁটে, সাইকেলে, রিকশায় কিংবা অধিক দূরত্বে যাতায়াতের জন্য পাবলিক পরিবহনে চলাচলের সুবিধা বাড়ানো। ঢাকায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়িকে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন।

প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির হিসেব মতে, ২০০৪ সালে ঢাকায় প্রাইভেট কারের সংখ্যা ৯২,৬২৪টি ও জিপের সংখ্যা ছিল ৩৪,৫৪২টি। গত বছরগুলোতে প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরে প্রাইভেট কারের সংখ্যা ১,৫০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই।

প্রাইভেট গাড়ি বৃদ্ধির কারণ
অনেকেই বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সিঙ্গাপুর, কোপেন হেগ কি উন্নত নয়? সেখানাকার অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো হলেও প্রাইভেট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে পাবলিক পরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া ইউরোপে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

প্রাইভেট গাড়ি বৃদ্ধির মূল কারণগুলো হচ্ছে
:: প্রাইভেট গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাস্তা বরাদ্দ দেওয়া। বাসা, শপিংমল সবখানেই পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক করা। এছাড়াও অবৈধভাবে রাস্তা, ফুটপাত ও গলির রাস্তাগুলোতে গাড়ি পার্কিং করা অন্যতম।

এসব ঘটছে প্রশাসনের চোখের সামনেই। এটি মানুষকে প্রাইভেট গাড়ি কেনা ও ব্যবহারে উৎসাহিত করছে।

এদিকে কর কমানোর মাধ্যমে প্রাইভেট গাড়ি কেনায় সহজলভ্য করা হয়েছে। বিভিন্ন অর্থবছরে রিকন্ডিশন গাড়ির ওপর কর কমানো হয়। অথচ সর্বসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যে কর কমানো হয়নি।

:: পাবলিক পরিবহনের উন্নয়ন না ঘটায় অনেকেই প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করছেন। এরই মধ্যে ঢাকায় বাস সার্ভিসের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। প্রাইভেট গাড়ি, সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, ট্যাক্সি ক্যাবের পরিবর্তে বর্তমানে অনেকে বাসে চলাচল করছেন। এরকম যাত্রী সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু এটি অবশ্যই সম্ভবনার দিক। বাস-রেল সার্ভিসকে আরামদায়ক ও সহজলভ্য করা হলে প্রাইভেট গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা কমবে।

:: বিভিন্ন এলাকায় রিকশা উচ্ছেদ হওয়ায় প্রাইভেট গাড়ি কেনার প্রবণতা বাড়ছে। রাজধানীবাসীর বেশির ভাগ যাতায়াত দুই কিলো মিটারের মধ্যে। এই যাতায়াতকারীরা অধিকাংশ রিকশায় চলাচল করেন।

:: প্রাইভেট গাড়ির জন্য লাইসেন্স বিতরণের ক্ষেত্রেও নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। ঢাকায় কি পরিমাণ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সেটি যাচাই করা হচ্ছে না। যারা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করছেন তাদের সম্পদের উৎস বা কয়টি গাড়ি ব্যবহার করছেন তারও খোঁজ খবর নেই। ফলে যে কেউ লাইসেন্স পাওয়ায় প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।

:: বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়াও এ সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ইদানিং গাড়িমেলা হচ্ছে। সেখানে সরাসরি ঋণ সুবিধা দিতে ব্যাংকগুলো তাদের স্টল রাখছে।

:: জ্বালানি সংকট
বর্তমানে সারা বিশ্বেই জ্বালানি সংকট চলছে। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ জ্বালানি নির্ভর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটিও ভাবার সময় এসেছে।

এছাড়া শিল্প কারখানার সেচ কাজ, বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতে জ্বালানি ঘাটতি রয়েছে। এই অবস্থায় যাতায়াত ব্যবস্থায় শুধুমাত্র জ্বালানি নির্ভর যান বাহনের ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক নয়। জ্বালানি নির্ভর যানের মধ্যে প্রাইভেট গাড়ির উপযোগিতাও কম। প্রাইভেট গাড়ি বেশি পরিমাণে ব্যবহারের ফলে যানজট বৃদ্ধি পায়। যেমন- ব্যাংককে ১৯৯৯ সালে নিউম্যান অ্যান্ড কেনওয়ার্থী’র গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন যানজটে ১৪ লাখ ডলার মূল্যের জ্বালানির অপচয় হয়।

:: পার্কিং সমস্যা
প্রাইভেট গাড়ি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পার্কিং সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। রাস্তায় পার্কিংয়ের জায়গা বরাদ্দ দেওয়ায় অন্যান্য পরিবহনের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। মতিঝিলের মত ব্যস্ততম এলাকায় অবাধে গাড়ি পার্কিং হচ্ছে।

:: যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি
এটা সহজেই অনুমেয় অন্যান্য বাহনের চেয়ে প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত খরচ বেশি। আর রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ি বৃদ্ধি পেলে অন্যদেরও যাতাযাত খরচ বৃদ্ধি পায়। মিরপুর সড়কে ডিইউটিপি প্রকল্পের আওতায় রিকশা নিষিদ্ধ করায় প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এই সড়কে যাতায়াত খরচ গড়ে ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

:: পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে
পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকায় যান্ত্রিক যানের কারণে ৫০-৬০ ভাগ বায়‍ুদূষণ হয় (জ্বালানি সমস্যা প্রেক্ষিত বাংলাদেশ ২০০১)। ঢাকায় যে পরিমাণ যান চলাচল করে তার অর্ধেকের বেশি প্রাইভেট গাড়ি। বায়ু দূষণ ছাড়াও বর্তমানে যান্ত্রিক যান কর্তৃক সৃষ্ট শব্দদূষণে জনজীবন অতিষ্ঠ। দূষণের কারণে ঢাকাবাসীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর ৫ লাখ মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে (জ্বালানি সমস্যা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ ২০০১)। যান্ত্রিক যান কি পরিমাণ দূষণ সৃষ্টি করে অন্যান্য স্থানের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। যেমন- ১৯৮৯ সালে মেক্সিকোতে ৪৪ লাখ টন দূষণের ৭৬ ভাগ এবং লস-এঞ্জেলসে ৩৫ লাখ টন দূষণের ৬৩ ভাগ যান্ত্রিক যান থেকে। আর মেক্সিকো ও লস-এঞ্জেলসে যান্ত্রিক যানের মধ্যে প্রাইভেট গাড়িই বেশি। সুতরাং দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার হ্রাস করা প্রয়োজন।

:: যানবাহনের গতি কমেছে
ডিইউটিপি (২০০০-০৫) প্রকল্প পরবর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর সড়কে কখনো হেঁটে বা রিকশায় বাসের আগে পৌঁছানো যায়। এছাড়া ডিইউটিপি প্রকল্পের অধীনস্থ পাঁচটি সড়কে বাসের গতি ১৭ ভাগ কমেছে। কিছু রাস্তায় যাতায়াতের সময় ২৪ মিনিট বেড়েছে। মিরপুর সড়কে প্রকল্প পূর্ববর্তী সময়ে বাসের গতি ১৭ কিমি/ঘণ্টা ছিল। বর্তমানে ১৩.২ কিমি/ঘণ্টা। কারণ এই সড়কে বিপুল সংখ্যক প্রাইভেট গাড়ি বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য সড়কে আগের মতোই রয়েছে। যেমন- এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তান সড়কে বাসের গতি স্বাভাবিক রয়েছে। কারণ এখানে প্রাইভেট গাড়ি কমেছে।

:: প্রতিকারে সরকারি পদক্ষেপ
দূষণ কমানোর জন্য সরকার এরই মধ্যে টু স্ট্রোক বেবি ট্যাক্সি বন্ধ করে ফোর স্ট্রোক বেবি ট্যাক্সি চালু করে। ২০ বছরের পুরনো যান্ত্রিক যান ঢাকায় চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর দাবি করা হয় ৪০ ভাগ বায়ূদূষণ কমানো সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার বায়ুদূষণ কমাতে চাইলে প্রাইভেট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

:: আর্ন্তজাতিক অভিজ্ঞতা
সিঙ্গাপুর, ইতালি, জুরিখ, সাংহাই, প্যারিস, হংকং ও লন্ডনে বিশ্বের অনেক জায়গায় প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন- প্রাইভেট গাড়ি কেনার আগে লাইসেন্স সংগ্রহ করা, লাইসেন্সের খরচ বেশি, গাড়িমুক্ত দিবস পালন, পার্কিং খরচ বৃদ্ধি ইত্যাদি।

:: গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ
বর্তমানে প্রাইভেট গাড়িকে পরিবহন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়া হচ্ছ। এরপর পাবলিক পরিবহন, সাইকেল-রিকশা ও সর্বশেষে পথচারীদের অবস্থান। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে এই ধারাটি পাল্টে দেওয়া প্রয়োজন। ঢাকা শহরে যাতায়াত ব্যবস্থায় এর সম্ভবনা রয়েছে। যেমন- ঢাকার ৭০ ভাগ যাতায়াত স্বল্প দূরত্বে। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকার বেশির ভাগ যাতায়াত দুই কিলোমিটারের মধ্যে। হেঁটে ও জ্বালানিমুক্ত যানে ৮৪ ভাগ যাতায়াত হয় (ডিইউটিপি ১৯৯৮)।

প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে করণীয়
:: হেঁটে, সাইকেলে বা রিকশায় চলাচলের সুবিধা বৃদ্ধি।
:: বাস ও রেল ব্যবস্থার উন্নয়ন।
:: রাস্তা ও ফুটপাতে গাড়ি পার্কিং বন্ধ।
:: সময় ও স্থানের মূল্য অনুযায়ী প্রাইভেট কারের পার্কিং মূল্য নির্ধারণ।
:: লাইসেন্স প্রদানে কঠোরতা অবলম্বন।
:: পিক আওয়ারে প্রাইভেট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ।
:: কিছু এলাকা প্রাইভেট কার মুক্ত করা।

লেখক: পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৩
এএইচএস/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।