সারাদেশে একযোগে পোশাক শ্রমিকেরা আন্দোলন করে যাচ্ছে ন্যূনতম আট হাজার টাকা মজুরির দাবিতে। আমি এই আন্দোলনকে মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন বলব না, এই আন্দোলন পেট বাঁচানোর আন্দোলন।
ঠিক এই সময় মনে পড়ে যাচ্ছে শিকাগো আন্দোলনের কথা। সেই ১২৭ বছর আগে শ্রমিকেরা উপযুক্ত মজুরি ও আট ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। তখন পুলিশের হাতে নির্মমভাবে খুন হন ১১জন শ্রমিক। আজও, এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও, ন্যায্য হিস্যা বুঝে না পাওয়ায় শ্রমিকেদের আন্দোলনে নামতে হচ্ছে, নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হচ্ছে।
অথচ পৃথিবীর বাকি সকল দেশের মত আমাদের দেশেও রয়েছে শ্রমআইন। যেখানে ১০০টার মত আইন ও অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছে। নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, উপযুক্ত মজুরি, স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান, মাতৃত্বকালীন ছুটি, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ইত্যাদির। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো অধিকাংশ পোশাক শ্রমিকই এই সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আমার মনে হয় বেশিরভাগ পোশাকশিল্প মালিক এই সকল আইন জানেন না অথবা জানলেও মানেন না। আর পোশাকশিল্প মালিকপক্ষের নেতারা শ্রমিকদেরও এই সকল অধিকারের কথা শ্রমিকদের জানতে দেন না। আইনগুলো যদি শ্রমিকেরা সঠিকভাবে জানতেন তবে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ ত্যাগী শ্রমিকের দেশে শ্রমবাজার এত সস্তা হওয়ার কথা ছিলো না। রাস্তায় বেরিয়ে আন্দোলন করার দরকার পড়ত না।
আন্দোলন করলে, ভাংচুর করলে সব দোষ হয় শ্রমিকদেরই। হয়ত দাবি আদায় হচ্ছে কিন্তু এই অপরাধে অনেকে চাকুরি হারাচ্ছেন, অনেকেরই বেতন বন্ধ হচ্ছে। এই তথ্যগুলো কিন্তু নেপথ্যেই থেকে যাচ্ছে। আবার আন্দোলনকালে সরকারী পেটোয়াবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ছে শ্রমিকদের উপরে। এ যেন গরু-ছাগল পেটানোর উৎসব। আসলে সরকার নামক আজব বস্তুটা বরাবরই অর্থবানদের পক্ষেই থেকে যায়, গরীবের পেটে কেউ লাথি মারলেও কিছু আসে যায় না।
একজন মালিক কি কখনই ভেবে দেখেছেন যাদের প্রতি বিন্দু ঘামের বিনিময়ে তার কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে উঠছে, তার বউ-ছেলেমেয়েরা সুগন্ধী ছড়ানো ঠান্ডা গাড়িতে চড়ে বিলাসিতায় মত্ত, সেই শ্রমিকদের পরিবার কিভাবে চলছে? মাস শেষে নানা অজুহাতে বেতন প্রদানে বিলম্ব, বেতন কর্তনের হিসাবটাই বুঝি আপনারা বোঝেন? জানেন কি? একজন শ্রমিককে তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে কিংবা অসহায় পরিবারকে ভরণ পোষণ করতে হয় আপনাদের দেওয়া সামান্য কিছু অর্থ দিয়েই। আপনার মত বাসমতি চালের ভাত তাদের স্বপ্নেও জোটে না, তারা সেকথা ভুলেও কল্পনা করে না। ২৮ টাকা কেজির দিয়ে মোটা চালের ভাতেই তাদের মহাতৃপ্তি। তাতেও টানাপোড়েন, পেট ভরে না। মাছ-মাংস মুখে তোলার আগে একশবার চিন্তা করতে হয়; ভাবতে হয় তার উপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর কথা।
অনেকেই ঢাকা, গাজীপুরে আসেন দূর দূরান্ত থেকে। এক চিলতে ঝুপড়ি ঘরে মাথা গুঁজে থাকে ১২০০/১৫০০টাকা ভাড়া দিয়ে। মাসশেষে নিজের অতি সামান্য খরচ বাদ দিয়ে তার চিন্তা করতে হয় অসুস্থ বাবা-মা কিংবা অসহায় পরিবারের কথা। সে জানে বাড়ির মানুষগুলো তীর্থের কাকের মত অপেক্ষায় আছে তার পাঠানো সামান্য অথচ মহামূল্যবান টাকার জন্য। তার পাঠানো অর্থে হয়ত অসুস্থ বাবা ঔষধ কিনবে, ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ চলবে।
শিল্প কারখানার মালিকদের কাছে কিছু প্রশ্ন বারবার করতে মন চায়, “যে মানুষগুলো তিলে তিলে আপনার স্বপ্ন বুনন করে সেই মানুষগুলোকে কি কখনও আপনজন মনে হয়েছে আপনাদের? কখনও কি মনে হয় নি তাদেরও স্বপ্ন থাকতে পারে মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার, দু-বেলা, দু-মুঠো ভালো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার?
কখনও কি বিবেককে প্রশ্ন করে দেখেছেন যাদের হাতে আপনার স্বপ্নের পরশকাঠি তাদেরও আপনার প্রতি দাবি আছে, ন্যায্য পাওনা বুঝে পাওয়ার অধিকার আছে? তাদেরও স্বপ্ন আছে, ভবিষ্যৎ আছে?”
যদি সত্যিকার অর্থে এই প্রশ্নগুলোর জবাব কোনো কর্তাবাবু দিতে পারতেন তবে মনে হয় না উপযুক্ত মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনে নামতে হতো। বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হতো।
নীলকন্ঠ জয় : এম.ফার্ম শিক্ষার্থী, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৩
জেএম/এসআরএস